Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মেজরিটি মানে টোটালিটি নয়

Icon

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মেজরিটি মানে টোটালিটি নয়

মযহারুল ইসলাম বাবলা। ছবি: সংগৃহীত

গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গণতন্ত্রের পরিধি অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপক। গণতন্ত্র অনিবার্য রূপে সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল শক্তিটা থাকে চর্চার ভেতরেই। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার অভাবে গণতন্ত্র আগাগোড়া ঝুঁকির কবলে ছিল এবং আছে, সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না। গণতন্ত্র আমাদের সামগ্রিক জীবনাচারে যেমন, তেমনি সামাজিক মূল্যবোধে, সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। তবে সমাজের ওপর যে রাষ্ট্র রয়েছে, সেই রাষ্ট্রের কর্তৃত্বেই সমাজ চলে। তাই রাষ্ট্রের ভূমিকাটা তাৎপর্যপূর্ণ বটে।

এছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে যদি গণতন্ত্রচর্চা সক্রিয় থাকে, তবে তা গণতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক হয়। কেননা রাজনৈতিক দলই জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। গণতন্ত্র ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকারকে স্বীকার করার পাশাপাশি সমষ্টিগত মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সমাজে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির দ্বন্দ্ব তৈরি হয় ব্যক্তির উন্নতি ও সমষ্টির অবনতির অসম ব্যবস্থার ফলে। গণতন্ত্র ব্যক্তির উন্নতির বিপরীতে সমষ্টিগত উন্নতি ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্র তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিপদাপন্ন হলে রাষ্ট্র ও সমাজে অগণতান্ত্রিকতার প্রকাশ ঘটে এবং চূড়ান্তে ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়, যেটি আমরা বিগত সরকারের শাসনামলে প্রত্যক্ষ করেছি।

বিশ্বের অসংখ্য দেশে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদকাল পাঁচ বছর। চার-পাঁচ বছর অতিক্রমের পর আবার নির্বাচনে জনরায়ে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ গ্রহণ করে। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের ফলে জনগণের প্রদানকৃত ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দল সরকার গঠনের সুযোগ পায়। প্রদানকৃত ভোট নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে বিভক্ত হওয়ার ফলে দেখা যায়, মোট প্রদানকৃত ভোটের ৩০-৩৫ শতাংশ পেয়ে এগিয়ে থাকা দলই বিজয়ী হিসাবে সরকার গঠন করে। বাকি ভোট বিভক্ত হওয়ার ফলে একচেটিয়াভাবে ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রদানকৃত ভোট অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে ভাগ হয়ে যে দল সর্বোচ্চ শতাংশ ভোট বা আসন লাভ করে, তাদেরই বিজয়ী হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের এটাই মাপকাঠি। তবে যে পরিমাণ ভোট পেয়ে সরকার গঠিত হয়, ওই ভোট বিভক্তিতে ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চয়। বিজয়ী দলের ভোটপ্রাপ্তি মোট ভোটের এক-তৃতীয়াংশের অধিক নয়। নির্বাচিত দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সম্পূর্ণ নয়। এই সত্যটা চাপা পড়ে যায় বিজয়ী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোয়ারে।

আমাদের দেশে নির্বাচনব্যবস্থাকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান অনুষঙ্গ হিসাবে ধরা হয়। সরকার গঠনের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় এটি অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা, এবং সাংবিধানিকও বটে। নির্বাচিত সরকারমাত্রই গণতান্ত্রিক সরকার, আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু সেটা বলে না। আমাদের অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে মোটেও গণতান্ত্রিকতার বার্তা দেয় না। দেশে একটি নির্বাচিত সরকারের সমান্তরাল একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের আবশ্যকতা গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থার অন্তর্গত। সরকারের ভুল-ভ্রান্তির সমালোচনা করা এবং সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করা বিরোধী দলের কর্তব্যের আওতার মধ্যে পড়ে। কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়, গঠনমূলক বিরোধিতাই কাঙ্ক্ষিত। বিরোধী দলকে সুযোগ দেওয়া সরকারি দলের কর্তব্য। কেননা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও ভূমিকা রাখতে হয় সংসদে ও রাজপথে। বিরোধী দলবিহীন গণতন্ত্রের বিকাশ অসম্ভব। তাই কার্যকর বিরোধী দলের সরব উপস্থিতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নাৎসি ও ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটেছিল। সেটা কেবল তাদের দেশের সীমায় সীমাবদ্ধ ছিল না, সারা বিশ্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কবলে পড়েছিল বিশ্ব। কোটি কোটি মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল সারা বিশ্ব। আশার কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পরাজয় এবং হিটলার ও মুসোলিনির করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে বিশ্ব নাৎসি ও ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করেছিল। কাজেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপদসংকুল হলে সামষ্টিক মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো সংরক্ষণের কোনো সুযোগ থাকে না। আমাদের দেশেও তেমন ঘটনার ধারাবাহিকতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

আমাদের সনাতনী ধারণা, নির্বাচিত সরকার মানেই গণতান্ত্রিক সরকার। এই ধারণা যে সঠিক নয়, সেটা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জেনে এসেছি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অতি আবশ্যক। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, জবাবদিহিতা কার কাছে; আর স্বচ্ছতাইবা কতটুকু? নির্বাচনে বিজয়ীর প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে ভোট। আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভোটের অবাধ কেনাবেচা, পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য, রাষ্ট্রের অনিরপেক্ষ ভূমিকা ইত্যাদি। পৃথিবীতে দেখা যায়, বহুদলের স্থলে প্রধান হয়ে পড়েছে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা। দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় এ-দল ওই-দল পালাক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পায়। এতে ভোটারদের সামনে দুই দলের বাইরে বিকল্প পছন্দের কোনো দল থাকে না। দুই দলের শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও তাদের বেছে নিতে হয় দুই দলের একটিকে। অর্থাৎ জনগণই নির্ধারণ করে তারা কোন দল দ্বারা শাসিত হবে। এর বাইরে তাদের সামনে কোনো বিকল্পের অবকাশ থাকে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে সব মানুষের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা ও সমান সুযোগপ্রাপ্তি। এছাড়া ক্ষমতাকে এককেন্দ্রে আটকে না ফেলে তাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়া। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রদান করা। এতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে উঠবে, সব মানুষের স্বাধীনতা, সার্বিক নিরাপত্তার বিকাশ নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে নামের ভিন্নতা ছাড়া কোনো বিরোধ-বিভাজন নেই, নেই পার্থক্যও। মূল কথা হলো, সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা।

গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় মেজরিটি মানে টোটালিটি নয়, এ সত্যটিকে আমলে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারকে অবশ্যই তা মান্য করে সমষ্টিগতদের আস্থা অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়াই হবে প্রধান কর্তব্য। এতে সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়ে নবজীবনের সূচনা লাভ করবে বলে মনে করি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হোক আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রার প্রত্যাশা পূরণ।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম