Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মাৎস্যন্যায় ও রাজা গোপাল

Icon

গাজী মিজানুর রহমান

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাৎস্যন্যায় ও রাজা গোপাল

রাষ্ট্রকে বৃহদার্থে একটি সামাজিক সংগঠন হিসাবেও কল্পনা করা যায়। মানুষ সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলে, যাতে ভালোভাবে বেঁচে থেকে মানবজীবন উপভোগ করা যায়। উপভোগ মানে শুধু সুযোগ-সুবিধা ভোগ নয়। আসল উদ্দেশ্য হলো, সুখ লাভের মাধ্যমে মানসিক তৃপ্তি লাভ। একা সুখ ভোগের তৃপ্তির একটা সীমারেখা আছে। সে সীমা অতিক্রম করলে তৃপ্তির সুখ অসুখে পরিণত হয়। একটা দ্বীপের মধ্যে একজন একা একটা সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে সেখানে সর্বসুখ খুঁজে পাবে না। বরং একটি সমাজ কাঠামোর মধ্যে নিজের মানসিক তৃপ্তি অনুযায়ী নিজে বেশি সুখ বা কম সুখ ভোগ করে অন্যদেরও সুখী করতে পারলে সবার ব্যক্তিসুখ শতদল মেলে ধরে।

রাষ্ট্র এ সমাজ কাঠামোর কর্তৃত্বের বৈধ তত্ত্বাবধায়ক। অর্থাৎ এর কাজ হচ্ছে সবার সম্মতির ভিত্তিতে একটি নীতি প্রণয়ন করে সমাজের সবার সুখ নিশ্চিত করা। হবস, লক এবং রুশোর মতে, এমন সামাজিক চুক্তির দ্বারাই রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। এ মতবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ মধ্যযুগের বাংলা অঞ্চল। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে বাংলা মুলুকে মাৎস্যন্যায় এর সময়ে সামাজিক জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, তখন সবাই মিলে গোপাল নামের একজন সামন্তকে রাজা হিসাবে দেশ শাসনের দায়িত্ব দেয়। রাজা গোপালের প্রতিষ্ঠিত শাসকগোষ্ঠী পাল বংশ নামে পরিচিত।

রাষ্ট্রকে একটা সংগঠন মনে করে এর চরিত্র ও কৃতিত্ব বিচার করলে একে একটা পরিবারের সঙ্গে তুলনা করা যায় এবং সেই তুলনা থেকে অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। রাষ্ট্র ধনী না গরিব-কথা বিবেচনায় আনলে, গরিব পরিবারের একটা চিত্র সামনে ফুটে ওঠে, যা বহুলপঠিত গল্পের গনি মিয়া চরিত্রের মতো হতে পারে। ঋণ করে ধুমধাম করে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে, শেষকালে গনি মিয়াকে মাথায় হাত দিয়ে বসতে হয়। গনি মিয়ার মতো দরিদ্র পরিবারে হঠাৎ টাকা হাতে এলে পরিকল্পনাহীনভাবে খরচের মচ্ছব বসে। রাষ্ট্রও এ লক্ষণে আক্রান্ত হলে সাগর বা পাহাড়ের পাশে বসে চুল ছিঁড়তে থাকে অতীতের অবমৃষ্যকারিতার জন্য।

দরিদ্র পরিবারের আরেকটি লক্ষণ হলো, প্রয়োজনমাফিক যেটুকু উন্নয়ন-সুখ দরকার, সে পরিমাণের শিখরে পৌঁছতে পেরে এরা উন্নয়ন কাজ বন্ধ করতে পারে না। গর্ভে সন্তান রেখে একজন মা যেভাবে হেঁটেচলে বেড়ান, তাতে তার অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়। ১০ মাস পরে সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন বলে তিনি সন্তান নেওয়ার সাময়িক কষ্ট সাদরে গ্রহণ করেন। গরিবের উন্নয়ন পরিকল্পনা যুগ যুগ ধরে চলে। গরিবের বাড়িতে গেলে বোঝা যায়, ইট-বালু কিনে এনে রাখা হয়েছে, তার ওপর ধুলাবালি ও শেওলা পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাড়িতে ঢুকবার রাস্তা এখনো কাঁচা।

গরিব মানুষ ছেলেমেয়ের বই কেনার টাকা বা গৃহশিক্ষকের বাজেট থেকে কেটে নিয়ে রান্নাঘর মেরামত করে। তারা বছরে একবার খরচ-খরচা করে পারিবারিক কোনো একটা আনন্দের ঘটনার জোগাড়যন্ত্র করে। তাতে যে মানসিক তৃপ্তি পেতে পারত, তা কোনো কোনো বছরে পরিত্যাগ করে ঘরের বারান্দা খুঁড়ে মেরামত করতে হয়, বা মাথার উপরের চালখানা মেরামত করতে হয়। এমনি অনেক কাজ করতে অনেক প্রয়োজনীয় বাজেট সংশোধন করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দারিদ্র্যের কারণে একসঙ্গে অর্থ জোগাড় করে কাজ করার সামর্থ্য নেই বলে প্রতিবছর জোড়াতালির উন্নয়ন চলতে থাকে। সারা বছর খোঁড়াখুঁড়ি, ধুলাবালি, কাদাবালু, সিমেন্ট-খোয়ার সঙ্গে বসবাস। ঝকঝকে ছিমছাম চত্বর কখনো দেখা যায় না। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে (অন্য অর্থে সারা বছর ধরে উন্নয়ন চলবে) উন্নয়ন কখনো শেষ হয় না। উন্নয়নের অলিখিত বাই-প্রডাক্ট রাবিশের অত্যাচারের দুর্ভোগ সারা বছর পোহাতে হয়।

শহর বা নগরের সড়কে দেখবেন বছরে প্রায় ৩ মাস ভাঙাচুরা অবস্থায় পড়ে থাকার পর এক সপ্তাহ ধরে রোলার মেশিন খোয়া বসিয়ে দুর্মুজ করে চলে যায়। এভাবে পড়ে থাকে ১০-১৫ দিন, তারপর ঢালাই করা হলে মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে যেই ঘর থেকে হাওয়া খেতে সড়কে নেমেছে, অমনি দেখে জাতীয় অর্থে কষ্ট করে যে রাস্তা মেরামত সম্পন্ন করা হয়েছে, তার পাশ দিয়ে তিন চার ফুট কেটে গর্ত করে তার বসানো বা পাইপ বসাচ্ছে আর একটা ‘সেবাদাতা’ সংস্থা। যখন মেরামতের অপেক্ষায় দীর্ঘদিন পড়েছিল, তখন এরা এসে কাজটি করলে গরিব প্রজার হাঁটাচলায় একটু সুবিধা হতো এবং অর্থের অপচয় রোধ করা যেত। তা নয়! এস্টিমেটে আছে পাকা রাস্তা কেটে কাজ করতে হবে। অতএব সড়কের ঠিকাদার পাকা করুক, তারপর বিদ্যুৎ-পানি-টেলিফোনের ঠিকাদার কাজ করবে। না হলে তো কাজে ‘ফাঁকি’ হয়ে যাবে। অতএব, জীর্ণ বৃক্ষের ডাল ভেঙে জনগণ-মালীর মাথায় এসে না পড়া পর্যন্ত ওদের সুখ নেই!

ধরা যাক, কোনো এক পরিবারপ্রধান একবার এলাকার বনেদি জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী এবং সেই সময়ের আসন্ন ভোটের প্রার্থীর বাড়িতে গেলেন-ভোটের সৌজন্য সভা ছিল এটি। নেতা বললেন, ভোট তো হয়েই যাবে, আপনারা ভোট দিলেও আমি হব, না দিলেও আমি হব। তবে ভোটের পর আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া কি উন্নয়ন করতে পারব? আপনাদের সহযোগিতা দরকার হবে।

যাহোক, পরিবার প্রধান যত্নআত্তি পেয়ে ফিরে আসার সময় সম্ভাব্য-নিশ্চিত জনপ্রধিনিধির বাপ-দাদার আমলের জমিদার বাড়ির গেট দেখে মোহিত হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, তার বাড়িতে এমন একখানা গেটের উন্নয়ন-প্রকল্প করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রও মাঝে-মধ্যে এমন উন্নত রাষ্ট্রের দেখাদেখি ফুটানির প্রকল্প নিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অতীতে আমরা বহুবার এসব শুনেছি এবং দেখেছি।

বাংলার সেই গোপাল রাজার কথায় ফিরে আসি। তিনি ৭৫০ থেকে ৭৮১ সাল পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। তার নামের অংশ পাল থেকে পরে তার উত্তরসূরি রাজাদের বংশের নাম হয় ‘পাল বংশ’। পাল রাজারা এতদাঞ্চলে ১০০ বছর ধরে যে মাৎস্যন্যায় বা বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাওয়ার নারকীয় বিশৃঙ্খলা বিরাজ করেছিল, তার সমাপ্তি ঘটাতে পেরেছিলেন। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তবু সে সময়ের ধর্ম গোত্র নির্বিশেষে সব সামন্ত এসে এ ছোট সামন্ত গোপালকে শাসনভার নিতে সামাজিক চুক্তি (অলিখিত) করেছিলেন। গোপাল তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন যথার্থভাবে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট মাৎস্যন্যায় ভেঙে যে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, এই সরকার ঐতিহাসিক কালের গোপাল রাজার মতো মানুষের আস্থার সদ্ব্যবহার করতে পারবে, এটাই প্রত্যাশা।

গাজী মিজানুর রহমান : সাবেক যুগ্ম সচিব

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম