জনবান্ধব সরকার : জাতির প্রত্যাশা
ড. আলী রেজা
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারকে সাদরে গ্রহণ করার একটি প্রধান কারণ হলো, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা ও চরম দলীয়করণের রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল। পরপর তিনটি নির্বাচনে ভোটাধিকার খর্ব হওয়ায় জনগণ হতাশ হয়ে পড়েছিল।
বিরোধী দলগুলোর প্রতি দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক হয়রানি সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। আগামী নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাবে-এ আশা থেকেও তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে। সরকারকে সাদরে গ্রহণ করার আর একটি কারণ হলো, এ সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন গ্লোবাল সেলিব্রিটি। একজন প্রভাবশালী নোবেল লরিয়েটকে সরকারপ্রধান হিসাবে পেয়ে দেশের মানুষ সত্যি গৌরববোধ করছে। রাজনৈতিক দলগুলো শুরু থেকেই এ সরকারকে গ্রহণ করেছে। মত-ভিন্নমত সত্ত্বেও তারা বলছে, এ সরকার জনগণের সরকার।
এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু সরকার কি নিজে নিজেই ক্রমে ব্যর্থতার দিকে যাচ্ছে? সম্প্রতি এ সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ জনগণকে হতাশ করেছে। নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও রাজনৈতিক দল, দলের সমর্থক, এমনকি সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাচ্ছে না। এক ধরনের আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস ক্রমেই মানুষের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। সরকার যতই যথাসময়ে নির্বাচনের কথা বলুক না কেন-মানুষের মনের ধোঁয়াশা কাটছে না।
এর একটি প্রধান কারণ হলো, নির্বাচনের আগে সরকার যেসব সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছে এবং সেগুলো যে প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে চাচ্ছে, তাতে বেশ সময়ের প্রয়োজন। জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্রসহ সরকারের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ চলে আসছে। সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে সব সময়ই এক ধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ থাকায় নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে। একদিকে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করা, অন্যদিকে সংস্কার কাজের পরিধি বাড়ানো থেকে এ অস্পষ্টতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ বাস্তবতায় সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে স্ববিরোধিতা খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকেই। শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, ক্রমেই তারা সে অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। সরকার যতই জাতীয় ঐক্যের কথা বলুক না কেন-প্রকৃতপক্ষে সংস্কার, ঘোষণাপত্র ও বিভিন্ন সাংবিধানিক ইস্যুতে অনৈক্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে।
আসলে সরকার কী করতে চায়, তা নিয়েই রয়েছে নানা অস্পষ্টতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক সমন্বয়ক এখন প্রকাশ্যেই সরকারের সমালোচনা করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতেই একটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ পেশ করা শুরু করেছে। এ সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। সেক্ষেত্রে বিতর্ক নিরসনের জন্য যতই আলোচনা করা হোক না কেন-ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন হবে।
কারণ সবাই নিজ নিজ যৌক্তিক অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করবে। কিছু কিছু সাংবিধানিক বিষয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে। গণভোট অনুষ্ঠানের পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়ে যায়, তাহলে সরকার ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে।
বর্তমান সরকার নিজেই কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে গেছে? উত্তর সদর্থক হলে সরকার চরম বেকায়দায় আছে বলা যায়। ছাত্র-জনতা অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এ সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সাধারণ মানুষ আশা করেছিল, এ সরকার জনদুর্ভোগ দূর করবে। যেহেতু এ সরকার নির্দলীয়, তাই দেশে কোনো দলবাজি থাকবে না; কিন্তু মানুষের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনদুর্ভোগ আগের পর্যায়ে চলে এসেছে, দ্রব্যমূল্য কমেনি, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙেনি, চাঁদাবাজি চলছেই। সরকারি অফিসে ঘুস-দুর্নীতিও বন্ধ হয়নি। প্রতিনিয়ত যানজটে নাকাল হচ্ছে শহরের মানুষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। দলবাজি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সরকার ১০০ পণ্যের ওপর ভ্যাট দ্বিগুণ করেছে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। এসবের কোনোটাই জনবান্ধব বিষয় নয়। এসব ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের বক্তৃতা-বিবৃতিও এখন খুব একটা শোনা যায় না। কিছু কিছু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা খুব বেশি নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন বলে মনে হয়। কে নিয়ন্ত্রণ করছেন, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাহলে কি ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ সেটাই বা বলি কেমন করে।
শুধু ব্যক্তি নয়, বিধিব্যবস্থার সংস্কার বা পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। দাপ্তরিক বিধিব্যবস্থার সংস্কার আর সাংবিধানিক সংস্কার এক কথা নয়। সরকারের মূল লক্ষ্য যেহেতু নির্বাচন, সেহেতু নির্বাচনি বিধিব্যবস্থার সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু কিছু দাপ্তরিক সংস্কারের মধ্যে এর পরিধি সীমিত রাখলে সরকার পরিচালনা সহজ হতো। সাংবিধানিক মূলনীতি বা বিধিব্যবস্থা সংস্কার বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জাতীয় বিতর্ক সৃষ্টি হবেই। অযথা এ ধরনের বিতর্ক রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। মত ও ভিন্নমতের মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
এ সরকারকে জনগণের সরকার বলা হলেও, জনগণ কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেই আছে এবং থাকবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ বানানো ঠিক হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সমর্থক নিয়ে মাঠে নেমে এলে সরকার অতিদ্রুত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সংস্কার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। নির্বাচিত সরকার এসে যে কোনো সংস্কার বাতিল করে দিতে পারে।
তাই সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ বানানো অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সমীচীন হবে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সীমিত সংস্কারের পথে হাঁটলেই একটি রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী, এ সরকারে যারা আছেন, তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল।
অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের সফলতা বা ব্যর্থতা বিচার্য বিষয় নয়। তারা এসেছেন অন্তর্বর্তীকালে দায়িত্ব পালন করার জন্য। জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী দেশ পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ কাজ একাডেমিশিয়ান বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে সফলভাবে পরিচালিত নাও হতে পারে। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি ভালোভাবে কৃষিকাজ করতে না পারে, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তেমনি একজন কৃষক যদি রোগী দেখতে না পারে, তাহলেও তাকে দোষ দেওয়া যায় না। বর্তমান সরকার অরাজনৈতিক সরকার। এ সরকার রাজনৈতিকভাবে সফল হলে সেটা জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছে। একটি অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সে সংগ্রামের সফল পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে দেশের সাধারণ মানুষ। দেশের মানুষ চাইলে নির্বাচিত সরকার এসে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সাংবিধানিক সংস্কার করতে পারবে। অন্তর্বর্তী সরকার সব বিষয়ে সংস্কার করতে বাধ্য নয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, ঘুস-দুর্নীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দিন দিন ব্যর্থতার বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে। তাই জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক। নির্বাচনের আগে সরকারকে আরও বেশি জনবান্ধব হয়ে ওঠা জরুরি।
ড. আলী রেজা : সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, টাঙ্গাইল