রজত জয়ন্তী উৎসবে যুগান্তর
অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার , উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আজ ১ ফেব্রুয়ারি। যুগান্তর ২৬তম বছরে পদার্পণ করল। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, দুই যুগেরও বেশি সময়ে যুগান্তর ক্রমান্বয়ে নিজেকে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। পাঠকসমাদৃত পত্রিকার মধ্যে যুগান্তর এখন প্রথম সারিতে। এ অর্জনের পেছনে যুগান্তরের সম্পাদক, প্রকাশক এবং এর প্রত্যেক সংবাদকর্মীর গঠনমূলক পরিকল্পনা ও নিরলস পরিশ্রম কাজ করেছে। এ দুই যুগে যুগান্তর অব্যাহতভাবে প্রতিজন পত্রিকা পাঠকের পাঠতৃষ্ণা মেটাতে চেষ্টা করে চলেছে। পত্রিকা পাঠকদের সকালের নাশতা ও চা-কে যুগান্তর সুস্বাদু ও উপভোগ্য করেছে এবং করছে।
পত্রিকা হিসাবে যুগান্তরের অনন্য উচ্চতায় ওঠার পেছনে কতিপয় কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, এর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা পাঠকদের যুগান্তরের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। যুগান্তরের বিভিন্ন পাতার মধ্যে বিশেষ করে এর সম্পাদকীয় পাতা পাঠকদের কাছে অধিক সমাদৃত। যুগান্তরের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত প্রতিটি কলাম বিশ্লেষণধর্মী। এ পত্রিকার নিয়মিত কলামিস্টরা অর্থনীতি, সমসাময়িক রাজনীতি, স্বদেশি ও বিদেশি ঘটনাপ্রবাহের ওপর লিখে থাকেন। যুগান্তর শিক্ষা ও সংস্কৃতি, দুর্নীতি ও সুশাসনের ওপর প্রকাশ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। আমি নিজে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যুগান্তরের কলামিস্ট হিসাবে নিয়মিতভাবে লিখছি। আমার ‘দেশপ্রেমের চশমা’ কলামে প্রকাশিত লেখাগুলো ব্যাপকভাবে পঠিত হয়। অনেক দেশি ও বিদেশি পাঠক ই-মেইলে আমার প্রকাশিত কলাম সম্পর্কে আমার কাছে তাদের প্রতিক্রিয়া পাঠান। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, যুগান্তরে আমি স্বাধীনভাবে লিখতে পারি। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের চাপের মধ্যেও যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগ আমার লেখাকে খুব একটা পরিবর্তন করেনি। আমার প্রতিটি লেখাই তারা প্রকাশ করেছেন। বিগত পনেরো বছরের ফ্যাসিবাদী আমলে আমার যুগান্তরে প্রকাশিত কলামগুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপক্ষে এবং সুশাসন ও গণতন্ত্রের পক্ষে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
আমি একজন বর্ণহীন তুচ্ছ নগণ্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। ৪০ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। এ কারণে শিক্ষক হিসাবে আমি শিক্ষার্থী মহলে পরিচিত। কিন্তু কলামিস্ট হিসাবে যুগান্তর আমাকে দেশে ও বিদেশে অধিকতর পরিচিতি ও সম্মান দিয়েছে। যুগান্তরে লেখার কারণেই সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী পাঠকসমাজের কাছে আজ আমি একজন পরিচিত কলামিস্ট। যুগান্তরের অনলাইন পাঠকসংখ্যা খুব বেশি। এ কারণে আমি সারা বিশ্বের বাংলা ভাষার সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে একজন গ্রহণীয় লেখক হয়ে উঠতে পেরেছি। যুগান্তরে প্রকাশিত আমার অনেক কলাম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকা আমার অনুমতি না নিয়েই প্রকাশ করেছে। আমার ধারণা, ওই পত্রিকাগুলো যুগান্তর সম্পাদকের অনুমতিও নেয়নি। উদাহরণ হিসাবে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানা পত্রিকা আমার অনেক লেখা প্রকাশ করেছে। আমি এ বিষয়ে অবগত হয়েও প্রতিবাদ করিনি। কারণ, আমি চাই আমার প্রতিটি কলাম বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাভাষী পাঠকরা পড়ুন। আমার কলাম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করুন। দেশে ও বিদেশে নতুন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমাকে অনেকবার শুনতে হয়েছে : ‘আপনার নামটি বেশ পরিচিত। আপনি মনে হয় পত্রিকায় কলাম লেখেন। আমি আপনার অমুক কলামটি পড়েছিলাম।’ এমন ঘটনা আমার ব্যক্তিগত জীবনে বহুবার ঘটেছে। যুগান্তরে প্রকাশিত কলামই আমাকে তাদের কাছে পরিচিত ও গ্রহণীয় করেছে। আমি যুগান্তরে যেসব কলাম লিখেছি, তার বেশির ভাগই সমসাময়িক রাজনীতিবিষয়ক। তবে সাহিত্য, দুর্নীতি, সুশাসন প্রভৃতি বিষয় নিয়েও অনেক কলাম লিখেছি। লিখেছি আরও অনেক বিষয়বস্তু নিয়েও। আমার লেখাগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকের কাছ থেকে অনেক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। আবার আমার কোনো লেখায় যে কেউ অখুশি হননি, এমন নয়। অনেক সময় অনেকে প্রকাশিত লেখার ওপর বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তবে তেমন ঘটনা কদাচিৎ ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাঠকের কাছ থেকে এসেছে অভিনন্দন ও প্রশংসা। যারা আমার প্রকাশিত লেখার কোনো বিষয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি সম্মানের সঙ্গে তাদের যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমার মতামতের পক্ষে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।
যুগান্তরের সাহিত্যের পাতাটিও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। যুগান্তরের ঈদসংখ্যা পাঠকপ্রিয়তা পায়। এর বর্ষপূর্তিতেও অনেক গণ্যমান্য লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়। আমি নিজেও বেশ কয়েকবার বর্ষপূর্তি সংখ্যায় লিখেছি। ভদ্রতা করে যুগান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগ প্রতিবার তাদের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমাকে দাওয়াত করে। দুঃখের বিষয়, আমি চট্টগ্রাম ও খুলনায় থাকায় আমার পক্ষে কখনো এমন অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, এমন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, লেখক, কবি-সাহিত্যিক এবং বিভিন্ন গণ্যমান্য পেশাজীবীরা অংশগ্রহণ করে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সংবাদকর্মীদের অভিনন্দন জানান। অনেকে তাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। তাদের বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে পত্রিকার আরও উন্নয়নে উৎসাহিত করেন।
যুগান্তরের অনলাইন সংখ্যা অধিক পঠিত হয়। প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ পাঠক অনলাইনে যুগান্তর পত্রিকা পড়েন। আমরা যারা নিয়মিত যুগান্তরে লিখি, তারা আমাদের লেখার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী পত্রিকা পাঠকদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠি। অনেক বিদেশি পাঠক অনলাইনে যুগান্তরে প্রকাশিত লেখা পড়ে আমাকে ই-মেইলে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এভাবে বহির্বিশ্বের পাঠকসমাজে যুগান্তরের লেখকরা পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশে পত্রিকার সংখ্যা শত শত। অধিকাংশ বড় দৈনিকেই কলাম ছাপা হয়। তবে সব কলাম বা সব সংবাদ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে না। খুব কম পত্রিকাই জাতির সংকটকালে জনগণের স্বার্থ তুলে ধরতে পারে। যুগান্তর এমনই একটি পত্রিকা। এ পত্রিকায় জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য পায়। এ কারণেই যুগান্তর পাঠকের অধিকতর মনোযোগ পায়। অনেক বড় পত্রিকা অনেক সময় নিজস্ব পলিসিগত কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন করা থেকে বিরত থাকে। যুগান্তরের বেলায় এমনটি ঘটতে দেখা যায় না। এ পত্রিকাটি পাঠকদের সময়মতো সঠিক খবরটি জানাতে চেষ্টা করে। এ কারণে যে কোনো ঘটনার পর পাঠকসমাজ সে বিষয়ে যুগান্তরের বিশ্লেষণ পড়তে চান।
আজ যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একজন পাঠক হিসাবে আমি এ পত্রিকার নির্ভীক পথচলাকে অভিনন্দন জানাই। তাদের প্রত্যেক সংবাদকর্মীকে উৎসাহিত করি। আগামী দিনগুলোয় যুগান্তর যেন এভাবেই সবসময় জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে পথ চলা অব্যাহত রাখে। কামনা করি, পাঠকসমাজে যেন এ গণবান্ধব পত্রিকাটি অধিকতর সমাদৃত হয়। আশা করব, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর যুগান্তর ফ্যাসিবাদী শাসনামলের কুকর্ম, দুঃশাসন ও দুর্নীতিকে তুলে ধরা অব্যাহত রাখবে এবং সত্য, সুশাসন ও গণতন্ত্রের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ হয়ে নিজের নির্ভীক পথচলা অব্যাহত রাখবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পত্রিকাটির সম্পাদক, প্রকাশক, সংবাদকর্মী ও পাঠকসমাজকে একজন লেখক ও পাঠক হিসাবে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়