ট্রাম্পের শপথ : শান্তি কত দূরে

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সদ্যই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার ক্ষমতাগ্রহণের ফলে বিশ্বে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে চলেছে, সেদিকে তাকিয়ে বিশ্ববাসী। আমরাও তাকিয়ে আছি। বিশেষত, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় ফেরার ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তাগিদ থাকবে কিনা, সে প্রশ্নও অনেকের। জুলাই বিপ্লবের পর আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা চাচ্ছিল। সেই কারণে আমার মনে হয় রিপাবলিকান পার্টি বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পার্টির একটা তাগিদ থাকবে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে। এছাড়া ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার চেষ্টা করবেন। এ কারণে হয়তো আমরা যে উৎসাহটা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের ব্যাপারে, সেটায় ভাটা পড়বে বা অতটা উৎসাহ থাকবে না। তার (ডোনাল্ড ট্রাম্প) প্রশাসন হয়তো চাইবে ভারত ও রাশিয়ার মতো বড় দেশগুলোর বিষয়ে ব্যস্ত থাকতে। সেই জায়গায় হয়তো বাংলাদেশ যে মনোযোগটা চেয়েছিল, সেটা নাও পেতে পারে। তাই আমাদের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সেটা এখনই বলা মুশকিল।
তবে বাংলাদেশের ব্যাপারে আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাড়াতাড়ি রোডম্যাপ দেখতে চাইবে বা কবে বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার হতে যাচ্ছে, তা জানতে চাইবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যথেষ্ট সমালোচনা ছিল। আমি মনে করি, ট্রাম্প প্রশাসন সেই বিষয়টা সামনে আনবে না, বরং তার চেষ্টা থাকবে একটা অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে। এখন অপেক্ষা করতে হবে, তেমনটি (ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন) হলে তার কী প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর ওপর পড়বে।
এদিকে বৈশ্বিক ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবী একটা মাল্টিপোলার বা বহুমেরুকেন্দ্রের দিকে যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব আগে যেভাবে আধিপত্য ধরে রাখতে পারত, সেটা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। যেমন, ইউক্রেনের ব্যাপারে তাদের চিন্তাভাবনা ছিল, যুদ্ধের মাধ্যমেই রাশিয়াকে জব্দ কিংবা কাবু করা যাবে; কিন্তু সেটা তো হয়ইনি, বরং রাশিয়া আরও শক্তিশালী হয়ে গেছে। প্রথমদিকে বাইডেন প্রশাসন হয়তো চিন্তা করেছিল পুরো পৃথিবী তার সঙ্গে থাকবে; কিন্তু আমরা দেখলাম, সেখানে বড় ধরনের একটা সম্পর্ক রাশিয়া স্থাপন করতে পেরেছে চীন ও ভারতের সঙ্গে। এ তিনটি দেশ যখন একসঙ্গে থাকল ইউক্রেন যুদ্ধের সময়, তখন বোঝা গেল, পৃথিবীটাও আর ইউনিপোলার বা একমেরুকেন্দ্রিক থাকছে না। যেটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর বলতে গেলে হয়ে গিয়েছিল, সেটা এখন মাল্টিপোলারের দিকে চলে গেছে।
আমরা আরও কতগুলো পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি। যেমন, ইরানে ক্ষমতার একটা নতুন কাঠামো তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে। ইসরাইল যদিও বলতে গেলে শুরু থেকেই হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতির সঙ্গে লড়াই করছিল; কিন্তু দেখা গেল ইরানকেও সেখানে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে। বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে একটা যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যেও হতে দেখলাম। বোঝাই গেল, ইরানও আগের অবস্থানে নেই। এ দেশটিও একটা শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করতে পেরেছে। এরই মধ্যে আবার সিরিয়াতেও আমরা দেখলাম ক্ষমতার পালাবদল হতে। যদিও কেউ কেউ মনে করছে, এতে পশ্চিমাদের ও ইসরাইলের লাভ হয়েছে। আবার কেউ মনে করছে, তা নয়, বরং ভবিষ্যতে এতে ইসরাইলের লোকসানই হবে। কারণ, আসাদের যে সিরিয়া ছিল, সেটা আসলে ইসরাইলকেই বলতে গেলে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল পরোক্ষভাবে।
বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে বলা যেতে পারে, যেহেতু আমেরিকা পরাশক্তি, সেহেতু দেশটির ক্ষমতার পালাবদল বিশ্বে কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টি যে ম্যান্ডেটটা পেয়েছেন, সে ম্যান্ডেটটা বিশাল। গত ১২৮ বছরে আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট এত বড় ম্যান্ডেট পায়নি। তারা শুধু যে ইলেক্টোরাল ভোটে জিতেছে, তা নয়। পপুলার ভোটও তারা পেয়েছে; হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ, এমনকি সিনেটেও দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। জুডিশিয়ারিতেও দেখা গেছে রিপাবলিকানদের আধিপত্য। এরপর যেসব সুইং স্টেট রয়েছে, যে রাজ্যগুলোর নির্বাচনি ফলাফলে একটা ব্যালেন্স অতীতে থাকতে আমরা দেখেছি, সেখানেও দেখা গেল সবই রিপাবলিকানদের হয়ে গেল। তো এই যে বিশাল ম্যান্ডেট ১২৮ বছর পর পেলেন একজন প্রেসিডেন্ট, এতে বোঝাই যাচ্ছে, আমেরিকার জনগণ বড় আকারে একটা পরিবর্তন চাইছে। মূলত তারা শান্তিই চাইছে, তারাও যুদ্ধের মধ্যে থাকতে চাইছে না। কারণ নির্বাচনি প্রচারণার সময় ট্রাম্প বড় আকারেই বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে তার অবস্থানটা খুবই স্পষ্ট করেছেন। যদিও গাজার যুদ্ধের ব্যাপারে তার অবস্থান তখনো বোঝা যায়নি; কিন্তু ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে তার অবস্থান বেশ স্পষ্ট ছিল।
এক্ষেত্রে বলতেই হচ্ছে, সম্প্রতি গাজায় যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হলো, তা ট্রাম্পের সদিচ্ছারই ফল। বিশেষত যে চুক্তিটির প্রথম ধাপ কার্যকর হয়েছে, তা ৬ মাস আগেই তৈরি হয়েছিল; কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের ইচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছিল। আমরা দেখতে পেলাম, শপথ নেওয়ার আগেই ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এ যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে। একে বড় ধরনের ঐতিহাসিক চুক্তি তো বলা চলেই। অনেকে ভাবতেও পারেননি যে, এত তাড়াতাড়ি এ চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। এরই মধ্যে চুক্তি মোতাবেক বন্দিবিনিময় হতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ থেকে বোঝাই যাচ্ছে, শুধু ইউক্রেন ইস্যুতেই নয়, গাজার যুদ্ধ বন্ধেও তিনি আন্তরিক।
উল্লেখ্য, গাজায় যে গণহত্যা চলেছে, মার্কিন নির্বাচনে সেটার প্রভাব পড়েছে দুভাবে। একটা হলো, যে প্রযুক্তি এসেছে, বিশেষ করে টিকটক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমেরিকাসহ গোটা পৃথিবী প্রথমবারের মতো যুদ্ধের নামে একটা জেনোসাইড সরাসরি দেখতে পেয়েছে। পৃথিবীর মানুষ এর আগে কখনো এমন জেনোসাইড সরাসরি দেখতে পায়নি। এটা আমেরিকার তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা বিশাল প্রভাব ফেলেছে। এবং যে সুইং স্টেটগুলোর কথা বলেছিলাম, দেশটির নির্বাচনে যারা কম বয়সি ভোটার, তারা হয় ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ভোট দেয়নি বা ভোটদান থেকে বিরত ছিল, নয়তো তারা সরাসরি রিপাবলিকানদের ভোট দিয়েছে। যেটা আগে এত বড় আকারে দেখা যায়নি। এবং আমরা এটাও দেখেছি, দেশটির শ্রমিক শ্রেণিও বড় আকারে রিপাবলিকানদের সমর্থন করেছে। এটাও একটা বড় পরিবর্তন। কারণ এই শ্রমিক শ্রেণির অনেকেই মূলত ডেমোক্রেটিক পার্টিকেই সমর্থন দিয়ে আসত। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, ডেমোক্রেটিক পার্টির বড় আকারে একটা এলিট পার্টিতে রূপান্তর ঘটতে।
আমরা এটাও দেখেছি, আমেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যেগুলোতে এলিট শ্রেণির সন্তানরাও পড়াশোনা করে, তারা যুদ্ধের নামে গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। এ তরুণরা যেভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমালোচনা করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল, তাতে বোঝা গিয়েছিল, জনগণ ম্যান্ডেটটা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়েছে মূলত শান্তির আকাঙ্ক্ষায়। এখন দেখা দরকার, এই ম্যান্ডেট ট্রাম্প কাজে লাগাতে পারেন কিনা।
শপথের পর প্রথম দুবছর বলতে গেলে পুরো ক্ষমতাই তার কাছে থাকবে (মিড টার্ম নির্বাচনের আগে পর্যন্ত)। এখন প্রথম দুবছরের জন্য শান্তির যে ম্যান্ডেটটা আমেরিকার জনগণ দিয়েছে, সেটা তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন কিনা, তা দেখার জন্য হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। যদিও একটা পুরোনো পৃথিবী চলে যাচ্ছে, নতুনটা এখনো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তারপরও আমরা আশা দেখতে পারছি। কেননা আমেরিকার জনগণও জেগে উঠেছে এবং সে কারণেই তারা রিপাবলিকান পার্টিকে সমর্থন দিয়েছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর এখন কতখানি শান্তি আসবে পৃথিবীতে, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ