Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্ব দেবে কে

Icon

দানা এল কুর্দ

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্ব দেবে কে

ছবি: সংগৃহীত

গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই গাজা উপত্যকার ধ্বংসের তাৎক্ষণিক প্রভাবের দিকে মনোনিবেশ করেছে। আলোচনা হচ্ছে, ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির শর্তাবলির ওপর ভিত্তি করে কোন সংস্থাগুলো সেখানে সাহায্য পরিচালনা করবে, কীভাবে এ অঞ্চলের পুনর্গঠন শুরু হতে পারে, আন্তর্জাতিক অনুঘটকদের ভূমিকা কী হবে ইত্যাদি। এসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যে ফিলিস্তিনিরা এবং তাদের রাজনৈতিক সংস্থাগুলো কিন্তু অনুপস্থিত। এ বিষয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার। এ যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনের কী হবে? কে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলবে এবং ইসরাইলের সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তির শর্তাবলি নিয়ে আলোচনার জন্য পূর্ববর্তী কাঠামোগুলো কি আর প্রাসঙ্গিক থাকবে? দীর্ঘ ১৫ মাসের অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞের পর অবশেষে যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় ফিলিস্তিনিরা অবশ্য স্বস্তি পেয়েছে, অনেক বিশেষজ্ঞ যাকে গণহত্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। যুদ্ধটি ১৯৪৮ সালের নাকবাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যেখানে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল।

এদিকে যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। এক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ চুক্তিটি আসলে ‘শ্বাসরোধ চুক্তি’ হতে পারে, যা বাস্তবিকভাবে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তনের উদ্দেশেই ডিজাইন করা হয়েছে। এ চুক্তিটি ফিলিস্তিনি শাসনের প্রশ্নকে গুরুত্ব দেয় না-সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টোনি ব্লিঙ্কেন বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অংশীদারদের দ্বারা সমর্থিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এ ভূখণ্ডের তত্ত্বাবধান করতে পারে কিনা, সেটি নিয়ে এখনো আলোচনা করা হয়নি। তারপরও অনেক ফিলিস্তিনি এ মুহূর্তটিকে কোনো না কোনোভাবে বিজয় হিসাবেই দেখছে।

গাজার জনগণ ব্যাপকভাবে ঘরবাড়ি হারালেও তাদের কিন্তু বের করে দেওয়া হয়নি। ফিলিস্তিনিরা উপত্যকার উত্তরে তাদের বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপে ফিরে যেতে তাদের দাবির ওপর জোর দিয়েছিল এবং জয়ীও হয়েছে। বড় কথা হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের পরিচয় ও জাতীয়তাবোধ এখনো জাগ্রত। ইসরাইল দ্বারা এ যাবৎ যত হামলা হয়েছে, তাতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের সমর্থনে আন্দোলনের পরিধি বিশ্বব্যাপী ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নেতৃত্বের শূন্যতা কিন্তু পূরণ হয়নি। এটি আমাদের বর্তমান ফিলিস্তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রধান সংকটের দিকে নিয়ে যায়।

বর্তমানে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের দুটি রূপ রয়েছে। সেখানে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো রয়েছে, যার কাতারে একটি ভারপ্রাপ্ত প্রধান রয়েছে এবং রামাল্লায় ফাতাহ পরিচালিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ রয়েছে। দুজনের কেউই এ সুযোগে উঠে আসেনি। এটা এখনো স্পষ্ট নয়, এ মুহূর্তে তারা ফিলিস্তিনের জাতীয় দাবিগুলো কীভাবে পূরণ করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করা দুজন নেতা থাকা ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক স্থবিরতার স্পষ্ট লক্ষণ।

১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে ফাতাহ পরিচালিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও ইসরাইলের সঙ্গে সমন্বয় করে পশ্চিম তীরের কিছু অংশে কাজ করার অনুমতি পেয়েছিল। এটি এখন নির্বাচন করে বা কোনো অর্থবহ উপায়ে ফিলিস্তিনিদের কাছে জবাবদিহি না করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বৈধতা দাবি করছে। ফাতাহ ফিলিস্তিনিদের বিকল্প নেতৃত্বের প্রার্থী, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে পাশ কাটিয়ে ক্রমবর্ধমান বসতি স্থাপনকারী সহিংসতা বা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অভিযান থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার গাজায় যখন ইসরাইলের হামলা চলছিল, সে সময় ফাতাহ নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থেকে ইসরাইলকে একরকম সহায়তাই করেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউ খেয়ালই করেনি, এ কর্তৃপক্ষ অনেকদিন ধরেই তার নিজের জনগণের মধ্যে বৈধতা হারিয়েছে। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের সংসদীয় নির্বাচনে জয়লাভের পর হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সেই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও সংগঠনটি গাজা উপত্যকায় ঠিকই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউই এ বিষয়টিকে জরুরি বলে মনে করেনি যে, ফিলিস্তিনের অঞ্চলগুলো আলাদাভাবে পরিচালিত হয়েছে বা হামাস উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে গাজার জনগণকে কঠোর অবরোধ সহ্য করতে হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত নীতিনির্ধারকরা ধরেই নিয়েছিলেন, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ‘সহিংস ভারসাম্য’ বজায় থাকবে এবং বিভক্ত শাসন, দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতৃত্ব এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের কোনো রাজনৈতিক সমাধানের এ স্থিতাবস্থা টেকসই হবে না।

বিগত ১৫ মাসে দেখা গেছে এ পরিস্থিতি কখনোই টেকসই ছিল না। আমরা জানি, ফিলিস্তিনের মানুষ জোর দিয়েই বলছে, এ অঞ্চল তাদের নিজেদেরই শাসন করা উচিত এবং গাজায় অবিলম্বে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা উচিত। সম্ভবত এ জনসাধারণের অনুভূতি অনুধাবন করে দুটি প্রধান ফিলিস্তিনি দল যুদ্ধবিরতির পর গাজা উপত্যকা পরিচালনার জন্য একটি প্রযুক্তিভিত্তিক কমিটি গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছিল-যদিও সেই কমিটি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা, তা দেখার এখনো বাকি।

তাহলে, এরপর কী? সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনিরা শুধু গাজা শাসনকারী ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) ধারণা প্রত্যাখ্যান করে। এ কর্তৃপক্ষকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখা হয়, যা জীবনযাত্রার অবনতি এবং জাতীয় আন্দোলনের সভাপতিত্ব করেছে। এটা সত্য যে, পিএ প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু মৌলিক পরিষেবা প্রদান করে, কিন্তু আব্বাস এবং পিএ-কে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য অভিযুক্ত করা তাদের বক্তৃতার একটি সাধারণ বিষয়। তাহলে এরপর কী হবে? ফিলিস্তিনিদের অধিকাংশই গাজাকে এককভাবে পরিচালনা করার ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে।

এ সত্যটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে, আন্তর্জাতিক নিপীড়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে মনোনীত হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হামাস ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কিছু বৈধতা অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক জনমত জরিপে আগের তুলনায় হামাসের জনপ্রিয়তাও বাড়তে দেখা গেছে। এরপরও এসব জরিপে দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশ ফিলিস্তিনিই বিশ্বাস করে না কোনো দলই নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য।

এটা বিস্ময়কর যে, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চললেও তা একটি সহজ সত্যকে স্পষ্ট করেনি : ফিলিস্তিনের জনগণকে ছাড়া এ সংঘাতের সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

এরপরও অনাহার, বোমাবর্ষণ, দমন, অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের হামলা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা একটি সুন্দর দিনের আশায় বুক বেঁধে আছেন। তবে যদি রাজনৈতিক ও নীতিগত সমাধান না হয়, তাহলে ইসরাইলিদের সশস্ত্র অভিযান অনিবার্যভাবে বাড়বে।

কাজেই যে কোনো টেকসই সমাধানের জন্য ফিলিস্তিনি সমাজকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদেরই তাদের নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে, যাতে তাদের পক্ষে কেউ আলোচনা করলে তা সবার কাছে বৈধতা পায়। এর অর্থ হচ্ছে, প্রতিশোধ ও হত্যা ছাড়াই ফিলিস্তিনিদের নিজেদের মধ্যেই আলোচনার সুযোগ দেওয়া। এবং এর অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ফিলিস্তিনি এজেন্সির কোনো মতামতকে উপেক্ষা করার পরিবর্তে সাহসী ও সৃজনশীল সমাধানের পথকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। এর চেয়ে কম কিছুই গাজার দুর্ভোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের তাৎক্ষণিক সংকটের সমাধান করবে না এবং এর চেয়ে কম কিছুই দীর্ঘমেয়াদি শান্তি অর্জন করবে না।

দ্য গার্ডিয়ান (২৭.০১.২৫) থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস

দানা এল কুর্দ : ফিলিস্তিন ও আরব রাজনীতিবিষয়ক গবেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম