বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টাসে’ বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছে। সংস্থাটি বলেছে, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বেশকিছু জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখীপ্রবণতা দেশটির অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলতে পারে।
সংস্থাটি বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি পূর্ববর্তী প্রক্ষেপণের চেয়ে কিছুটা কম হতে পারে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা জুন মাসে দেওয়া সংস্থাটির প্রাক্কলনের চেয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ কম এবং আগের অর্থবছরে অর্জিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ কম।
সংস্থাটি আরও বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে এবং বছর শেষে তা ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান রয়েছে। একইসঙ্গে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা বিরাজমান রয়েছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন ও ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে তিনটি সমস্যা জটিলতার সৃষ্টি করে চলেছে, তার মধ্যে রয়েছে-উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার বাড়ানো এবং উচ্চ মাত্রায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। ফলে আগামীতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।
একটি দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হলেও তেমন কোনো সমস্যা হয় না, যদি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মূল্যস্ফীতির হারের সমান তালে বা বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক উলটোটিই ঘটছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের গড় ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা। গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মজুরির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম গতিতে। একটি দেশের স্থিতিশীল এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রোডাক্টিভ সেক্টরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি খুবই প্রয়োজন। কারণ এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে দেশ প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে পারে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করি; কিন্তু সেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি আশঙ্কাকে প্রশমিত করার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, সে সম্পর্কে আমরা খুব একটা সচেতন নই। আমাদের দেশে সাধারণত আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমেও যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে সম্পর্কে খুব একটা ভাবছি না। দেশ যদি আমদানিনির্ভরতা কমাতে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেল না হ্রাস পেল, তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তাই আমাদের স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধি করে চলেছে। আগে যেখানে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ, এখন তা ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ব্যাংকের ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করার ফলে পলিসি রেট বৃদ্ধির প্রভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। উচ্চ সুদ হারের কারণে উদ্যোক্তাদের অনেকেই তাদের প্রত্যাশা মতো ব্যাংক ঋণ নিয়ে মূলধন গঠন করতে পারছেন না। এতে কল-কারখানা বন্ধের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত রয়েছেন। ফলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ধস নেমেছে। শুধু স্থানীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই যে ধস নেমেছে, তা নয়। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের পরিমাণও উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে; এটি কোনোভাবেই অর্জনযোগ্য নয়।
আমাদের মতো একটি উন্নয়নকামী দেশের জন্য কেমন বিনিয়োগ প্রয়োজন বা কোন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা বেশি আবশ্যক, তা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায়, অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্য থাক আর না-ই থাক, তারা বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে চান। এজন্য নানাভাবে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ অনুমোদনের সময় ধরে নেয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনে চলে যেতে পারবে। তাই এ ছয় মাসকে তারা আইডিসিপি (ইন্টারেস্ট ডিউরিং কনস্ট্রাকশন পিরিয়ড) হিসাবে বিবেচনা করে তুলনামূলক কম সুদ আরোপ করে। কিন্তু বাংলাদেশে পদ্ধতিগত জটিলতা এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরে ব্যাপক দুনীতির কারণে একটি প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যেতে কম পক্ষে দেড়-দুই বছর সময় প্রয়োজন হয়। ব্যাংক ছয় মাস পর থেকেই স্বাভাবিক নিয়মে সুদ হার আরোপ করতে থাকে। ফলে একটি কোম্পানি বাস্তবায়িত হয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার আগেই বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বড় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা প্রয়োজন। কেউ যদি ক্ষুদ্র শিল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলে তার ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল; কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। বাংলাদেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান মাত্র ২৮ শতাংশ। এটি সরকারি হিসাব। বাস্তবে এ অবদান আরও কম। কিন্তু আমাদের কাছে প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান অনেক বেশি। পাকিস্তানের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৪০ শতাংশ। ভারতের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৩৭ শতাংশ, শ্রীলংকায় ৫২ শতাংশ, চীনে ৬০ শতাংশ।
দেশের ব্যাংক খাত এসএমই খাতের উন্নয়নে তেমন একটা অবদান রাখতে পারছে না। কয়েক বছর আগে তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোগকে বিকশিত করার জন্য কৃষি ও পল্লি ঋণ নামে বিশেষ এক ধরনের ঋণদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এ খাতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গ্রামীণ এলাকায় আগ্রহী উদ্যোক্তাদের প্রচলিত ব্যাংক ঋণের সুদের চেয়ে এক শতাংশ কম সুদে ঋণদান করা হয়। যেমন প্রচলিত ঋণের সুদের হার যদি ১৫ শতাংশ হয়, তাহলে কৃষি ও পল্লি ঋণের সুদের হার হবে ১৪ শতাংশ। কিন্তু পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে এ ঋণ সুবিধা তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তারা সেভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না। ব্যাংকগুলো এ ঋণ ইচ্ছে করলে এনজিও লিঙ্কেজেও বিতরণ করতে পারে। ব্যাংক যদি এনজিও লিঙ্কেজে কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণ করে, তাহলে প্রচলিত সুদ হারের চেয়ে এক শতাংশ কম সুদ চার্জ করবে। আর এনজিওরা এ ঋণের অর্থ তৃণমূল পর্যায়ে বিতরণকালে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) নির্ধারিত সুদ হার আরোপ করবে। এমআরএ নির্ধারিত সর্বনিম্ন সুদ হার হচ্ছে ২৪ শতাংশ। এ পদ্ধতির কারণে ব্যাংক লাভবান হচ্ছে। কারণ তারা কম পরিশ্রমে ঋণ বিতরণের টার্গেট পূরণ করতে পারছে। এনজিওরা প্রচলিত ব্যাংক ঋণের সুদের হারের চেয়ে কম সুদে ঋণ নিতে পারছে। কিন্তু টার্গেট গ্রুপ অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বর্তমানে ব্যাংকগুলো তাদের টার্গেটকৃত কৃষি ও পল্লি ঋণের ৫০ শতাংশ এনজিও লিঙ্কেজে বিতরণ করতে পারে। এটি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহৃত হওয়া প্রয়োজন।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার