ফিলিস্তিনিরা বারবার ফিরে আসে
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
রামজি বারুদ
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![ফিলিস্তিনিরা বারবার ফিরে আসে](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/08/palestine-67a67110ca4c6.jpg)
গত সপ্তাহে দক্ষিণ গাজা থেকে উত্তরে ১০ লাখ ফিলিস্তিনির ফিরে আসা ইতিহাসে এক বিশেষ ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। গাজার সুদূর পশ্চিমে উপকূলীয় রশিদ স্ট্রিট নামক এক সড়কে কয়েক লাখ মানুষ মিছিল করেছেন। এই বাস্তুচ্যুতরা মধ্য গাজা এবং আরও দক্ষিণে মাওয়াসি অঞ্চলের বিশাল বাস্তুচ্যুত শিবিরে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, তারা সবাই একই বিষয়ে কথা বলছিলেন। যখন তাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল, তখন ছিল বিদ্যুৎহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ; তখন সমন্বয় দূরের কথা, তাদের একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগেরও কোনো উপায় ছিল না। নজিরবিহীন ইসরাইলি গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা অতি সামান্য নিত্যপণ্য নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংস হওয়া বাড়িতে তারা ফিরছেন। তারা তাদের ধ্বংস হওয়া শহর এবং শরণার্থী শিবিরে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুলতা প্রকাশ করেছেন; নানাভাবে তারা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করলেন। এক তরুণী একজন সাংবাদিককে তার নিজের লেখা একটি কবিতা শোনালেন। তিনি কিছুটা উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করলেন-‘আমি একজন ফিলিস্তিনি মেয়ে এবং আমি গর্বিত’। নিজেকে ফিলিস্তিনি হিসাবে তার পরিচয়সূচক বক্তব্য ছিল সরল; কিন্তু আবেগপূর্ণ। পরিবার এবং নিজ গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি তার সম্পর্কের কথা তুলে ধরলেন-পরিচয়টি হলো ‘বীরকন্যা, গাজার কন্যা’। একপর্যায়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘গাজাবাসীরা লজ্জার চেয়ে মৃত্যুকেই পছন্দ করেন।’ নিজেদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে প্রত্যাবর্তনকে তিনি ‘বিজয়ের দিন’ হিসাবে চিহ্নিত করলেন।
‘বিভিন্ন সমস্যা কিছু মানুষকে ধ্বংস করে দেয়, আবার অন্যদের গড়ে তোলে। যে মানুষ চেষ্টা অব্যাহত রাখে, তার আত্মা কেটে ফেলার মতো যথেষ্ট ধারালো কোনো কুঠার নেই; আশার মতো অস্ত্র যার কাছে আছে, সে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে।’ দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৭৫ সালে কারাগার থেকে তার স্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে এ কথা লিখেছিলেন। তার এ কথাগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখা; মনে হয় যেন কথাগুলো ফিলিস্তিনিদের জন্য লেখা হয়েছে, বিশেষ করে গাজার সর্বশেষ বিজয় মুছে ফেলার বিরুদ্ধে-শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই।
এ বিষয়টি আরও ভালোভাবে অনুভব করার জন্য ২০২৩ সালের অক্টোবরে গণহত্যা ও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই উত্তর গাজা সম্পর্কে ইসরাইলি নেতারা কী বলেছিলেন, তা পরীক্ষা করা দরকার। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ গাজার ‘সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব’ বজায় রাখবে ইসরাইল। এক বছর পর ইসরাইলি সেনাবাহিনী একই অনুভূতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইতজিক কোহেন ইসরাইলি সাংবাদিকদের বলেছেন, উত্তর গাজার কোনো বাসিন্দার জন্য ‘কোনো প্রত্যাবর্তন’ হবে না। এ বিষয়ে আরও এগিয়ে গিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ; বলেছিলেন, ‘এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব, যেখানে গাজার জনসংখ্যা দুই বছরের মধ্যে তার বর্তমান আকারের অর্ধেকে নেমে আসবে।’ তিনি বলেছিলেন, ইসরাইলের উচিত গাজা পুনরুদ্ধার করা এবং এর বাসিন্দাদের স্থানান্তরকে ‘উৎসাহিত করা’।
অন্য অনেক ইসরাইলি কর্মকর্তা-বিশেষজ্ঞ একই ধারণার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। বেশকটি আবাসন কোম্পানি জুনে গাজায় আবাসনের সুযোগের মূল্যায়ন করার জন্য একটি সম্মেলন করেছে। তাদের ধারণা, শুধু তারাই গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছেন।
ফিলিস্তিনিরা দলে দলে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হওয়া এলাকায় ফিরে এসেছেন। ইসরাইল উত্তর এলাকা দখল করতে বা ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নিধন করতে বা তাদের সম্মিলিত চেতনা দুর্বল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরিবর্তে ফিলিস্তিনিরা আরও শক্তিশালী, আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং ইসরাইলের জন্য সমান ভীতিকর ও নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের এ যেন এক ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন।
ইসরাইলি নেতারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়টি এড়িয়ে তা নিয়ে তাদের মনগড়া তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কয়েক দশক ধরেই তা চলমান রয়েছে। ১৯৪৮ সালের নাকবা (যা ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূল এবং ফিলিস্তিনি সমাজের প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়) থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেক ইসরাইলি নেতা বা শীর্ষ কর্মকর্তা একই সুরে কথা বলছেন। সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড আলোচনায় এ নিয়ে যা বলেছিলেন, তার মূল বার্তাটি ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বার্র্থের পরিপন্থি। তিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কোনো শান্তিচুক্তি হলেও শরণার্থীদের সেখানে ফিরে যাওয়ার কোনো অধিকার থাকবে না!’
গাজা প্রমাণ করেছে, ফিলিস্তিনিরা ইসরাইল বা যারা তাদের প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের কাছে মাথানত করেন না। যখন তারা উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন, ফিলিস্তিনিদের চার প্রজন্ম একসঙ্গে পাশাপাশি হাঁটছিলেন, তারা স্বাধীনতা ও প্রত্যাবর্তনের জন্য গান গেয়েছিলেন-তাদের যাত্রা শুধু গাজার উত্তরে নয়; এ যাত্রা আরও উত্তরে ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনে। ইসরাইল বারবার ইতিহাস সৃষ্টির চেষ্টা করেছে; কিন্তু ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলকে ভুল প্রমাণ করে চলেছেন। ইসরাইলের গণহত্যা সত্ত্বেও তারা গাজায় নিজেদের টিকিয়ে রেখেছিলেন। তারা বিজয়ের জোরালো অনুভূতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। অপরিমেয় ও অকল্পনীয় ক্ষতি সত্ত্বেও তারা নিজেদের ইতিহাস রচনা করে চলেছেন। তারা লিখছেন আশা ও বিজয়ের ইতিহাস।
৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে আরব নিউজে প্রকাশিত, ভাষান্তর : মোহাম্মদ কবীর আহমদ
ড. রামজি বারুদ : সম্পাদক, দ্য প্যালেস্টাইন ক্রনিকল