Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশ কি কাগজেই থাকবে?

Icon

এম এ হালিম

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর হাজারীবাগে ফিনিক্স লেদার কমপ্লেক্সে অগ্নিদুর্ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও ভবনের একজন মালিক জাহাঙ্গীর আলমেরই দেড় কোটি টাকার মেশিনারিজ পুড়ে গেছে (যুগান্তর)। আগের দিন (বৃহস্পতিবার) কক্সবাজারে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ৩০০ শেল্টার পুড়ে গেছে এবং এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ৬০০ শেল্টার পুড়ে যায়। প্রসঙ্গত, প্রতিবছরই শুষ্ক মৌসুমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একাধিক অগ্নিকাণ্ড এবং প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে, যার মধ্যে ২০২১ সালের ২২ মার্চ সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১ হাজারেরও অধিক ঘর পুড়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের (এফএসসিডি) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিদুর্ঘটনায় ১০২ জনের মৃত্যু ও ২৮১ জন আহত হওয়া ছাড়াও ৭৯২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুম অথবা পূর্ণাঙ্গ বৃষ্টিপাত শুরুর আগ পর্যন্ত এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। এফএসসিডির তথ্যমতে, গত ৭ বছরে ১ লাখ ৭৩ হাজার অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে এবং প্রায় ৩ হাজার মানুষের মৃত্য হয়েছে। তবে অনুমান করা যায়, এফএসসিডির এসব তথ্য তাদের নিজস্ব রেকর্ড অনুসারেই তৈরি। এর বাইরে প্রতিনিয়তই বাসাবাড়ি অথবা বিভিন্ন এলাকায় ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যা তারা নিজেরাই নিভিয়ে ফেলে বিধায় সেসব অগ্নিকাণ্ডের তথ্য এফএসসিডির রেকর্ডভুক্ত হয় না।

গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গত ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এ দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসাবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কথা বলা হলেও জনমনে প্রশ্ন রয়ে গেছে এটি নাশকতা কিনা। গত মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) মধ্যরাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে তিনটি রিসোর্ট পুড়ে গেছে। জানা যায়, দ্বীপটিতে নিজস্ব কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই, ফলে অগ্নিনির্বাপনের জন্য কোস্ট গার্ডের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। অথচ ২৩০টি ছোট-বড় হোটেল-রিসোর্ট এবং ২ সহস্রাধিক পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সেখানে স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা উচিত।

অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা গতানুগতিক। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং সবাই নড়েচড়ে বসে। পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমের কিছুদিন আলোচনা চলে। প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনার পরই দুর্ঘটনার শিকার ভবন বা প্রতিষ্ঠানের নকশা না মানা, নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় আসে; যেমন-হাজারীবাগ অগ্নিকাণ্ডের পর বলা হচ্ছে, ভবনটির কোনো নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না, ভবনটি আগেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে ঘোষণা করা হয় ইত্যাদি। একইভাবে যখনই কোথাও কোনো ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তখনই এসব অনিয়ম আলোচনায় আসে। তদন্ত কমিটিও তাদের পর্যবেক্ষণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করে। কিন্তু সময় গড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার সব আলোচনা ফিকে হয়ে যায়। গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিয়েছিল ৪৬ প্রাণ আর আহত হয়েছিল অনেক মানুষ। সেই দুর্ঘটনার পরও একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং অনেক সুপারিশ এসেছিল। কিন্তু এক বছর পার হতে চললেও সেসব সুপারিশের কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা জানা যায়নি। আমাদের মনে আছে, সে দুর্ঘটনার পর ঢাকাসহ সারা দেশেই রেস্টুরেন্টের অনুমোদন প্রক্রিয়াসহ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে অভিযান শুরু হয়। বন্ধ করা হয় অনেক রেস্টুরেন্ট। তবে শোনা যায়, পরে অনেক রেস্টুরেন্ট মালিকই ‘ম্যানেজ করে’ তাদের রেস্টুরেন্ট পুনরায় চালু করেছেন।

প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার কিছু মৌলিক কারণ উল্লেখ করে; যেমন-ভবন নির্মাণে ডিজাইন অনুসরণ না করা, বিল্ডিং কোডের বিচ্যুতি, বৈদ্যুতিক লাইনের ত্রুটি, হোটেল বা রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার, নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, জরুরি নির্গমন পথ না থাকা অথবা থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী ইত্যাদি। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ভবনে অবস্থিত কক্ষের অভ্যন্তরীণ ইন্টেরিয়র কাজে যেসব সামগ্রী ব্যবহার করা হয়, তা সহজ ও দ্রুত দাহ্য। যেমনটা সচিবালয় দুর্ঘটনার পরও প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও এ চিত্র অর্থাৎ সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ইন্টেরিয়জনিত কারণে ভবনের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি আজকাল মোটামুটি সব ভবনের জন্যই প্রযোজ্য।

ফায়ার সার্ভিসের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৪০ শতাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর ৭৬ শতাংশ মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের সবার জানা, বিভিন্ন ভবন বা প্রতিষ্ঠান মালিকদের ব্যয় সাশ্রয়ী প্রবণতা এবং সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যেমন-রাজউক, সিটি করপোরেশন অথবা পৌরসভা, স্থাপত্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সেবা অফিস (বিদ্যুৎ, গ্যাস) ইত্যাদি অফিসের দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কারণেই একটি ভবন ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মাণ করা হয় এবং সেখানে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলো অবহেলা করা হয়। জানা যায়, একটি রেস্টুরেন্ট চালু করতে ১৩ ধরনের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়। ধরেই নেওয়া যায়, সরকারি অফিসের জটিল ও দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে অনেকেই ‘ম্যানেজ করে’ দ্রুত এসব সার্টিফিকেট জোগাড় করেন। এসব বিষয়ে নিয়মিত মনিটর করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি থাকলেও তারাও ‘ম্যানেজড’ হন। দুর্ভাগ্যবশত, কোনো ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল ভবনের ত্রুটি সবার সামনে ধরা পড়ে। অথচ সরকারি সংস্থাগুলো এবং তাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ‘ম্যানেজ’ না হয়ে বরং যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলেই অফিস কিংবা ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এজন্য তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। এমনকি মনিটরিং কর্মকর্তা বদলি অথবা অবসরে গেলেও দায়িত্বে অবহেলার জন্য তাদের জবাবদিহিতার আওতায় রাখার পদ্ধতি থাকা উচিত। প্রসঙ্গত, অনেক অফিস বা ভবনেই অগ্নিনিরাপত্তা প্রটোকল রয়েছে। কিন্তু তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাগুজে অর্থাৎ ভবনের অধিবাসী অথবা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সে প্রটোকল সম্পর্কে অবহিত থাকেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভবনের বিকল্প সিঁড়ি ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। তাই এসব প্রটোকল সবাইকে জানানো এবং তা অনুসরণে সচেতনতা তৈরিতে প্রতিটি ভবনে বছরে অন্তত একবার অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করা উচিত। এসব প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধি হিসাবে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কমিশনারদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তবে তা যেন ‘ম্যানেজ সংস্কৃতির’ ধারায় নতুন কোনো অ্যাভিনিউ সৃষ্টি না করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

যে কোনো অগ্নিদুর্ঘটনার সঙ্গেই প্রাণহানিসহ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি জড়িত। এর সঙ্গে বাণিজ্যিক ভবনে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ফলে সেখানে কর্মরত মানুষের জীবিকায়নের পথ বন্ধ হয়। তাই দুর্ঘটনার পরে নয়, আগে থেকেই সতর্কতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। নিশ্চিত করতে হবে ভবন নির্মাণে আইন, বিধি ও নিয়মের কঠোর প্রতিপালন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মনিটরিং ও জবাবদিহিতা। আজকাল অগ্নিদুর্ঘটনার নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে যানবাহনের সিলিন্ডার এবং নৌযানে অগ্নিকাণ্ড। তাই সচেতনতা ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসাবে আমাদের মিডিয়াগুলোও অগ্নিঝুঁকি ও তা মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কিত প্রচারে ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণে সহযোগী শক্তি হিসাবে ফায়ার সার্ভিসের আরবান স্বেচ্ছাসেবক, রেড ক্রিসেন্ট যুব স্বেচ্ছাসেবক, স্কাউটস্, জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় জনগণের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

এম এ হালিম : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি; দুর্যোগ, জলবায়ু ও মানবিক বিষয়ক বিশ্লেষক

halim_64@hotmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম