নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত
![নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/11/3333-67a1dd6367404-67aaffff5f1ed.jpg)
অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের পছন্দীয় ব্যক্তি ও দলকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করে থাকে। জনগণ হচ্ছে দেশের একচ্ছত্র মালিক এবং সরকার হচ্ছে জনগণের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আমানতদার মাত্র।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পরিবর্তন হয়। কোনো দেশে উদার গণতন্ত্র থাকলে সেই দেশের সরকার সব সময় চেষ্টা করে কীভাবে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখা যায়। সরকার এমন কোনো কাজ করতে চায় না, যাতে সাধারণ মানুষ তাদের ওপর বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও পরবর্তীকালে গণবিরোধী আচরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য যত ধরনের কৌশল আছে, তা প্রয়োগ করে থাকে।
বিগত সরকারের আমলে আমরা এ বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রতিহত করার জন্য আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দেয়।
এরপর আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি জাতীয় নির্বাচন ছিল অত্যন্ত ঘৃণিত ও অগ্রহণযোগ্য। তারা শুধু যে নির্বাচনব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে তাই নয়, ভোটার তালিকাও নিজেদের ইচ্ছামতো প্রণয়ন করেছে। ভুয়া ব্যক্তিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। আবার প্রতিপক্ষের ভোটারদের পরিকল্পিতভাবে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বিগত সরকার আমলে অন্তত ২ কোটি ভুয়া ব্যক্তিকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ভুয়া ভোটারের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বিগত সরকার যে ভোটার তালিকাকে বিতর্কিত ও কলুষিত করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক ও নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং সেই মোতাবেক সাধারণ মানুষকে নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা বিধান করা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করা। এবং এটি যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব, জাতির জন্য ততই মঙ্গল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ বছরের শেষের দিকে অথবা আগামী বছরের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারকার্য সম্পাদন করবে। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যেই বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যাতে স্বাধীন ও প্রভাবমুক্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।
সুষ্ঠু ও সঠিক ভোটার তালিকা ছাড়া কোনোভাবেই স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়। এটি উপলব্ধি করেই নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান ভোটার তালিকা সংশোধন এবং যোগ্য নতুন ভোটারদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অতীতে যতবারই ভোটার তালিকা সংশোধন করা হয়েছে, তাতে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কোনোভাবেই বিতর্কিত করা যাবে না। কিন্তু আগামী নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই কিছুটা হলেও সংশয় দেখা দিয়েছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের মনোনীত ব্যক্তিদের ভোটার তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহের কথা; কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য সংগ্রহকারীরা ভোটারদের বাড়িতে না গিয়ে বিকল্প কোনো পন্থায় ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ করেছে। সম্ভাব্য ভোটারদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহণের শেষ তারিখ ছিল ৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তথ্য সংগ্রাহকরা অনেকের বাড়িতে যাননি। ফলে বিপুলসংখ্যক ভোটার সংশোধিত ভোটার তালিকার বাইরে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। একইভাবে যারা মৃত অথবা অন্য কোনো কারণে ভোটার হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন, তারা সংশোধিত তালিকায় থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব ভুয়া ব্যক্তি আগের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন, তারাও সংশোধিত তালিকায় যথারীতি থেকে যাচ্ছেন। পত্র-পত্রিকায় ভোটার তথ্য সংগ্রহকারীদের দায়িত্বহীনতার বিষয় নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের সময়সীমা আর বৃদ্ধি করবে না বলে জানা গেছে। তাহলে কি এই ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা দিয়েই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে?
কেউ কেউ এমনও অভিযোগ করছেন, একটি মহল পরিকল্পিতভাবে ভোটার তালিকাকে বিতর্কিত করার জন্য কাজ করেছে। তারা বাড়িতে বাড়িতে না গিয়ে ঘরে বসে তালিকা তৈরি করছেন, যাতে আগামী নির্বাচনকে বিতর্কিত করে বিশেষ স্বার্থ হাসিল করা যায়। এ অভিযোগ কতটা সত্য, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে। তথ্য সংগ্রহকারীরা কেন ভোটারদের বাড়িতে যায়নি? এর পেছনে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করেছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থবিরতা নেমে এসেছে। কেউই সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। এর একটি কারণ হতে পারে এ রকম-বিগত সরকারের আমলে সাড়ে ১৫ বছরে প্রতিটি সেক্টরকে ব্যাপকমাত্রায় দলীয়করণ করা হয়েছে। অনেকে আবার বিশেষ সুবিধা হাসিলের জন্য নিজেদের চাটুকার ও দলবাজ হিসাবে উপস্থাপন করে বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। সরকার পরিবর্তনের পর এ মহলটি ঘাপটি মেরে আছে। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি বড় ধরনের ভুল পদক্ষেপ হচ্ছে, বিগত সরকারের আমলে যারা দলবাজ, চাটুকার হিসাবে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন, সেসব কর্মকর্তাকে এখনো বহাল তবিয়তে রেখেছেন। পতিত সরকারের আজ্ঞাবহ দলবাজ কর্মকর্তারা কখনোই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারেন না। তাই এদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা দরকার।
নির্বাচন কমিশন যে প্রক্রিয়ায় ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ করছে, তাতে ইতোমধ্যেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো নির্বাচন কমিশন বলবে, যারা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তারা কমিশন অফিসে গিয়ে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এছাড়া এ ধরনের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে তারা মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। তাই প্রস্তাবিত ভোটার তালিকা ত্রুটিপূর্ণ ও বিতর্কিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকার ওপর ভিত্তি করে আর যাই হোক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। আর আগামী জাতীয় নির্বাচন যদি ত্রুটিমুক্ত এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক মাত্রায় গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে আমাদের ভাগ্যে দুর্গতি আছে, এটি নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে।
ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে। তথ্য সংগ্রহকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে, তারা যেন কোনোভাবেই ভোটারদের বাড়িতে না গিয়ে তালিকা হালনাগাদ না করেন। নতুন যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য, তারা যেন কোনো অজুহাতেই সংশোধিত তালিকায় অন্তর্ভুক্তি থেকে বাদ না পড়েন। ইতঃপূর্বের তালিকায় নাম আছে কিন্তু মারা গেছেন অথবা অন্য কোনো কারণে ভোটদানে অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন, তাদের যেন নতুন সংশোধিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা না হয়। কেউ যাতে ভুল তথ্য দিয়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য সংগ্রহকারীরা যাতে স্বাধীনভাবে কারও প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, সে বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে।
যারা নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন অথবা যেসব কর্মকর্তা নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করবেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন; কিন্তু দায়িত্ব পালনকালে তাদের মধ্যে যেন কোনো রাজনৈতিক আনুগত্য প্রকাশ না পায়, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোভাবেই যেন প্রস্তাবিত ভোটার তালিকা বিতর্কিত না হয়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ত্রুটিযুক্ত ভোটার তালিকা ব্যবহার করে আর যাই হোক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়।
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত