এ দূষণ রুখব আমি কেমন করে
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. মাহফুজ পারভেজ
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![এ দূষণ রুখব আমি কেমন করে](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/09/6556-67a7d4397ac15.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
শিরোনামটি নেওয়া হয়েছে কালজয়ী সাংস্কৃতিক ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমান রচিত, সুরারোপিত ও গীত ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’ গানের ছায়া অবলম্বনে। বাংলাদেশের অন্যতম কালচারাল আইকন, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার ইতিহাস সৃষ্টিকারী ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় গানটি যথার্থভাবে ব্যবহার করেছেন। প্রতীকী ঢঙে এ গানে খাঁচাকে পরাধীনতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং খাঁচা ভাঙাকে দেখানো হয়েছে স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা হিসাবে।
মানুষ পাখি নয়, বারবার খাঁচা ভেঙে বের হয়ে এসেছে। ঔপনিবেশিক শক্তির খাঁচা, পরাধীনতার খাঁচা, একদলীয় স্বৈরশাসন এবং ফ্যাসিবাদী অপশক্তির খাঁচাসদৃশ পরাধীনতা ভেঙে বাংলাদেশের মানুষ মুক্ত পরিবেশে বারবার বের হয়েছে। মানুষের স্বাধীনচেতা মানসিকতা কিছুদিনের জন্য অবদমিত হলেও চিরদিনের জন্য খাঁচাবন্দি বা পরাধীন থাকতে পারে না। মানবসভ্যতার ইতিহাসে চির-পরাধীনতার কোনো নজির নেই। আছে মুক্তি ও স্বাধীনতার ইতিবৃত্ত। বিবেকবান মানুষ পশুও নয়, শিকলে তাকে আটকে রাখা যায় না। মানুষ বারবার শিকল ভেঙেও মুক্তি লাভ করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীন মানুষ এখন প্রবলভাবে দূষণের অদৃশ্য শৃঙ্খলকবলিত এবং দূষণের খাঁচায় আবদ্ধ। পরিবেশের দূষণ, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দূষণ জিম্মি করে রেখেছে তাবৎ জনগোষ্ঠীকে। খান আতাউর রহমান, যিনি যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের অরাজকতা দেখে নির্মাণ করেছিলেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নামের সামাজিক-রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের চলচ্চিত্র, বেঁচে থাকলে হয়তো সজোরে প্রশ্ন তুলতেন, এ দূষণ রুখব আমি কেমন করে?
প্রথমেই আসে পরিবেশগত দূষণের বিষয়। সন্তর্পণে আমরা এক নির্মম দূষণচক্রে বন্দি হয়ে পড়েছি। আমাদের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষিত শহরের তালিকায় নিয়মিতভাবেই শীর্ষস্থান অধিকার করছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুকনা মৌসুমে রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ প্রতি বছর বেশি থাকে; কিন্তু এবারের শুকনা মৌসুমে বায়ুদূষণ অতীতের রেকর্ড ভাঙছে। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস শুকনা মৌসুম হিসাবে ধরা হয়। নভেম্বরে ঢাকার বায়ুর মান খারাপ হতে শুরু করে। সর্বশেষ নভেম্বরে বায়ুদূষণ ছিল আগের আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ডিসেম্বরও বায়ুদূষণ ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর সদ্য শেষ হওয়া জানুয়ারি মাসে বায়ুদূষণ আগের আট বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারি মাসের দূষণের এ পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া গত ৯ বছরের (২০১৭ থেকে ২০২৫) বায়ুমান সূচক বা একিউআইয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ক্যাপস প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
পরিবেশ বা বায়ুদূষণ কেবল ঢাকা বা বাংলাদেশেই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের এক মারাত্মক সমস্যা। বায়ুদূষণে শীর্ষস্থান দখলের জন্য নিয়মিত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশের তিন প্রধান শহর। মোটামুটিভাবে প্রথম আসনটি বাংলাদেশের ঢাকা, ভারতের দিল্লি কিংবা পাকিস্তানের লাহোরের কব্জায় থাকছে। বাতাসের মান সূচক (একিউআই) এ তিন শহরের ক্ষেত্রে এতটাই খারাপ ও নাজুক, বায়ুদূষণের শীর্ষস্থানটি সচরাচর অন্য কোনো শহর ছিনিয়ে নিতে পারছে না। কিংবা বলা যায়, বিশ্বের অন্য কোনো শহরই নিজের চরম অধঃপতন ও অবক্ষয় ঘটিয়ে বায়ুদূষণের শীর্ষস্থানটি পেতেও চায় না। আমরা কিন্তু লজ্জাজনক প্রথম স্থানটি অন্য কাউকে নিতেই দিচ্ছি না। অথচ মুঘল রাজধানীর উদ্যানময় ঢাকা, দিলওয়ালাদের শহর দিল্লি আর খানাপিনা-গজল-কাওয়ালির আড্ডা লাহোর দূষিত নয়, হওয়ার কথা ছিল রুচি, সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের শহর।
পরিবেশ দূষণের মতো রাজনৈতিক দূষণের ভূতও ভর করেছে দক্ষিণ এশিয়ায়। চলছে দূষিত কাজ-কারবার: দাদাগিরি, অপর দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ, নাক গলানো। এগুলো রাজনীতির শিষ্টাচার নয় মোটেই। দূষিত কাজ। যার কুপ্রভাব ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া খুবই ভয়াবহ এবং নানারূপ কাঙ্ক্ষিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্মদাতা হয়ে সৃষ্টি করছে অস্থিতিশীলতা ও জনঅসন্তোষ।
দূষণ ছড়িয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও। পেশিশক্তি, সন্ত্রাস, কালোটাকার মালিকরা অতীতের কলঙ্ক মুছে নতুন ভেক ধরছে। চরিত্র বদল করলেও তাদের আচরণ বদল হচ্ছে না। যেখানেই যাচ্ছে, দূষিত রাজনীতিকে সঙ্গে নিয়েই যাচ্ছে। যে কারণে আবার শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি, বাসস্ট্যান্ড-টেম্পোস্ট্যান্ড দখল, হাট-বাজার কব্জা করে নতুন নতুন সিন্ডিকেট গড়ার অপধারা। এসব দূষিত রাজনীতি সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোকেও দূষিত আর কলুষিত করছে এবং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এসব দূষণ ও অসংগতি নিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা সত্যিই কষ্টকর।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, আইন ও প্রথার মধ্যে সংস্কারের কথা বলা হলেও সমাজে বিরাজমান বলদর্পী ও দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল সংস্কার ও পরিবর্তনের কথা কেউ বলছে না। ফসলের স্বার্থে খেত-খামারের আগাছা নির্মূলের বিষয়টিকে যত গুরুত্ব দেওয়া হয়, সুস্থ রাজনীতির জন্য বলদর্পী ও দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তনের বিষয়টি সরকার বা দলগুলোর পক্ষে তত জোরে বলা হয় না। সরকারে, দলে, সমাজে শুদ্ধতার জন্য সময়ে সময়ে শুদ্ধি অভিযান চালানোর দরকার হয়, এ সত্যটিও অনেকেই স্বীকার করতে চায় না। অথচ, সঠিক সময়ে, গুরুত্বের সঙ্গে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে দূষিত ব্যক্তি ও নিয়ম দূর করা হলে বেপথু হওয়া কিংবা স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হওয়ার ঝুঁকি কমে। অতীতে পতিত হয়ে যারা চরম অপমানজনক পরিণতির শিকার হয়েছে, তারা যদি যথাসময়ে সতর্ক হয়ে শুদ্ধিকরণের পথ অবলম্বন করত, তাহলে চরম বিপদ থেকে মুক্ত থাকতে পারত। ভবিষ্যতের জন্য এ শিক্ষা এখনই গ্রহণ না করলে বিপদ কিন্তু পিছু ছাড়বে না।
কিন্তু বাস্তবে আমরা পরিবেশ দূষণের মতো রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দূষণের বিষয়ে মোটেও সচেতন নই। এসব সমস্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট উদ্যোগীও নই। উল্লেখ্য, ঢাকায় যেদিন সবচেয়ে বেশি দূষণ দেখা যায়, অর্থাৎ ২২ জানুয়ারি, তার পরদিনই থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দূষণের কারণে আড়াইশ’র বেশি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। দূষণে থাইল্যান্ডের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম ছিল। অথচ মাত্র তিন দিন বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর হওয়ার পরই স্কুল বন্ধের এমন নির্দেশনা আসে। জানুয়ারিতে ঢাকায় বায়ুমান ৩০০-এর বেশি গেছে কয়েক দিন; কিন্তু স্কুল বন্ধ বা জনস্বাস্থ্যের কথা ভেবে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এ উদ্যোগহীনতা ও অসচেতনতা আমাদের বিরাট বিপদের গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও রোগের প্রকোপ বাড়ছে। ক্রমেই ঢাকা হয়ে পড়ছে বসবাসের জন্য অনুপযুক্ত ও বিপজ্জনক শহর।
রাজনীতিতেও আমরা দেখছি দূষণ ও দখলদারির সংস্কৃতি। সমাজে রয়েছে বলপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত। অর্থনীতিতে চলছে কালোটাকার দৌরাত্ম্য। সংস্কৃতিতে বেলেল্লাপনার তাণ্ডব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এসব চর্চার বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ না থাকায় দূষণচক্র বড় হচ্ছে। মানুষের শুভ ইচ্ছা ও কল্যাণকর আকাঙ্ক্ষা দূষণের তলায় চাপা পড়ছে। এতে বাংলাদেশ বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক সুশাসনের পথে এগিয়ের যাওয়ার পথে বারবার থমকে যাচ্ছে। বস্তুত, এক দমবন্ধ পরিবেশের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে সবাইকে।
এ অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে হবে। পরিবেশের মতোই সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি দূষণমুক্ত না হলে যাবতীয় ইতিবাচক কথা, কর্ম ও প্রচেষ্টা নস্যাৎ হতে বাধ্য। চৌবাচ্চায় ছিদ্র রেখে পানি ঢেলে যেমন কোনো লাভ হয় না, তেমনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দূষণ রেখে সুস্থ ও সুন্দরের প্রত্যাশা ফলবতী হবে না। আশার পিছু পিছু হতাশা গ্রাস করবেই। এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, গণতন্ত্রায়ণ, সাম্য ও বৈষম্যহীনতার যে উচ্চতা প্রত্যাশা করা হচ্ছে, তা বাস্তবে সফলতার মুখ দেখতে পারবে না।
দেশে যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা নীতি ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনলেও রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতিতে বিরাজমান অসংগতি বা দূষণ দূরীকরণে কতটুকু কাজ করবে, তা বলা মুশকিল। উদাহরণস্বরূপ, কালোটাকা ও পেশিশক্তি নির্মূল না করে যতই নির্বাচনি বা স্থানীয় সরকারের সংস্কার হোক, ভোটের সন্ত্রাস ও রক্তপাত এবং তৃণমূলের ক্ষমতা বলয়ে দাপট ও দখলদারত্বের অবসান সম্ভব হবে না। এসব আগাছা ও দূষণ দূর করা না হলে প্যারাসাইটের মতো এরাই ভালো ভালো কাজ ও উদ্যোগের বারোটা বাজাবে। গণতন্ত্রকে আমজনতার কাছ থেকে ছিনিয়ে স্বৈরতন্ত্রের মচ্ছব শুরু করবে। দল ও নেতাদের স্তাবকতা করতে করতে নেতৃত্বকে এক পর্যায়ে ফ্যাসিবাদী দানবেও পরিণত করবে।
আত্মীয় সেজে কাছে এসে, স্তাবকতা ও আনুগত্যের ভেক ধরে, ধান্ধা ও লুটের মতলব নিয়ে, আদর্শের ছদ্মাবরণে আত্মস্বার্থের বগল বাজিয়ে, পেশির দাপট দেখিয়ে, কালোটাকার মাধ্যমে কারসাজি করে একদল মানুষ সরকার, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে কলুষিত ও দূষিত করছে। এদের থামাবে কে? এ দূষণ রুখব আমি কেমন করে?
প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ : চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়