মনমোহন আমলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অন্যরকম ছিল
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![মনমোহন আমলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অন্যরকম ছিল](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/01/04/Monmahan-677857643cfd7.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জয়লাভ করলেও সরকার গঠনের লক্ষ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য তাদেরকে সিপিআইএমসহ কয়েকটি মধ্য ও বামপন্থি দলকে নিয়ে সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) গঠন করতে হয়। আর সে জোটের নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল তৎকালীন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর। কিন্তু জাতপাত ও অন্ধ হিন্দুত্ববাদের প্রভাবকবলিত ভারতীয় সমাজের একটি অংশ সোনিয়ার অ-ভারতীয় জন্মসূত্রের বিষয়ে আপত্তি তুললে নিপাট ভদ্রমহিলার মতো তিনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থিতা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন; এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে তখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় সিপিআইএম নেতা বাঙালি জ্যোতি বসুর। কিন্তু দলের পলিটব্যুরোর অসম্মতির কারণে তার আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়ে ওঠেনি। আর তেমন পরিস্থিতিতে সোনিয়া গান্ধী স্ব-উদ্যোগী হয়ে ও অনেকটা নীরবে ভারতের ১৩তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য শরণাপন্ন হন মনমোহন সিংহের। বস্তুত ইউপিএ তথা সোনিয়া গান্ধীর বিশেষ অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই মনমোহন সিংহকে এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়, যে পদের ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না, লোভ থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।
সম্পূর্ণ নির্লোভ এ মানুষটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের জন্য সবচেয়ে বড় যে অবদান রাখেন বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয় তা হচ্ছে, ভারতের ভগ্নপ্রায় অর্থনীতিকে মাত্র এক দশকের (২০০৪-১৪) ব্যবধানে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতিতে রূপান্তর। বিশেষজ্ঞদের উক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করেও এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে যোগ করা প্রয়োজন যে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকেও এ সময়ে তিনি একটি নতুন মাত্রা ও উচ্চতাদানে সক্ষম হয়েছিলেন, যার অন্যতম দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে : এক. গতানুগতিক ধারার কূটনীতিকে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে রূপান্তরকরণ; দুই. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা; এবং তিন. প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছাড় ও সমঝোতার নীতির ভিত্তিতে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। স্বাধীনতা-উত্তর গত প্রায় ৫৪ বছরের মধ্যে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যখন এ মুহূর্তে সবচেয়ে নিম্নে অবস্থান করছে, তখন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তথা বাংলাদেশের সঙ্গে মনমোহন সিংহ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ইতিবাচক দিকগুলোর কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ না করে পারা যায় না। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের এ ইতিবাচক দিকগুলো এদেশের দুই প্রধান শাসক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের শাসনামলেই (যথাক্রমে ২০০৪-০৬ ও ২০০৯-১৪) বহাল ছিল।
মনমোহন সিংহ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসাবে পর পর দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও তিনি আসলে কখনোই সক্রিয় রাজনীতিক ছিলেন না-ছিলেন জ্ঞান, চিন্তা ও মেধানির্ভর রাষ্ট্রনায়ক। ফলে রাষ্ট্রপরিচালনা কিংবা পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ কিংবা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের বিষয়টিকেও তিনি তার অন্তর্দৃষ্টি ও জ্ঞানভিত্তিক চিন্তার আলোকেই দেখেছেন। আর সে কারণেই ১৯৭২ সালের পর তিনিই হচ্ছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি দীর্ঘ ৩৯ বছর পর সর্বপ্রথম ২০১১ সালে দ্বিপাক্ষিক সফরে বাংলাদেশে আসেন এবং সফরকালে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সম্মান ও গুরুত্ব দিয়ে সাক্ষাৎ করেন। আর সে সফরকে তিনি দলীয় চোখ দিয়ে দেখেননি, যেমনটি তৎপরবর্তী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার দেখেছে ও দেখছে। এমনকি শুধু সফর নয়-দুদেশের মধ্যকার প্রায় সব বিষয়কেই তিনি দেখেছেন দুই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রদ্বয়ের জনগণের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নিরিখে। আর সে কারণেই লক্ষ করা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে দুটি ভিন্ন দল (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ) রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো হেরফের ঘটেনি, যেমনটি ঘটতে শুরু করেছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে।
এবার দেখা যাক মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আওতায় কী কী ঘটেছিল। এ সূত্রে একেবারে প্রথমেই বলা দরকার যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর হয়ে থাকা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠকগুলো আস্তে আস্তে সচল হতে শুরু করে। তার আমলের শুরু থেকেই বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ভারতীয় বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে জোরদার হতে থাকে। তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের কাজটিও তার আমলেই ২০১১ সালে প্রথম শুরু হয়; এবং তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত তা স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে থাকা যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক বস্তুত তার আমলেই নতুন করে শুরু হয়, যদিও নরেন্দ্র মোদির আমলে এসে তা আবার অকার্যকর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ২০১১ সালে তার বাংলাদেশ সফরকালে স্বাক্ষরিত না হলেও বিষয়টি তার কার্যকাল পর্যন্ত সচল ছিল। কিন্তু তার দায়িত্বকাল শেষ হওয়ার পর থেকে বিষয়টি আবার প্রায় পুরোপুরিই নির্জীব হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত বড় মানবিক ঘটনা হচ্ছে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা সিটমহলের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এর সম্মানজনক সমাধান, যেটিও ঘটেছে মনমোহন সিংহের আমলে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর থেকে পরবর্তী ৬৪ বছর ধরে দুদেশের মধ্যে বিভক্ত ছিটমহলের লোকজনরা যেভাবে পরস্পরের স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, উক্ত চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তার একটি সুন্দর মানবিক নিষ্পত্তি ঘটে। তদুপরি সেখানকার লোকজনরা এখন চব্বিশ ঘণ্টাই ওই ছিটমহলে যাতায়াত করতে পারে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং প্রথম থেকেই ভারতের গতানুগতিক কূটনীতিকে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে রূপান্তরের বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় তার আমলেই বাংলাদেশের ৪৬টি পণ্যকে ভারতের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল, যা এখনো বহাল আছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার নিজস্ব উৎপাদন ঘাটতির কারণে সে সুবিধা অদ্যাবধি পুরোপুরি ব্যবহার করে উঠতে পারেনি। যুক্তিসংগত শর্তে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের আলোচনাও মনমোহনের আমলেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলাদেশ দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে না পারায় ভারতের কৌশলী আমলা ও কূটনীতিকদের কাছে তারা পুরোপুরি নতজানু হয়ে পড়ে, যার সঙ্গে রাজনৈতিক নতজানুত্বেরও সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
এবারে মনমোহন সিং-উত্তর বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদির আমলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গতিবিধি কোনদিকে মোড় নিয়েছিল, সেদিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। মনমোহন সিংয়ের সরকার যেখানে এ সম্পর্ককে দুদেশ ও দেশদ্বয়ের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক হিসাবে দেখেছে, সেখানে মোদি ক্ষমতায় এসেই এটিকে অনেকটা মোদি-হাসিনা সম্পর্ক হিসাবে দেখতে শুরু করে। আর শেখ হাসিনা বিষয়টিকে যথেষ্ট মাত্রায় উপভোগও করতে থাকেন। বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে অনেকটা সেভাবেই এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হয়। তৎকালীন এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো প্রকাশ্যেই বলে বসেন যে, তিনি দিল্লি গিয়ে বলে এসেছেন, শেখ হাসিনাকেই যেন আগামীদিনে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রাখা হয়। যাত্রাপালার সং হিসাবে পরিচিত শেখ হাসিনা সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীর নিয়মিত কাজের একটি ছিল গণমাধ্যমকে জানানো যে, ‘ভারত আছে, আমরা আছি’। আর নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশকে অনেকটাই তাদের করদরাজ্যের মতো এবং এ দেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের তাদের বিশ্বস্ত ও অনুগত পোষ্য হিসাবে গণ্য করতে শুরু করেন, যেখানে বাংলাদেশের জনগণের কোনো অবস্থানই ছিল না। তদুপরি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থগুলোকেও তারা এক এক করে গলা টিপে হত্যা করতে শুরু করে। মনমোহনের আমলে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি যেখানে প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, বাকি ছিল শুধু কূটনৈতিক দূতিয়ালির মাধ্যমে মমতাকে রাজি করানো, সেখানে ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় এ বিষয়ে নতুন করে তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, যার অর্থ দাঁড়ায় এ বিষয়কার পূর্ববর্তী সব অগ্রগতিকে এক লহমায় মুছে ফেলা। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে প্রাথমিক সমঝোতা হওয়ার পরও শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে বলে এসেছিলেন, তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশ ভারতকে দিয়েই করাবে। একইভাবে ফেনী নদীর পানি সমস্যার বিষয়টিও এখন আলোচনা থেকে প্রায় পুরোপুরিই হারিয়ে গেছে।
একই অবস্থা দাঁড়িয়েছে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রেও। এসব বিষয়ে মনমোহন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে ছিল যুক্তিসংগত সহযোগিতা, সেখানে মোদি সরকারের আমলে এটি পুরোপুরিই দাঁড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের সড়ক ও বন্দরের ওপর ভারতের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং এ পন্থায় আর্থিকভাবে ভারত কর্তৃক একচেটিয়াভাবে লাভবান হওয়া। যৌথ নদী কমিশন, যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন ও অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক কমিটিগুলোর কার্যক্রমও এ সময়ে শুধু স্থবিরই হয়ে পড়েনি, অনেকটা লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতায়ও পর্যবসিত হয়েছে, যেগুলোর প্রকারান্তরিক ফলাফল দাঁড়িয়েছে আমলা ও রাজনীতিকদের পরস্পরের দেশে যাওয়া-আসা এবং অর্থহীন গল্পগুজব ও কথাবার্তায় সময় অতিবাহিত করা।
সব মিলিয়ে এটা বোধহয় বলাই যায় যে, ছোট-বড় কিছু সমস্যা সত্ত্বেও মনমোহন সিংয়ের আমলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে কার্যকর ছিল। বস্তুত মনমোহনের মেধা, জ্ঞান, শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল এর পেছনের মূল চালিকাশক্তি, যার প্রয়োজনীয়তা এ উপমহাদেশের মানুষ আরও বহুদিন পর্যন্ত অনুভব করবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত।
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)
atkhan56@gmail.com