ইসরাইলের টার্গেট এবার পশ্চিম তীর
দাউদ কুত্তাব
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত গাজা থেকে পশ্চিম তীরে স্থানান্তরিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সামান্য আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র; যদিও সেখানে কাউকে জিম্মি করা হয়নি।
বৈশ্বিক পর্যবেক্ষকরা যখন মার্কিন বৈদেশিক সহায়তার স্থগিতাদেশ এবং ১৫ লাখ গাজাবাসীকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার উসকানির বিষয়ে সোচ্চার, তখন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি আলোচনা বিলম্বিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ইতোমধ্যে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সামরিক অভিযান বাড়ানো হয়েছে এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোকদের ওপর একটি বিপর্যয়কর টোল নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী পশ্চিম তীরে তাদের উপস্থিতি জোরদার করেছে; বিশেষ করে জেনিন শরণার্থী শিবির পুনর্দখলের মাধ্যমে। এ আক্রমণাত্মক কৌশলটি ১৯৭০-এর দশকে এরিয়েল শ্যারনের নীতির অনুরূপ। আবারও নিরাপত্তার নামে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো ধ্বংস করার ফলে বেসামরিক জনগণ সামরিক কূটকৌশলের শিকার হচ্ছে। জেনিনে বাড়িঘর ভেঙে ফেলা এবং রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য বিশাল ক্যাটারপিলার ডি৯ এবং ডি১০ বুলডোজার মোতায়েন গাজার দীর্ঘস্থায়ী দুর্দশার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দাবি করছে, এ অভিযানগুলো চালানো হচ্ছে জঙ্গিদের শক্ত ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করে। তবে ধ্বংসের মাত্রা দেখে বোঝা যায়, এর পেছনে বড় কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, যা হলো নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করার বদলে সমগ্র গোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়া। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, জেনিনে তার সাম্প্রতিক আগ্রাসনের ফলে ১৮ ফিলিস্তিনি মারা গেছে এবং ৬০ জন গ্রেফতার হয়েছে। তবে তারা যে বাড়িগুলো ভেঙে ফেলেছে বা পরিবারগুলোকে গৃহহীন করেছে, সে সম্পর্কে কোনো উল্লেখ করেনি।
তুবাসের দক্ষিণে তামুন শহরে ইসরাইলি বিমান হামলায় ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যে ঘটনাকে কেবলই একটি গণহত্যা হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। অন্যত্র ধ্বংস প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল : সুর বাহেরের আল-তাকওয়া মসজিদটি অনুমতি না থাকার অজুহাতে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জাবাল আল-মুকাবেরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িগুলোরও একই পরিণতি হয়েছে। একের পর এক এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পেছনে একটি কূটকৌশল কাজ করছে বলেই মনে হয়-ফিলিস্তিনি শহরগুলো এবং শরণার্থী শিবিরগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পশ্চিম তীরে ‘গাজা মডেলে’র বাস্তবায়ন।
ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসনের সম্প্রসারণকে ফিলিস্তিনিদের ধ্বংসের ব্যাপারে খোলাখুলি সমর্থনকারী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচের মতো ডানপন্থি ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য থেকে আলাদা করা যায় না। সহিংসতার এ আহ্বানগুলো কেবলই হুমকি নয়; তারা সুপরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি, অধিকার ও মর্যাদা কেড়ে নিতে তৎপর।
ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সাবেক মুখপাত্র আদনান দিমেরি বলেছেন, অত্যাবশ্যক অবকাঠামোর ধ্বংস; যেমন-রাস্তা, পানির ব্যবস্থা এবং পাওয়ার গ্রিড সম্মিলিত শাস্তি ছাড়া কোনো সামরিক উদ্দেশ্য পূরণ করে না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় একটি হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। জেনিনের বাসিন্দা আবু ফয়েজ এ ধ্বংসের ঘটনাকে দ্বিতীয় নাকবার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির কারণ হয়েছিল। তার কথাগুলোর মধ্যে একটি শীতল সত্য রয়েছে : অনেকের জন্য একটি বাড়ি হারানো কেবল একটি বস্তুগত ধাক্কা নয়-এটি ইতিহাস, পরিচয় এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা মুছে ফেলার চেষ্টা। একইভাবে অন্য এক বাস্তুচ্যুত বাসিন্দা মায়সুন খানফার গভীর রাতে তার বাড়ি থেকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার ট্রমা বর্ণনা করেছেন, পুরো আশপাশের এলাকা ছাই হয়ে যাওয়ার দৃশ্য তিনি অসহায়ভাবে দেখেছেন।
তুলকারেম, জেনিন এবং পশ্চিম তীরের অন্যান্য এলাকায় ধ্বংস শুধু সামরিক কৌশল নয়, এটি এমন লোকদের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে ধারণা দেয়, যারা দখলদারত্বের অধীনে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। যে পরিবারগুলোতে একসময় বাড়ি, ব্যবসা ও উপাসনালয় ছিল, তারা এখন একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি, মানবিক প্রয়োজনীয়তার সবচেয়ে মৌলিক জিনিসগুলো থেকে তারা বঞ্চিত।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া প্রতিটি ভবনের পরিবারগুলো গৃহহীন রয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিটি বিদ্যালয়ের এমন শিশু রয়েছে, যাদের শিক্ষার সুযোগ পেতে লড়াই করতে হবে। আগ্রাসনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের নীরব বার্তাটি স্পষ্ট : বৈশ্বিক ভূরাজনীতির দাবা খেলায় ফিলিস্তিনিদের জীবনকে ব্যয়যোগ্য বলে মনে করা হয়।
গাজা ও পশ্চিম তীরে উদ্ভূত মানবিক সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবিলম্বে প্রতিক্রিয়া দাবি করে। কোনো কোনো বিশ্বনেতা এ ধরনের ঘটনার ফাঁকা নিন্দা করলেও তাদের অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত মসজিদ, স্কুল ও হাসপাতাল ধ্বংস করার ঘটনাগুলো শুধুই উদ্বেগ প্রকাশের চেয়ে বেশি কিছু দাবি করে। ফিলিস্তিনের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ স্থানগুলোর সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের ওপর জোর দিয়ে উপাসনালয়গুলোকে ধ্বংসের লক্ষ্যবস্তু করার নিন্দা জানিয়েছে। এ ধরনের আইনের লঙ্ঘনের জবাবদিহি হওয়া প্রয়োজন। জেনেভা কনভেনশনসহ আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোয় বেসামরিক অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে অধিকৃত অঞ্চলে ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে এসব আইনের প্রয়োগ নেই।
ইতিহাস যদি আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে, তা হলো নীরবতা আগ্রাসীদের উৎসাহিত করে। বিশ্ব কয়েক দশক ধরে এ সংকট দেখছে এবং বিক্ষিপ্তভাবে হস্তক্ষেপের প্রস্তাব করেছে, যা ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের মূল কারণগুলোর সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে প্রকৃত চাপ ছাড়া ইসরাইলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ির নিয়মতান্ত্রিক ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতির অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তরিত
দাউদ কুত্তাব : পুরস্কারবিজয়ী ফিলিস্তিনি সাংবাদিক; যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার সাবেক অধ্যাপক