জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে
এরশাদুল আলম
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিন দিন দেশে কার্যত ও আইনগত কোনো সরকার ছিল না। এ তিন দিনে দেশের কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা বেশ উদ্বেগজনক। দি ইকোনমিস্টের তালিকায় ২০২৪ সালে বর্ষসেরা দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু করার বিষয়টিই আমাদের ওই তালিকার শীর্ষে নিয়ে এসেছে। একটি সরকার পালিয়ে গেছে এবং তিন দিন কার্যত দেশে কোনো সরকার ছিল না; কিন্তু তারপরও দেশে আইনশৃঙ্খলা বজায় ছিল। বিষয়টি বহির্বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।
দীর্ঘ দেড় যুগ পর আমরা আবার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছি। এ যাত্রা অবশ্যই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বরং তা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়েই কঠিন। স্বৈরাচারে বিদায় পাঁচ মাসের বেশি হয়েছে। ৫ আগস্টের পর আরও কমপক্ষে তিন মাস দেশে পুলিশ বাহিনী কার্যকর হয়নি। দেশের বহু থানায় কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। পাঁচ মাস পর যদিও দেশের সব থানাই কাজ শুরু করেছে, কিন্তু পুলিশ এখনো আগের মতো কার্যকর হতে পারেনি। পুলিশের বেশিরভাগ সদস্যই কাজে যোগ দিয়েছে, হয়তো কিছু পুলিশ সদস্য এখনো যোগ দেয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় দেশে পুলিশের সংখ্যা এমনিতেই অনেক কম। এত কম সদস্য দিয়ে দেশের ২০ কোটি মানুষকে পুলিশ বাহিনী কীভাবে ম্যানেজ করে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। পুলিশের অনেক সমালোচনা থাকলেও এর জন্য তারা প্রশংসা পেতেই পারে।
ভোটারবিহীন নির্বাচনের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। পরপর তিন মেয়াদে সরকার ধীরে ধীরে জনগণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে সরকার টিকে থাকার জন্যই পুলিশের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আর পুলিশও সে সুযোগে একটি দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তাই পুলিশকে জনগণের ওপর এক ভিন্ন রূপে আমরা আবির্ভূত হতে দেখেছি। কিন্তু এতেও সরকারের শেষ রক্ষা হয়নি। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। পতনের পর কিছু কিছু জায়গায় পুলিশ প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। সব মিলিয়ে পুলিশের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এখন পুলিশের বল ও মনোবল দুটিই ফিরিয়ে আনতে হবে।
যে কোনো পেশাদার বাহিনীর মনোবলই আসল শক্তি। সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী অথবা অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলই এসব বাহিনীর মূল শক্তি। সব দেশের ক্ষেত্রেই এটি সত্য। যুদ্ধের ময়দানেও বিজয় সবসময় সৈন্য সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। বরং, যত বড় বাহিনীই হোক না কেন, মনোবল একবার ভেঙে গেলে কোনো বাহিনীর পক্ষেই যুদ্ধজয় সম্ভব নয়। পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রেও তাই। দেশের পুলিশ বাহিনীও মনোবল দিয়েই কাজ করে।
মনোবল দিয়েই বড় কিছু কাজ করা সম্ভব, অস্ত্র বা পেশিশক্তি দিয়ে নয়। আগস্টের পর পুলিশের সেই মনোবল ভেঙে গেছে। পুলিশ মাঠে থাকলেও তাদের সেই আগের মনোবল আর নেই। মাঠে তারা উপস্থিত আছে ঠিকই, কিন্তু কাজে তারা সেভাবে সক্রিয় নয়। এর জন্য তারা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নয়। বরং, পুরো বাহিনীর ভূমিকাই এজন্য দায়ী। বিশেষ করে বাহিনীর কিছু সিনিয়র সদস্যের অপেশাদারি ভূমিকা পুরো পুলিশ বাহিনীকে বিতর্কিত করেছে। সবশেষ অভ্যুত্থানের মতো একটি বিরাট ঘটনায় পুলিশের নেতিবাচক ভূমিকা, অংশগ্রহণ এবং ৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহই তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বিশ্বাস ও মনোবল একদিনে ফিরে আসে না। একটি ঘোষণা দিলেই সব পুলিশ সদস্যের মনোবল ফিরে আসবে বিষয়টি সেরকম নয়। আবার, পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য যে কিছু ইতিবাচক কার্যক্রম হাতে নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলোও নেওয়া হচ্ছে না। পুলিশ সপ্তাহ, পুলিশ মাসের মতো কিছু জরুরি কার্যক্রম হয়তো হাতে নেওয়া যেত। কিন্তু আমাদের হাতে সে সময়ও নেই। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দ্রুত মাঠে নামাই অগ্রাধিকার। মনোবল কিছু কম থাকলেও আগে তাদের মাঠে দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। মাঠে উপস্থিতিই এ সময়ে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। দেরিতে হলেও সরকার সেটি করতে পেরেছে।
সরকার পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ কমিশন তাদের সংস্কার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সরকার পুলিশের কিছু সংস্কার করতে চায়; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া কোনো সংস্কারই সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সংস্কারের বিষয়ে ইতিবাচক কোনো মনোভাব দৃশ্যমান নয়। প্রশাসনও সংস্কার প্রশ্নে ইতিবাচক বলে মনে হয় না।
সরকার চায় স্বাধীন পুলিশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রশাসন কি আদৌ চায় পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যাক, প্রশাসনের কব্জা থেকে পুলিশ স্বাধীন হয়ে যাক? সরকার বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে। পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার করতে পারলে অনেক কিছু আপনাআপনিই সংস্কার হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সংস্কারের ব্যাপারে জনগণ ঐকমত্যে থাকলেও সরকারের অভ্যন্তরে প্রশাসন ও সরকারের বাইরে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রশ্নে ইতিবাচক নয়। দেখা যাক, এ যাত্রায় কতটুকু সংস্কার আমাদের ভাগ্যে আছে।
তবে যতটুকুই সংস্কার হোক না কেন, দেশের পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করতে হবে। তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। পুলিশের লোকবলও বাড়াতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে পুলিশ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত করা প্রয়োজন। দেশে ১ লাখের বিপরীতে মাত্র ৩২ জন পুলিশ থাকা বাস্তবসম্মত নয়। ভারতে ১ লাখের বিপরীতে ১২৯ জন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গড়ে ২৩০ জন। ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ হলেও পুলিশের এ হার আমাদের বাড়াতেই হবে। পুলিশ শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই করে না, তারা মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা করে। রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার সব ক্ষেত্রেই তাদের অংশগ্রহণ আছে।
সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা লাগামছাড়া। টেম্পোস্ট্যান্ডের এক চাঁদাবাজ পালিয়েছে তো, আরেক চাঁদাবাজ হাজির। গণভবনের চাঁদাবাজ পালালেও পূর্তভবনের চাঁদাবাজরা বহাল তবিয়তেই আছে। বাস্তব কারণে পুলিশের ভাগবাঁটোয়ারা হয়তো কিছুটা কমে গেছে; কিন্তু টেম্পোওয়ালাকে ঠিকই ১০ টাকা গুনতে হচ্ছে। সরকারি স্থাপনায় দলীয় চাঁদাবাজি আজও বন্ধ হয়নি। এলাকায় চাঁদাবাজি আর ঢাকায় ছিনতাই ফিরে এসেছে আগের মতোই। বরং ঢাকায় ছিনতাই কিছুটা বেড়েছে। এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতেই হবে। ওদের আইনের আওতায় আনতে হবে, না হলে ভবিষ্যতে ওদের লাগামটানা কঠিন হবে। পুলিশ অনেককে গ্রেফতার করছে বটে; তবে গ্রেফতার বাণিজ্য কিছুটা কম চলছে হয়তো, তাই গ্রেফতারেও যেন এক ধরনের অনীহা লক্ষণীয়। মামলা তদন্তে অগ্রগতি আরও কম। থানায় জিডি করলেও সাড়া পাওয়া যায় না। ঘুস বা বখরাই যদি হয় মনোবল বাড়ানোর একমাত্র পথ্য, তবে সেখানে কীসের সংস্কার আর কীসের কী?
জনগণ একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী চায়। তারা পুলিশকে সহায়তাও করতে চায়। অভ্যুত্থানের পর আমরা দেখেছি কীভাবে দেশের শিক্ষার্থীরা পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে তাদের সহায়তা করেছে। তাদের যতটুকু সামর্থ্য ছিল, তা দিয়েই সাহায্য করেছে। এর চেয়ে বেশি সক্ষমতা তাদের নেই। তাদের সক্ষমতা ছিল সড়ক ঠিক করার, তা-ই করেছে। সক্ষমতা ছিল জীবন দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে দেশ থেকে স্বৈরাচার উৎখাতের। তা-ই করেছে। কিন্তু ওরা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা নয় যে, এক ফুঁ’তে দেশের সব ইঁদুর তাড়িয়ে বুড়িগঙ্গায় ডোবাবে।
পুলিশকেও এগিয়ে আসতে হবে। দ্রুত হাল ধরতে হবে। আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে। টহল বাড়াতে হবে। এটি পুলিশেরই কাজ। পুলিশের পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও আছে। তারাও কাজ করছে। কিন্তু পুলিশের কাজে তারা অভিজ্ঞ নয়। এটি সেনাপ্রধানও বলেছেন। সেনাবাহিনী জরুরি প্রয়োজনে এগিয়ে আসছে। তারা মূলত পুলিশের সহযোগী হিসাবে কাজ করছে। পুলিশের কাজ পুলিশকেই বুঝে নিতে হবে। পুলিশকে তাই দ্রুত সক্রিয় হতে হবে।
স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা ছাড়া জনমনে শান্তি আসে না। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বই বেশি। তাদের ঐকমত্য জনগণ বড় বেশি করে চায়; অন্তত এ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর বাদানুবাদে মানুষ হতাশ। বুকের ওপর থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর চেপে থাকা জগদ্দল পাথর নেমে গেছে; আবু সাঈদরা নামিয়েছেন-অথচ রাজনৈতিক দলগুলো কত তুচ্ছ বিষয়ে কঠোর। তারা সংস্কারের চেয়ে নির্বাচন কাল না পরশু, সেটা নিয়ে মাঠ গরম করছে। অথচ গত ১৫ বছরে কীসের নির্বাচন আর কীসের কী! আমরা যেন সেসব ভুলে গেছি। অনেক দলের অনেক নেতা বাড়ির রাস্তাও ভুলে গিয়েছিলেন। অথচ এখন তারা কত দ্রুত গণভবনের দরবার হলে যাবেন, তা নিয়ে ঠেলাঠেলিতে লিপ্ত। এগুলো জাতিকে হতাশ করে।
এরশাদুল আলম : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক