Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মিঠে কড়া সংলাপ

অন্যায় দাবি-দাওয়ার অবসান হোক

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অন্যায় দাবি-দাওয়ার অবসান হোক

ফাইল ছবি

বিভিন্ন কারণে দেশের সাধারণ মানুষের যাপিতজীবনে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা দিনের পর দিন যেন বেড়েই চলেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থানের অভাবের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার গাছাড়া ভাব ইত্যাদি কারণে সাধারণ মানুষের রাস্তাঘাটে চলাচলের স্বাধীনতাটুকু পর্যন্ত এখন হুমকির সম্মুখীন। কারণ যখন-তখন, যে-সে, যেখানে-সেখানে রাস্তাঘাট, রেলপথ অবরোধ করে চলাচলরত মানুষকে অবরুদ্ধ করে রাখায় নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সব শ্রেণির মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্দি অবস্থায় রাস্তায় সময় কাটাতে হচ্ছে। আর এসব ক্ষেত্রে দায়িত্বরত পুলিশ বাহিনী কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো আচরণ করে চলেছে। বেআইনিভাবে রাস্তা অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় রাজপথ অবরোধসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও একশ্রেণির আইন অমান্যকারী ব্যক্তি বা গ্রুপ তাদের অন্যায়, অন্যায্য কার্যকলাপ অব্যাহত রেখে চলেছে; এমনকি থানা পুলিশের কাছ থেকেও তারা আসামি ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অসহায়, দুর্বল মানুষের ওপর সবলের অত্যাচারও দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে, সারা দেশের মফস্বল অঞ্চল বা প্রত্যন্ত এলাকায় এ ধরনের অন্যায়-অত্যাচার, জুলুমবাজি প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনের শাসনের ঘাটতি থাকায়, সেসব এলাকার মানুষের যাপিতজীবন কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে।

আবার কোনো কোনো কলেজের শিক্ষার্থীরা যেভাবে তাদের ইচ্ছামতো দাবি-দাওয়া আদায়ে রাজপথ-রেলপথ অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে জনজীবনে সংকট সৃষ্টি করে চলেছেন, তাতে করে তারা সরকারের অস্তিত্বের প্রতিই প্রকারান্তরে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন। অথচ বিষয়টি একটি গুরুতর অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। তাছাড়া এমন সব আরও অনেক কগ্নিজিবল্ অপরাধও পুলিশ ইগনোর করে যাচ্ছে, তাদের ইগনোর করতে হচ্ছে বলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই জায়গা-জমি জবরদখল করা হচ্ছে, নিজের জমিতে কেউ বাড়ি করতে গেলেও বাধা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি চৌদ্দ পুরুষের ভিটেবাড়িও জোর করে দখলে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এসবই সম্ভব হচ্ছে আইন প্রয়োগে শিথিলতার কারণে। কারণ, এমন কোনো কোনো ঘটনায় দেখা গেছে, অত্যাচারিত, নিপীড়িত ব্যক্তিদের কেউ পুলিশকে অবহিত করার পর অকুস্থলে পুলিশ এসে ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কেটে পড়েছেন; তারা ধমক খেয়ে অথবা তামুক খেয়ে এমন অপেশাদারি আচরণ করছেন।

তাছাড়া রাজধানী ঢাকা শহরে চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি যেভাবে বেড়ে গেছে, তাতেও মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। এক ব্যক্তি জানালেন, রাজধানীর একটি ফ্লাইওভারে উঠতে তার গাড়ি জ্যামে আটকে গেলে সেখানে চাপাতি হাতে কয়েকজন ছিনতাইকারী তার গায়ের কোটসহ সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আর এভাবেই সারা দেশের সাধারণ মানুষকে জীবনধারণের ক্ষেত্রে, চলাচলের ক্ষেত্রে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বর্তমান অবস্থায় দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় একশ্রেণির অপরাধী চক্র যে বিঘ্ন সৃষ্টি করে চলেছে, সে বিষয়টি পরিষ্কার করতেই উপরের কথাগুলো বলতে হলো। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে সরকারি হাইকমান্ডের নাকের ডগায় যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, দাবি আদায়ের নামে বিভিন্ন গোষ্ঠী যেভাবে রাস্তা অবরোধ করে মানুষকে দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত করে চলেছে, সেসব ঘটনা চরম অরাজকতার শামিল। অথচ সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিষয়ে একপ্রকার নির্বিকার ভূমিকা পালন করে চলেছে। রাস্তায় অবরুদ্ধ মানুষের শত অভিযোগ সত্ত্বেও আমাদের রাস্তায় চলার অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না; পুলিশ বাহিনীকে দেখে মনে হচ্ছে, তাদের হাত-পা যেন কোথায় বাঁধা পড়ে আছে।

সাম্প্রতিক সময়ে রাস্তা অবরোধ করে দাবি আদায়ের ঘটনায় সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্ররা গায়ের জোরে যেসব ঘটনা ঘটালেন, যেভাবে মানুষকে রাস্তায় জিম্মি করে সরকারি একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে চাইলেন, সে অবস্থায় তাদের বিদ্যাবুদ্ধিসহ বিবেকও যে বিসর্জিত হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই! কারণ, কোনো শিক্ষিত শ্রেণি বা কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে এসব করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, সরকারি একটি কলেজকে কখন এবং কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় করতে হয় বা হবে, সে বিষয়টি যদি সংশ্লিষ্ট কলেজের ছাত্ররাই ঠিক করে দেন, তাহলে তো সারা দেশে এমন অনেক পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী কলেজ আছে, সেসব কলেজের ছাত্ররাও দাবি তুলতে পারেন, তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে। যেমন, আমার নিজ জেলা পাবনা এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিকেও তো বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। কারণ সেই ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত আকার-আয়তনে বিশাল এলাকাজুড়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজটিও অনেক ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। কিন্তু তাই বলে এসব কলেজ, যেমন, কারমাইকেল কলেজ, ব্রজমোহন কলেজ ইত্যাদি কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরাও যদি তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে রাস্তা অবরোধ করেন, সে ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী হবে? অথচ সেসব কোনো কিছু বিবেচনায় না এনেই ঢাকার তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা ছেড়ে একেকজন বিপ্লবী সেজে রাস্তা অবরোধ করে দিনের পর দিন তারা যুদ্ধংদেহী চেহারা প্রকাশ করতে থাকলেন। যদিও তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের কোনো আন্দোলন থাকলে তা কলেজের অভ্যন্তরে থেকেই পালন করা যেত। দিনের পর দিন এসব অন্যায় আবদার, অন্যায্য অধিকার আদায়ের নামে একশ্রেণির মানুষের অপতৎপরতায় সরকার অতিষ্ঠ হয়ে পড়বে এবং দেশের মানুষের যাপিতজীবনে সেসব ঘটনার প্রভাব পড়বে বিধায় সাধারণ মানুষও সরকারের ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে উঠবেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, গত ছয় মাসে বর্তমান সরকারকে ১৫০টি আন্দোলন মোকাবিলা করতে যেমন বেগ পেতে হয়েছে, অপরদিকে দেশের মানুষকেও এসব আন্দোলনের ফলে রাস্তাঘাটে চলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুঃখ, কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে।

সবশেষে, আজ এ মুহূর্তে সরকারকে কিছুটা হলেও শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করতে হবে। একশ্রেণির মানুষের অপতৎপরতা, অন্যায়, অন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের প্রচেষ্টা ইত্যাদি ঘটনা শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে না পারলে, সামনের দিনগুলোতে এসব ঘটনা আরও বৃদ্ধি পাবে। আর এ অবস্থায় অচিরেই এসব দাবি-দাওয়া আদায়কারী বা আন্দোলনকারীদের উসকানিদাতারাও মাঠে নেমে তাদের আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে চাইবেন। তাই এ মুহূর্তে শক্ত হাতে দেশ পরিচালনার বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি ন্যূনতম সংস্কার শেষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে যেন ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, সেদিকেও অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। কারণ, সুষ্ঠু এবং সঠিক একটি ভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ম্যান্ডেট পাওয়া একটি সরকারের মাধ্যমে দেশটি পরিচালিত হলে অন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে এসব অপতৎপরতা অনেকাংশেই কমে আসবে বলে মনে হয়।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম