Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

বিপদে কেউ এগিয়ে আসছে না কেন?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিপদে কেউ এগিয়ে আসছে না কেন?

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, বিপদ একা আসে না। যখন আসে, তখন একের পর এক বিপদ আসে। আবার বিপরীতে বলা হতো, বিপদের দিনে কাউকে পাওয়া যায় না। কার বেলায় কথাগুলো কতটুকু সত্য, জানি না। তবে আমার বেলায় দেখেছি, কথাগুলো ভীষণ সত্য। জীবনে দেখেছি, বিপদ-আপদ আসছে তো আসছেই। সাহায্য-সহযোগিতা প্রার্থনা করছি; কিন্তু তা পাচ্ছি না। মনে হয়, অনেকেরই অভিজ্ঞতা এরকম, না হলে তা ব্যতিক্রম। এখন দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের বেলাতেও তাই-বিশেষ করে আমাদের বেলায়। আমাদের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে বিপদের পর বিপদ, সমস্যার পর সমস্যা, একের পর এক। এই যে পরিস্থিতি, তা শুরু হয়েছে আজ থেকে ৪-৫ বছর আগে। চলছিল ভালোই। বিশ্বের তাবৎ লোকজন আমাদের প্রশংসা করেছে এবং তা কাগজগুলোতে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রথম বিপদ আসে করোনার সময়। রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতি সব আক্রান্ত হয়। হাজার হাজার লোক মারা যায়। শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি, পরিবার সব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি ঘরের ভেতরেও একসঙ্গে আরেকজনের দূরত্ব রাখতে হয়েছে।

যখন এ বিপদ থেকে কিছুটা মুক্ত হওয়ার পথে আমরা এবং সারা বিশ্ব, তখন আরেক বিপদ এসে হাজির। এটা আরও মারাত্মক। আর এ বিপদ হচ্ছে ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ। যুদ্ধ তো নয়-মনে হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সারা বিশ্ব আক্রান্ত। সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ। এক কথায় যদি বলি, তাহলে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে বিশ্ব অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা শেষ হওয়ার পথে। নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থার সন্ধানে বিশ্ব। একে অনেকেই ‘বার্থ পেইন’ বলে ডাকছে। ‘বার্থ পেইন’ই হোক আর অন্য কিছুই হোক, বিশ্বে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা চলছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সবাই মনে করেছিল কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। না, তা হয়নি। চলছে জোর কদমে। কবে শেষ হবে, তার কোনো পূর্বাভাস কেউ দিতে পারে না। এদিকে আবার মধ্যপ্রাচ্যে আরেক বিপদ, যা আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সেটা হচ্ছে ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ। এর থেকেও তৈরি হচ্ছে উত্তেজনা। প্রভাব পড়ছে তেলের দামে।

এসব বিপদ-আপদের ফল কী? অনেক ধরনের ফল। একেক দেশের জন্য একেক রকমের ফল। আমাদের জন্য মোটা দাগে সংক্ষেপে ফল একটি, আর বাকি সব উপজাত ফল। মূল ফল হচ্ছে, ডলারের সংকট। ডলারের দাম বৃদ্ধি। এর থেকে উদ্ভূত ফল হচ্ছে বাকিগুলো। বলা যায় আরেকটা ফলের কথা, যা আমাদের ভোগায়-আর সেটা হচ্ছে তেলের দাম। তেলের দাম আমাদের কাহিল করে দেয়। ডলার সংকটের কারণ? প্রথম কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘পাজি’ কিছু নির্বাহী অহেতুক বসেবসে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বেশি বেশি দেখাচ্ছিল। ৪৫-৪৮ বিলিয়ন ডলার! প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের এর পরিমাণ ছিল ২০ মিলিয়ন ডলারেরও কম। ‘পাজি’ শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকে নয়। রপ্তানি ও আমদানির তথ্যেও একই জিনিস করা হয়। এর ফল কী? ফল হচ্ছে, যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেল ও অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন পণ্য আমদানিতে আমাদের ডলার লাগে বেশি, কিন্তু ডলার আছে কম। খুবই কম। এটা দেখে বিশ্ববাজার আমাদের ডলারে আমদানি ঋণপত্র খুলতে (ইনপোর্ট এলসি) করতে চায় না। ফলে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। যে ডলারের দাম ছিল ৮৬-৮৭ টাকা, সেটা বাড়তে বাড়তে এখন ১২০-১৩০ টাকা। এর অর্থ কী?

এ কথা আমরা সবাই জানি, আমরা আমদানিনির্ভর একটি দেশ। অবকাঠামো অনেক বেশি দামে (কস্ট) অনেক হয়েছে। কিন্তু আমদানিও হয়েছে বিরাট। বিশাল পরিমাণের আমদানি। চাল, ডাল, লবণ, পেঁয়াজ, মরিচ, গোল আলু, কাঁচামরিচ, মসলাপাতি, দুধ, ডিম, চিনি, সয়াবিন তেল-এসবই আমদানি করে খেতে হয়। বস্তুত, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা বিদেশনির্ভর। মুখে বলি, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রকৃত প্রস্তাবে চালও আমদানি করি আমরা। গমও আমদানি করতে হয়। ২০২৪-২৫ সালে ১০ লাখ টনের মতো চাল আমদানি হবে। গম আমদানি কমপক্ষে ৬০-৭০ লাখ টন। বাকি ভোগ্যপণ্য আমদানির কথা নাই বা বললাম। শুধু ভোগ্যপণ্যই নয়, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতিও আমাদের আমদানি করতে হয়। কেবল যে তৈরি পোশাক আমরা অনেক রপ্তানি করি, তারও ৪০-৫০ শতাংশ কাঁচামাল বাইরে থেকে আমদানি হয়। একমাত্র একটি ক্ষেত্রে আমরা রপ্তানিতে শীর্ষে। সেটা হচ্ছে জনশক্তি। এ থেকে যা পাওয়া যায়, তার সবটাই নিট ডলার। এক্ষেত্রে কোনো ডলার খরচ নেই। এমন একটা অর্থনীতির আমরা এখন মালিক। দৃশ্যত রমরমা অবস্থা। আন্তর্জাতিক প্রশংসা অনেক। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার খুঁজে খুঁজে বের করছে আমাদের দুর্বল দিকগুলো। সেটা হোক। কিন্তু ঘটনা যা ঘটার তা তো ঘটে গেছে। ডলার সংকট, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি-এই তিনে মিলে আমাদের সব অর্জন আজ ম্লান করে দিচ্ছে। ম্লান হচ্ছে মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। তার মানে? তার মানে বাজারে মাছ আছে, ক্রেতা নেই। মাংস কেনার লোক নেই। তকতকে, ঝকঝকে অবকাঠামো আছে, ব্যবহারের লোকের অভাব। এর অর্থ, মূল্যস্ফীতি হয়েছে মারাত্মক। এবং এটা ঘটছে চার বছর ধরে। কিন্তু এ সমস্যার কোনো শেষ আছে বলে মনে হয় না। সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের উপর। মুশকিল হচ্ছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের উপরে। অথচ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে না। মজুরি সমানতালে বাড়ছে না। গ্যাস নেই, কারখানা একে একে বন্ধ হচ্ছে। খাদ্য সমস্যার আশঙ্কা। এখন চারদিকে সংকট-সমস্যা, বিপদ-আপদ।

সর্বশেষ যে সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে, তা হচ্ছে চালের দাম। একটি কাগজের খবরের শিরোনাম ‘আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে’। বলা হয়েছে, টিসিবির হিসাবে এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩-৪ টাকা। ছয় মাসে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ ১৭ হাজার টন। গত ছয় মাসে সরকারিভাবে চাল বিতরণ বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। এই হচ্ছে খবর, খবর নয়-বিপদের খবর। আপদ নয় যে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব। সব বিপদ কোনো না কোনোভাবে সামলানো যায়। ভোগ্যপণ্যের ভোগ কমিয়ে বিপদ তাড়ানো যায়। রিকশায় না চড়ে ‘বিপদ’ তাড়ানো যায়, মানে খরচ কমানো যায়। কিন্তু চালের চাহিদা মেটানো তো সহজ কাজ নয়। অথচ এমন সময়ে এ ঘটনা ঘটেছে, যখন কৃষকের ঘরে চাল আছে। দেখা যাচ্ছে, বরাবরের মতোই মিলমালিকরা দোষারোপ করছেন ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করছেন মিলমালিকদের। সরকার দোষারোপ করছে ‘সিন্ডিকেটকে’। অথচ ‘সিন্ডিকেট’ সমস্যা ছিল বিগত সরকারের আমলে। তখন এসব করত সিন্ডিকেটওয়ালারা। চালের মন্ত্রী ছিলেন চালের ব্যবসায়ী, বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। তখন এসব হয়েছে। এখন তো সিন্ডিকেটকে দোষারোপ করা যায় না। কিন্তু বলা হচ্ছে, ‘সিন্ডিকেট’ কাজ করছে বরাবরের মতো। কী আর করা, আমরা অসহায়। কিন্তু বিপদটা যে চালের। এটা নিয়ে তো হেলাফেলা করা যায় না। এই বিপদ কিন্তু জরুরি বিপদ। এখানে বক্তৃতা চলবে না। দ্রুত সমাধান দরকার।

এবার প্রশ্ন একটি। ওই যে প্রথমেই বলেছিলাম, বিপদে কাউকে পাওয়া যায় না। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, আমাদের একের পর এক বিপদে কেউ এগিয়ে আসছে না। অথচ আসার মতো দেশ রয়েছে। আমরা গত ৫০ বছর ধরে অন্য দেশের সঙ্গে ভালো পরিমাণের ব্যবসা করে আসছি। বিশাল বিশাল ব্যবসা। চীনের সঙ্গে আমাদের বড় ব্যবসা। ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ-সবার সঙ্গে আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছি। তারাও লাভবান হচ্ছে, আমরাও হচ্ছি। অনেকের সঙ্গে আমাদের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। অথচ একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। আমরা কিছু ডলারের প্রত্যাশা করছি। কত ডলার? ২-৪-৬-১০ বিলিয়ন ডলার। আমরা যে ব্যবসা করি, আমাদের জিডিপির যে আকার, সে তুলনায় এ পরিমাণ ডলার কিছুই না। ইচ্ছা করলে আমাদের বড় ব্যবসায়িক পার্টনার চীন, ভারত, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাত এ পরিমাণ ডলার বিনা আয়াশে, বিনা শর্তে বা কম সুদে দিতে পারে। দিলেই আমাদের সমস্যা আপাতত হ্রাস পায়। কিন্তু কই, বাস্তবে তো কেউ এগিয়ে আসছে না? বিপদের দিনে তাদের এগিয়ে আসা উচিত ছিল না? বোঝা গেল, বিপদের দিনে কেউ এগিয়ে আসে না। সবাই সুদিনের বন্ধু, অথবা শক্তিশালীদের বন্ধু। এটা কি নতুন কোনো শিক্ষা? না, আদৌ নয়। সেজন্য বলা হয়, ‘ভবিষ্যৎ বুঝিয়া কাজ করিও’। সাময়িক টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত দেখে মাতাল হয়ো না। আমরা যা হয়েছিলাম। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ একটু বাড়তেই সমানে আমদানি। আমদানির নামে অর্থ পাচার-খোলাখুলিভাবে। এই ফাঁকে কী করা? অগত্যার গতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তারা এসেছে ‘দা-কুড়াল’ নিয়ে সাহায্য করতে। সাহায্য কত? মাত্র ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, তাও দেবে আড়াই বছরে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তাদের প্রধান শর্ত হলো-এমন কাজ করতে হবে, যাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। সর্বশেষ তারা বলছে ২০-৩০ দ্রব্যের কথা। সবার ওপর ‘ভ্যাট’ বাড়াতে হবে। এর অর্থ কী? অর্থ মূল্যস্ফীতি। অথচ মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে, তাও তাদের শর্ত!

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম