Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

এই রিপোর্ট অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এই রিপোর্ট অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই

প্রতীকী ছবি

সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন, রাষ্ট্র নিপীড়নের হাতিয়ার। যতদিন রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন রাষ্ট্রের নাগরিকরা নিপীড়ন থেকে রেহাই পাবে না। রাষ্ট্রের নিপীড়নের হাতিয়ারগুলোর মধ্যে রয়েছে-আমলাতন্ত্র, পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, বিচারব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রপ্রণীত আইন। আইনকে ব্যবহার করা হয় রাষ্ট্রের নিপীড়নকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। পৃথিবীতে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই, যার হাতে নিপীড়ন যন্ত্র নেই। তাই পৃথিবীতে যতদিন রাষ্ট্র থাকবে ততদিন রাষ্ট্রের নিপীড়নও থাকবে।

রাষ্ট্রের নিপীড়ন নিয়ে যখন কথা ওঠে তখন বলা হয়, পৃথিবীর ধনী ও উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন উলঙ্গভাবে প্রকাশ পায় না। রাষ্ট্রের হাতে নিপীড়নের যন্ত্রগুলো আছে, নিপীড়নমূলক আইনও আছে। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্র যখন এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযমী হয়, তখনই আমরা বলি রাষ্ট্রটি সভ্য, রাষ্ট্রটি মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ইদানীং পৃথিবীর দেশে দেশে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক চলছে। কোনো কোনো দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত করে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। পৃথিবীর ৭০ শতাংশেরও বেশি দেশে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছে। কানাডায় আইন ও তার ব্যবহারে মৃত্যুদণ্ড রোধ করা হয়েছে। ভারতে ১৯৮৩ সালে হত্যার জন্য আইননির্দেশিত বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছে। পাপুয়া নিউগিনি, দি সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ইকোয়েটোরিয়ালগিনি এবং জাম্বিয়া সব ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড তুলে নিয়েছে। পর্তুগালে সব ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড রহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, নিকারাগুয়া এবং নরওয়ে সব ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে। আন্তর্জাতিক আইনে মৃত্যুদণ্ড বারিত করা হয়নি। বেশিরভাগ দেশ মৃত্যুদণ্ডকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করে। ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৫৩ ধারা অনুযায়ী ভারতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে এবং কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিউয়ের ৩৬৮ ধারা অনুযায়ী ভারতে হাইকোর্টকে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর ৭৮টি দেশের মধ্যে ভারতও একটি দেশ, যেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যাই হোক, মনে হচ্ছে একটি দেশ কতটা সভ্য, তা বিচারের অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে দেশটিতে অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয় কিনা। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে নৈতিক যুক্তি হলো, মানুষ যেহেতু প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না, সেহেতু প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অধিকার তার নেই। বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের আইন বহাল আছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘটা করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দৃষ্টান্তও রয়েছে। আইনে যেহেতু রয়েছে, সেহেতু দেশে মৃত্যুদণ্ড হতেই পারে, কিন্তু তা নিয়ে ঘটা করে প্রচার-প্রচারণা চালানো বর্বরতারই শামিল। তবে এভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সমর্থকরা বলবেন, এরূপে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলে তা ভবিষ্যতের অপরাধীদের একই ধরনের অপরাধে লিপ্ত হতে নিরুৎসাহিত করবে। আইনের অধীনে দণ্ড দিয়ে নয়, বরং আইনবহির্ভূতভাবে লোকজনকে ধরে এনে অথবা মিছিলে শামিল হওয়ার জন্য পাইকারিভাবে মানুষ হত্যার নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে আছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে মানুষ খুন করা ডাল ভাতে পরিণত হয়েছিল। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে, বিশেষ করে র‌্যাবকে ব্যবহার করা হয়েছে, নির্বিচারে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণকারীদের দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় করে দেওয়ার কাজে। এসব দেখে মনে হয় না একদিন এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তান আর্মির নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং মানুষের মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি ভেস্তে যেতে পারে। এসব বাহিনীর দ্রুত সংস্কার করা না গেলে, ভবিষ্যতে যেসব সরকার আসবে, তাদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা থেকেই যাবে। হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ বলেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলের সাড়ে ১৫ বছর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যেভাবে রাজনীতিতে জড়িয়েছে, সেখান থেকে তাদের বের করে সংস্কার করা কঠিন হবে। আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো রাজনীতিতে জড়িয়েছে ব্যাপারটা এমন নয়, বরং তাদেরকে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে করে তারা সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের হুকুম তামিল করতে সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে এমন জনবল দিয়ে সাজানো হয়েছে, যাতে বাহিনীগুলো রাষ্ট্রের বাহিনী না হয়ে দলের বাহিনী হিসাবে অথবা দলের স্টর্ম ট্রুপার হিসাবে ভূমিকা পালন করে। বাস্তবে তাই হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্ব এবং কর্মীরা মনে করতে শুরু করেছিল তারাই আইন। তারা যে কোনো কিছু করতে পারে, তাদেরকে বারিত করার জন্য কেউ নেই। বলপ্রয়োগে নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার জন্য কোনো রকম বলাই ছিল না এ বাহিনীগুলোতে। এসব বাহিনীতে পদ-পদবি, পদোন্নতি এবং পদক দেওয়া হতো সেসব ব্যক্তিদের, যারা চোখ বুজে দমননীতি চালাত সরকারবিরোধীদের ওপর।

হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে ‘আফটার দ্য মনসুন রেভুল্যুশন : এ রোড ম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ এমন সুপারিশ তুলে ধরেছে। এ প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার প্রকাশিত হওয়ার কথা। প্রতিবেদনে গণ-অভ্যুত্থানের আগেপরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) বিলোপ করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি করেছে বিএনপি। অথচ বিএনপির শাসনামলে র‌্যাব গঠিত হয়েছিল। তখন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে গিয়েছিল। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, বিএনপি সরকারের ক্ষমতায় থাকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তাই তৎকালীন বিএনপি সরকার সিদ্ধান্ত নিল একটি এলিট বাহিনী গড়ে তোলার, যে বাহিনী ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের দমন করতে সক্ষম। কয়েক মাসের প্রশিক্ষণে এ দুর্ধর্ষ এবং ভীতি সঞ্চারকারী বাহিনীটি গড়ে তোলা হলো। এ বাহিনী চিহ্নিত দুষ্কৃতকারীদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো দুষ্কৃতকারীও এ বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের মমিনুল্লাহ ডেভিড অন্যতম। সুনির্দিষ্টভাবে রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট না করায় এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হত্যা করায় সাধারণভাবে জনমনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। স্কুলগুলোতে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সময় বালকরা যেমন খুশি তেমন সাজতে গিয়ে কালো পোশাক পরে র‌্যাবের রূপ ধারণ করত। র‌্যাবকে নিয়ে এই উৎসাহ কোনোক্রমেই কাম্য ছিল না। কারণ যখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনুমোদিত হয় কিংবা তা দেখেও চোখ বুজে থাকা হয়, তখন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ। বহু বছর ধরে র‌্যাব নির্যাতন করে আসছে-এমন তথ্য-উপাত্ত সংস্থাটির কাছে রয়েছে। দাতাদের অর্থায়নের বাহিনীটিকে মানবাধিকারের প্রশিক্ষণ দিলেও কোনো কাজে আসেনি বলে মনে করে সংস্থাটি। দাতাদের এ বাহিনীর পেছনে অর্থ খরচ করাকে ভুল বলছে এইচআরডব্লিউ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র-আন্দোলনের সময় নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালানো হয়েছিল। এ ধরনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত নিরাপত্তাবাহিনীর একটি সু-প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন, যারা দীর্ঘ সময় ধরে দায়মুক্তির সংস্কৃতি উপভোগ করে আসছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ হিসাবে বর্ণনা করেছিল। পুলিশসহ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়মুক্তি ও জবাবহীনতার বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত।

শেখ হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে চলে যান, তখন বহু থানা ভূতুড়ে ভবনে পরিণত হয় এবং জনরোষের ভয়ে পুলিশ সদস্যরা গা ঢাকা দিয়েছিল। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা গণভবন ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে সামরিক বাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীকে চোখ বুজে দমন চালানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন তিনি পুলিশ বাহিনী যে নির্মমতার সঙ্গে দমন চালিয়েছিল, তার প্রশংসা করেন এবং সামরিক বাহিনীকে অনুরূপভাবে দমনপীড়ন চালাতে আহ্বান জানান। কিন্তু সেনাপ্রধানসহ নৌ ও বিমান বাহিনীপ্রধানরা সাফ বলে দেন, অতিরিক্ত দমনপীড়নের বা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বিক্ষোভ দমনের সুযোগ নেই। এ থেকেই বোঝা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় কী মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। আমরা এ ট্র্যাজিক হত্যাকাণ্ড ভুলে যেতে পারি না। শোনা যায়, পুলিশ বাহিনী যে হারে গোলাবারুদ ব্যবহার করেছিল, তার ফলে গোলাবারুদের মজুত ফুরিয়ে গিয়েছিল। মধ্য আগস্টের দিকে ৬৩৯ থানার মধ্যে ৬২৮টি আবার কার্যক্রম শুরু করে। এ যাত্রায় পুলিশ হতোদ্যম হয়ে পড়েছে এবং আইন দ্বারা সিদ্ধ কার্যক্রমও চালাতে উদ্যোগী নয়। একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাতের বেলা ঢাকা শহরে পুলিশি টহল চোখে পড়ে না ও পুলিশের চৌকিগুলোতে পুলিশদের দেখতে পাওয়া যায় না। এমন অবস্থায় ঢাকা নগরীতে ছিনতাই-রাহাজানিসহ নানা রকমের অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। আওয়ামী পুলিশদের দায়িত্বে বহাল রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সুতরাং দায়িত্ব পালনে অনীহা এবং রাজনৈতিকভাবে অনির্ভরযোগ্য এ পুলিশ বাহিনী দিয়ে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হয় না। দ্রুত তদন্ত করে অনির্ভরযোগ্য পুলিশদের বাহিনী থেকে বিতাড়ন করাই শ্রেয়। প্রয়োজন সাহসের সঙ্গে নতুন লোকবল জুগিয়ে বাহিনীটির হৃত মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কাজটি কঠিন হলেও দুরূহ নয়। এর সুবাদে দেশ বেঁচে যাবে এবং দেশের উন্নয়নযাত্রা বাধামুক্ত হবে। এর পাশাপাশি হিংস্র র‌্যাব বাহিনীকে বিলুপ্ত করে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এখন সময়ের দাবি। পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদেরকে দ্রুত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। অন্যথায় দেশে সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আশা করা যায় না।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম