Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সংস্কারের পরিধি বাড়লে রাজনৈতিক সংকট বাড়তে পারে

Icon

ড. আলী রেজা

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কারের পরিধি বাড়লে রাজনৈতিক সংকট বাড়তে পারে

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতেই বিএনপিসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র মেরামতের দাবি তুলেছিল। রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা দাবি নিয়ে সে সময়ে বিএনপি যথাসাধ্য গণসংযোগেও নেমেছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি ওঠে। সে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয় এবং বেশকিছু সংস্কার কমিশন গঠন করে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিলেও সংস্কারের পরিধি ও সময়সীমা নিয়ে তাদের রয়েছে নানা হিসাবনিকাশ।

নির্বাচনের সর্বশেষ রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্যেও সংস্কারের বিষয়টি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শুধু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো সংস্কার করে নির্বাচন দিলে সেটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে করা সম্ভব। আর প্রত্যাশা অনুযায়ী সব সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন দিতে হলে ২০২৬ সালে প্রথমার্ধ অর্থাৎ জুন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।

সরকার ঘোষিত নির্বাচনের এ রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এ রোডম্যাপ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলকেই সন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। সংস্কারের নামে নির্বাচনকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াটাকে অনেকেই যুক্তিসংগত মনে করছেন না। মত-ভিন্নমত যাই-ই থাকুক না কেন-এ লম্বা সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন আগের মতো নাও থাকতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারবিরোধী প্রচারণায়ও নেমে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই সে ধরনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন আছে। বাস্তবতা হলো, প্রত্যাশা অনুযায়ী সব সংস্কার সম্পন্ন করা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথমত, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার শেষ বলতে কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। আরেকটি বাস্তবতা হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারগুলো নির্বাচিত সরকার এসে বহাল নাও রাখতে পারে কিংবা ততটাই বহাল রাখবে, যতটা তাদের দলীয় নীতি-আদর্শ ও এজেন্ডার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সংস্কারের পরিধি না বাড়ানোই সমীচীন।

সংস্কারের পরিধি বাড়ালে সেই সংস্কার সম্পন্ন করতে আরও সময় লাগবে। সময় যত গড়াবে, সরকার তত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে একটি বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে, জনসমর্থন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন সত্ত্বেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে চলমান সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হচ্ছে। জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রস্তাব নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারকে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস করার প্রস্তাব প্রকাশ হলে সে প্রস্তাবকে নাকচ করতে দেখা গেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ ২৫টি ক্যাডারের আন্তঃক্যাডার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলমান আছে। সব সংস্কার প্রস্তাব প্রকাশ হলে স্ব স্ব বিভাগ থেকেও আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে। সংস্কার ইস্যুতে প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে বিভাজন তৈরি হলে সেটি নিরসন করাও সরকারের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে অন্তর্বর্তী সরকারের টিকে থাকাই কঠিন হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল এ সরকারের কার্যক্রমেও বৈষম্যের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই। এ সরকারকে নিরঙ্কুশভাবে সমর্থনকারী অনেকেই এখন দ্রব্যমূল্যসহ নানা ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করছেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি না ঘটলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল ও সংস্কারের কথা বলে আর বেশিদিন জনসমর্থন ধরে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ দিনশেষে জনগণ তাদের নির্বাচিত সরকারকেই প্রত্যাশা করে।

সংস্কারের পরিধি বাড়ালে সরকার নিজেও নানা জটিলতায় পড়ে যেতে পারে। শুরু থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে উপদেষ্টাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জনমনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। ইলিশ ও পলিথিন ইস্যুতে সরকার নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। সংস্কারের পরিধি বাড়ালে সংস্কার ইস্যুতেও সরকারের ভেতরে সৃষ্টি হতে পারে ভিন্নমত। এ ধরনের ভিন্নমত সরকারের অবস্থানকে দুর্বল করে দেবে। আর দুর্বল অবস্থান থেকে কোনো পরিকল্পনা বা সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে আমলাতন্ত্র প্রবল শক্তির অধিকারী হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর কিছু দপ্তরে ব্যক্তির পরিবর্তন করে সে শক্তিবলয় ভেঙে ফেলা গেছে-এমন ধারণা করা ঠিক নয়। এ কারণে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে যে কোনো সংস্কার বাস্তবায়ন করাও কঠিন। সংস্কারের ফলাফল বিবেচনা করেই আমলাতন্ত্র তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ফলাফল নিজেদের প্রতিকূলে গেলে সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব নাও হতে পারে। তাই সরকারের সংস্কার ভাবনায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। আমলাতন্ত্রের অনুকূলে না থাকলে যে কোনো সংস্কার কাজের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হতে পারে। আর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কোনো সংস্কার কাজকে প্রলম্বিত করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে সে সুযোগ দেবেও না। তাই সংস্কারের পরিধি না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে আনাই হবে বর্তমান সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক। সব ক্ষেত্রে সংস্কার করতেই হবে কিংবা চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করতেই হবে-অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করে নির্বাচন সুসম্পন্ন করা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ এবং এ কাজে সফলতার ওপর নির্ভর করবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা।

সুতরাং সরকারকে মুখে নয়, কাজেও নির্বাচনকেন্দ্রিক হতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার করার কথা বলা হচ্ছে, তা যতই যথার্থ হোক না কেন, সেসবের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ক্রমেই কমে আসতে শুরু করেছে। এখন সাধারণ মানুষও মনে করছেন, নির্বাচন হয়ে গেলে নির্বাচিত সরকারই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নেবে। এ পরিস্থিতিতে সংস্কারের পরিধি বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এখনো নতুন করে সংস্কার কমিশন গঠনের কথা শোনা যায়। পর্যায়ক্রমে গঠিত হওয়ার ফলে আগের সংস্কার কমিশনগুলো সবাই একসঙ্গে রিপোর্ট দিতে পারবে না। কোনো কোনো কমিশন সময় বৃদ্ধি করতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করার প্রয়োজন পড়ে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপন জারি করেও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার বা পরিবর্তন করা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারকে কাজের গতি বাড়াতে হবে এবং সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। সংস্কারের পরিধি বাড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এতে রাজনৈতিক সংকট বেড়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো যৌক্তিক কারণেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে।

বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো শুরু থেকেই বলে আসছে, সরকার নিজে নিজে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক দলগুলোর করার কিছু থাকবে না। এটি কিন্তু সরকারের প্রতি একটি কঠোর সতর্কবার্তা। ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন অব্যাহত আছে বলেই সরকার টিকে আছে। এ সরকারের শক্তির উৎস যে কোনো সময় যে কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে সংস্কার তো দূরের কথা-সরকার তার নিয়মিত কাজ করতেও হিমশিম খাবে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে বসে থাকবে না। তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য সংগঠিত হবে এবং আন্দোলনে নেমে যাবে। তখন নির্বাচন করাই কঠিন হয়ে যাবে। সে পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচন সম্পন্ন করবে-এটাই সবার প্রত্যাশা। দেশের মানুষ শিগ্গিরই আর কোনো রাজনৈতিক সংকট দেখতে চায় না। মব ভায়োলন্সের শিকার হতে চায় না। কারও অপরাধ প্রমাণিত হলে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে তার শাস্তি হোক। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজ দলের দুষ্কৃতকারীদের আইনের হাতে সোপর্দ করার কথা বারবার বলেছেন। বিএনপি-জামায়াতের এমন বাক্সংযম ও সহযোগিতা সত্ত্বেও যদি সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখা কঠিন হবে।

নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। এখন মানুষ সরকারকে আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে মূল্যায়ন করা শুরু করেছে। আজও যখন একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে জুতার মালা পরিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়, আজও যখন অপ্রমাণিত অভিযোগে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মারা হয়, তখন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার জায়গা দুর্বল না হয়ে পারে না। সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র-জনতা এ অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমেই জনগণের সে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাই সংস্কারের পরিধি না বাড়িয়ে শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারের দিকেই মনোযোগী হওয়া জরুরি। তা না হলে রাজনৈতিক সংকট বেড়ে যেতে পারে।

ড. আলী রেজা : সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম