শতফুল ফুটতে দাও
ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই

ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গত কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার মতো বয়সে শারীরিকভাবে যে কোনো ছন্দপতন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে কারণে ডাক্তার দেখাতে শৈথিল্য করি না। তবে এটাও জানি আমাদের সব ভালো-মন্দের অধিকর্তা আল্লাহতায়ালা। আল্লাহর ইচ্ছাকে কোনো পার্থিব বাঁধনে আটকানো যায় না। আমি যে দু-তিনজন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য শরণাপন্ন হই, তারা সবাই মানুষ হিসাবে অমায়িক এবং আমার প্রতি যত্নশীল। রাজনৈতিকভাবে এদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাকে পেলে চিকিৎসা সম্পর্কিত পরামর্শ সেরে দেশের রাজনৈতিক হালহকিকত সম্পর্কে দু-চার কথা বলেন এবং শুনতে চান।
অতি সম্প্রতি যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, তিনি জানালেন তার এক রোগী আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তার এ রোগী তাকে বলেছেন, তার এখন কোনো সমস্যা নেই। তিনি মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে পারেন। তার বিরুদ্ধে ৬টি মামলা হয়েছিল। সব মামলারই ফয়সালা হয়ে গেছে। এখন আর কোনো মামলা নেই। তবে কীভাবে ফয়সালা হলো তা তিনি জানাতে চাননি। এটা বোধগম্য যে, বিরাট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মামলা থেকে তিনি ছাড় পেয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, এখন তারা পাড়ায় পাড়ায় মিটিং করছেন। জনগণকে সংগঠিত করছেন। আশা করছেন তারা অচিরেই ঘুরে দাঁড়াবেন। তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর মানে হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বনাশ, বাংলাদেশের জনগণের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হওয়া। নতুন করে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের কবলে নিক্ষিপ্ত হওয়া। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই যে যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বহাল করতে কাজ শুরু করেছেন, তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। সম্প্রতি একটি দৈনিকে ড. সাইমুম পারভেজ, যিনি অসলোর নরওয়েজিয়ান স্কুল অব থিওলোজি বিশ্ববিদ্যালয় ও সোসাইটির সহযোগী অধ্যাপক, লিখেছেন, ‘এই অন্তর্বর্তী সময়ে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার ও তার মিত্ররা ছোট ছোট মিছিল, লিফলেট বিতরণ ও অনলাইনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ফিরে আসার পথ খুঁজছে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আটশ-এর বেশি ডকুমেন্টেড হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার পরও শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কারও মধ্যেই প্রকাশ্য কোনো অনুশোচনার কথা শোনা যায়নি। এ ধরনের নির্বিচার হত্যার নির্দেশ কে দিল, কারা তা বাস্তবায়ন করল, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের কী ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো আত্মসমালোচনাও খেয়াল করা যায়নি। বরং ভবিষ্যতে প্রতিশোধ ও খুনের হুমকি এসেছে কিছু আওয়ামী লীগপন্থি অনলাইন এক্টিভিস্টের কাছ থেকে।’
ফ্যাসিবাদের খুনি চরিত্র কখনো বদলায় না। এ খুনিরা জুলাই অভ্যুত্থানের সময় নির্মমভাবে গুলি করে হাজার প্রাণ কেড়ে নিয়ে এবং আরও কয়েক হাজারকে আহত ও পঙ্গু করেও এদের খুনের নেশা মেটেনি। সোজা কথা, গণতান্ত্রিক সমাজে যে সহাবস্থানের কথা গণতন্ত্রীরা বলে থাকেন, তা এদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কথা উঠেছে আওয়ামী লীগের মতো একটি ফ্যাসিবাদী দলকে কিছুতেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। উচিত হবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। কিন্তু তাতেও কি সমস্যার সমাধান হবে? ওদের হাতে রয়েছে জনগণের কাছ থেকে লুট করে নেওয়া লক্ষ-কোটি টাকা, রয়েছে লুকিয়ে রাখা মারণাস্ত্র এবং সর্বোপরি রয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের আশ্রয় ও আশকারা। প্রতিবেশী দেশে, বিশেষ করে কলকাতায় বসে ওরা নানা ষড়যন্ত্রের ঘুঁটি চালাচ্ছে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে তারা বিক্ষোভ ও হরতালের হুমকি দিচ্ছে। তাদের বিক্ষোভ ও হরতালে জনগণের লেশমাত্র সহানুভূতি থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য। তারা এখন নানা ধরনের নাশকতা ঘটানোর ফন্দিফিকির করছে। অস্ত্র ব্যবহার করে তারা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নস্যাৎ করে দিতে চায়। দেশ এখনো ফ্যাসিবাদের ট্রমার জের কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই মুহূর্তে প্রয়োজন এমন এক ধরনের জাতীয় রাজনীতি, যে রাজনীতি আওয়ামী রাজনীতির কবর রচনা করবে। আওয়ামী মতাদর্শের মদিরা পান করে দেশের জনগণের একটি অংশ চৈতন্যহীন হয়ে আছে। তারা জানে না কী সর্বনাশা নেশা তাদের পেয়ে বসেছে। এমন একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে রাজনৈতিকভাবে নিরস্ত্র করতে হলে প্রয়োজন বিকল্প বয়ান সৃষ্টি। এর কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী মতাদর্শকে চিরতরে পরাস্ত করেই জুলাই অভ্যুত্থানের যৌক্তিক পরিণতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আওয়ামী রাজনীতি যে শেষ বিচারে ফ্যাসিবাদ ছাড়া অন্য কিছু নয়, এ কথাটি বারবার বলে যেতে হবে। দলটিকে নিষিদ্ধ করে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। কারণ অন্ধকারে দৃষ্টির আড়ালে বসে ওরা সর্বনাশের জাল বুনে চলবে।
বাসস পরিবেশিত খবর থেকে জানা যায়, চলতি বছরটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, কাউকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না। যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সোমবার নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভায় প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। এ সময় তিনি পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমান্ড সেন্টার গঠনের নির্দেশ দেন।
সভায় প্রধান উপদেষ্টা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করার যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এ বছরটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছে এবং অপতথ্য ছড়াচ্ছে। দেশবাসীকে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে এ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
ফ্যাসিবাদী জাতীয় দুশমনদের অবশ্যই মোকাবিলা ও প্রতিহত করতে হবে। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে একদিকে যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ইস্পাতদৃঢ় অবস্থান প্রয়োজন, তার পাশাপাশি প্রয়োজন জনগণের বিশাল ঐক্য গড়ে তোলা, যেমনটি আমরা লক্ষ করেছি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময়। এ ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাকে অবহেলা করে নিছক ক্ষমতার দৌড়ে লিপ্ত হওয়া আত্মঘাতী হবে। মনে রাখতে হবে, আধিপত্যবাদ গৌতম বুদ্ধ হয়ে যাবে না। তারা তাদের খুন করার অস্ত্র শান দেওয়া থেকে বিরত থাকবে না। মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তাদের যাদের প্রতি দীর্ঘকাল ধরে আস্থা ছিল, তাদের পরিত্যাগ করে নতুন কাউকে সাঙ্গাত হিসাবে পেতে চাইবে। কেউ যদি এর উলটোটি মনে করেন, তাহলে তার চেয়ে বড় ভুল আর কিছু হতে পারে না। আধিপত্যবাদের মিষ্ট কথায় বিভ্রান্ত হওয়া মোটেও সংগত হবে না। মনে করার কোনো কারণ নেই, আধিপত্যবাদীরা শয়তান থেকে ফেরেশতা হয়ে গেছে। শয়তানের সৃষ্টি হয়েছে আগুন থেকে। ফেরেশতারা সৃষ্টি হয়েছেন নূর থেকে। সুতরাং শয়তানের চরিত্রগত রূপান্তর ঘটার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। রাজনৈতিক দল ভোটের অঙ্ক কষবে, তা স্বাভাবিক। তবে ভোটের অঙ্ক কষতে গিয়ে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া কিছুতেই উচিত হবে না।
গত ছয় মাসে বাংলাদেশে ঐক্যের সুর ক্রমান্বয়ে অনৈক্যের ঝনঝনানিতে পরিণত হতে চলেছে। অথচ জুলাইয়ের অভ্যুত্থান জাতির জন্য সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। দ্বিধাবিভক্ত জাতির এখন ঐকমত্যে পৌঁছার এবং একটি নতুন জাতীয় বন্দোবস্তের পথে এগোনোর পথ খুলে দিয়েছে।
জাতীয় জীবনের এ বিরল সুযোগটি কোনোক্রমেই কারও ভুল বা তাচ্ছিল্যের জন্য হারিয়ে ফেলা মোটেও ঠিক হবে না। হাজার বছরেও এমন সুযোগ আসে না। আবু সাঈদ ও মুগ্ধরা অকাতরে জীবন দিয়ে রক্তের আখরে লিখে গেল, হে জাতি, তোমরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। হে জাতি, তোমরা কখনোই আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের ওপর নজরদারিকে শিথিল করবে না। কারণ, Eternal vigilance is the price of freedom.
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ