Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রোক্লেমেশন বিষয়ক বিতর্ক

Icon

মাহমুদুর রহমান মান্না

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রোক্লেমেশন বিষয়ক বিতর্ক

আগস্ট অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই ছাত্রনেতারাই এ বিতর্ক তুলেছিলেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিক থেকে তারা এ বিতর্ক সামনে আনেন। আমি এ লেখা লিখছি ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে। এ পাঁচ মাসে আচরণে, উচ্চারণে তারা নিজেদের এক ধরনের রাগি যুবকদের আসনে বসিয়েছিলেন। তারা নিজেদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মী হিসাবে পরিচিত করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণাসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষমাত্রই জানেন, বৈষম্যবিরোধী লড়াই অনেক ব্যাপক অর্থ বহন করে। পৃথিবী কাঁপানো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কমিউনিজমের নামে পরিচিত। এ যুবকরা কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ নয়। বৈষম্য যে কত ব্যাপকভাবে এ সমাজ ও রাষ্ট্রের আনাচে-কানাচে ঘুণপোকার মতো বসে আছে, সে সম্পর্কে কি তারা সম্যক অবহিত? বৈষম্যসমূহ দূর করার প্রক্রিয়া-পদ্ধতি কী, সেটা সম্পর্কেও তাদের জানা আছে কতখানি।

৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকেই সারা দেশে চাকরিরত কর্মচারী-কর্মকর্তারা তাদের পেশাগত ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে বেতনভাতার ক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্য বিদ্যমান। উপার্জন এবং জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে বৈষম্য যে কী রকম দাঁত বের করে জীবন ও জীবিকাকে উপহাস করতে থাকে, তা আমরা সবাই জানি। এসব ব্যাপারে না সরকার, না সরকারে থাকা উপদেষ্টারা কোনো কথা বলেছেন।

ডিসেম্বরে একেবারে শেষের দিকে এসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা হঠাৎ করে ঘোষণা দেন, তারা ৩১ ডিসেম্বর জাতীয় শহিদ মিনারে এক সমাবেশের মাধ্যমে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন দেবেন। এতদিন ধরে এত বড় একটি অভ্যুত্থানের কোনো প্রোক্লেমেশন দেওয়া হয়নি, সেজন্য তারা সরকারকে সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। সরকার প্রমাদ গোনে। ৫ আগস্টের পর থেকে এটি দৃশ্যমান হচ্ছিল যে, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রনেতারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। এটি এতদূর যে, খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এক হিসাবে এ শিক্ষার্থীরাই তার নিয়োগকর্তা। ড. ইউনূস এ কথা বলে ভালো করেছেন কী খারাপ করেছেন, সে আলোচনার মধ্যে এখন যাচ্ছি না। কিন্তু ধীরে ধীরে ছাত্রনেতাদের শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং মাঝেমধ্যে সরাসরি সরকারের বিরোধিতা করতে আমরা দেখেছি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা সম্ভবত এটিও মনে করতে থাকেন, ৮ আগস্ট বিপ্লবী সরকার গঠন না করে তারা ভুল করেছেন। তারা হয়তো এমনও মনে করেন, এখনো সেই বৈপ্লবিক পরিস্থিতি আছে এবং তারা সেভাবে একটি সরকার গঠন করতে পারেন। কিংবা হয়তো এ সরকারকেও বিপ্লবী কায়দায় পরিচালনা করতে পারেন। আমি আগেও বলেছি, তারা নিশ্চয়ই ধ্রুপদি কায়দায় বিপ্লবকে ভাবেন না। এ ছাত্রনেতারা কিংবা তারা যে সংগঠনটি গঠন করতে যাচ্ছেন-জাতীয় নাগরিক কমিটি-তার নেতারা এখন পর্যন্ত তাদের রাজনৈতিক বয়ান কিংবা তারা আগামী দিনের দেশ ও রাজনীতি নিয়ে যেরকম করে ভাবেন তার ব্যাখ্যা দেননি। তারা প্রায় একপাক্ষিকভাবে কিছু কথা বলেছেন, (যেমন, এই সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিতে হবে...ইত্যাদি। তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনা সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানতে পারি, সেটা তাদের প্রোক্লেমেশন থেকে, যা তারা এ ঐক্য মার্চের আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছিলেন), যা নিয়ে কখনো কোনো বিতর্ক হয়নি।

৩১ ডিসেম্বর একটি প্রোক্লেমেশন দেওয়ার বিষয়টিও সেরকম বলেই প্রতিভাত হয়। কারণ তাদের এ ঘোষণার পর সরকারকে বলতে শোনা যায়, ঘোষণা তারাই দেবেন। দু-একদিন পরেই একজন শিক্ষার্থী উপদেষ্টা বলেন, সরকার কোনো প্রোক্লেমেশন দেবে না। সরকার সবক’টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করার চেষ্টা করবে। এ কথার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ৩১ ডিসেম্বর তাদের কর্মসূচির নাম পরিবর্তন করে এটাকে একটা ঐক্যযাত্রা বলে অভিহিত করেন।

একটু আগে আমি এ শিক্ষার্থী ও যুবকদের রাগি যুবক বলে অভিহিত করেছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে গত ৫৩ বছর যা চলেছে, তাতে রক্ত টগবগ করা যুবকদের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এ-ও ঠিক, কেবল রাগ করে এতগুলো বছরে জমে ওঠা সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এর জন্য দরকার ধৈর্য, সহ্য ও জ্ঞানচর্চা। কিন্তু এ যুবকরা রক্তঝরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার মতো অসম্ভব এক কাজ করার পর নিজেদেরকে বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারেনি।

ঐক্যযাত্রার আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে একটি খসড়া ড্রাফট প্রেরণ করেন। এ ড্রাফটটি তাদের প্রোক্লেমেশন বলে বিবেচিত হয়। এ ড্রাফটে তারা বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদ, অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের মতামত, প্রত্যাশাকে প্রতিফলন করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ করার পথ সুগম করেছিল।

ড্রাফটের শেষের দিকে তারা বলেন, আমরা এ ঘোষণা প্রদান করিলাম যে, ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সব ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবে এবং এদেশে তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। তারা এ অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেন যে, এ ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং এ ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল থেকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা হবে এবং সমঝোতার ভিত্তিতে একটি প্রোক্লেমেশন দেওয়া হবে। কেমন হলো ব্যাপারটা? প্রোক্লেমেশন সাধারণত তারাই দেয়, যারা পরিবর্তনের মূল চরিত্রে থাকে; অর্থাৎ আন্দোলনে যারা নেতৃত্বে থাকে। নিশ্চয়ই প্রফেসর ইউনূসসহ যারা এ অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন, তারা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন না। ছাত্ররা ছিলেন। তাদেরসহ সরকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রোক্লেমেশন দেয়, তবে সেটা গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। সে ঐক্য কী হবে? ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা যতই জাতীয় ঐক্যের কথা বলি না কেন, ড. ইউনূস যতবারই সব রাজনৈতিক দলের বৈঠক ডাকুন না কেন, ঐক্য তো বাড়েনি, বরং দূরত্ব বেড়েছে।

প্রোক্লেমেশন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকেছিলেন, তখন বিএনপির পক্ষ থেকে একজন মাত্র গিয়েছিলেন। এটি না যাওয়ার মতো। তিনি আবার বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদের পতনের পর পাঁচ মাস হয়ে গেছে, ভাবতে হবে এখন কি আর প্রোক্লেশনের কোনো কার্যকারিতা আছে। আর বিবিসির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে দলের মহাসচিব স্পষ্ট করেই বলেছেন, পাঁচ মাস পর এখন আর নতুন করে প্রোক্লেমেশনের কোনো দরকার নেই। প্রফেসর ইউনূস তো আগেই বলেছেন, সংস্কারসহ যেসব ব্যাপারে ঐকমত্য হবে, কেবল সেসব ব্যাপারেই কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

২৩ জানুয়ারি বিবিসিকে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অনেক ব্যাপারে এ সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই, বিএনপি দলগতভাবে নির্বাচনে আগ্রহী। তারা মনে করে, নির্বাচন হলে তারা জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যেতে পারবে। সেই দলের মহাসচিব ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নির্বাচনের বিরোধিতা করে একটি ১/১১-এর মতো ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করবেন, এরকম ভাবনা অবিশ্বাস্য। কিন্তু মাননীয় তথ্য উপদেষ্টা তার বক্তব্যে এ ধরনের একটি বিষয়ের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন। ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। ৫ আগস্টের বিজয়ের পর এখন প্রশ্ন নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার। আর এজন্য প্রয়োজন ‘ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য’ গড়ে তোলা। ভিন্নতা বলছি এ কারণে যে, আমাদের অবশ্যই নির্বাচনে যেতে হবে; সেটা দলগতভাবে হোক কিংবা জোটগতভাবে। যেহেতু আলাদা আলাদা দল বা জোট; মতপার্থক্য তো থাকবেই। কিন্তু মতপার্থক্য সত্ত্বেও দেশের অগ্রগতি ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে একটা ঐক্যের জায়গাও থাকবে, থাকতে হবে। এটি যদি না থাকে, তাহলে বিশাল বিপর্যয় হতে পারে। তাহরির স্কয়ারের অভ্যুত্থানের পর মিসর তার প্রমাণ। শুধু ভেদাভেদ আর হানাহানির কারণে সেই দেশের গণতন্ত্র শেষ; অগ্রগতিও শেষ। আর তারই পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে সংঘটিত বিপ্লবের পর বহু ধরনের ভিন্নতা সত্ত্বেও ঐক্য প্রচেষ্টার কারণে অগ্রগতির পথে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে তিউনিসিয়া।

মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম