Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ অগ্রাধিকার পাক

Icon

আকমল হোসেন

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ অগ্রাধিকার পাক

ফাইল ছবি

সম্প্রতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করার জন্য গুচ্ছভর্তি, না বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে, তা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ধীরে ধীরে নিজস্ব পরীক্ষার স্থলে গুচ্ছভর্তি নামে এ পর্যন্ত ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নিয়ে ভর্তি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সাতটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, তিনটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২৪টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী তার পড়ার বিষয় অনুযায়ী-অর্থাৎ কৃষি, প্রকৌশল, বিজ্ঞান বিষয়ে একটি পরীক্ষা দিয়ে তার যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। এ ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ভর্তির জন্য ছোটাছুটি করতে হতো। তারা আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম জমা দিত এবং নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা দিতে আবার ছুটত। তারপর ফলাফলের জন্য গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করত। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হলে কোথায় ভর্তি হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যেত।

অন্যদিকে তাদের আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ফরম কিনতে হতো। নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা এবং সেখানে গিয়ে সাময়িক আশ্রয় ও খাওয়া-দাওয়া বাবদ একগাদা টাকা খরচ করতে হতো। এ ব্যবস্থায় তাদের অভিভাবকদের শুধু আর্থিক নয়, একইসঙ্গে তাদের নিরাপদ যাতায়াতের ব্যাপারে এক মানসিক চাপ বহন করতে হতো। কিন্তু যখন থেকে এসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক বিচার-বিবেচনার পর গুচ্ছভর্তি ব্যবস্থার আওতায় গেল, তখন থেকে সেসব শিক্ষার্থী একবার ফরম পূরণ করে নিজেদের গ্রাম বা শহরের নিকটবর্তী পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেল। এতে তাদের অর্থের সাশ্রয় হলো এবং যাতায়াতের ভোগান্তি কমে গেল। এর আগে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার কারণে তাদের প্রস্তুতিও ভিন্ন হতো। কিন্তু গুচ্ছ ব্যবস্থার অধীনে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ একক প্রশ্নপত্র তৈরি করে বলে তাদের প্রস্তুতির জন্য ভিন্নতা থাকার কথা নয়।

এ ধরনের ভর্তির ব্যবস্থা আমাদের দেশের জন্য কোনো অনন্য ব্যাপার নয়। জাপানে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন আমার এমন একজন সাবেক ছাত্র সেদিন আমাকে সমগ্র জাপানে এ পদ্ধতিতে ভর্তি করার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানালেন। সেখানে একটি কেন্দ্রীয় ভর্তি কর্তৃপক্ষ একটি প্রশ্নে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই দিনে পরীক্ষা নিয়ে থাকে। তবে সেখানে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের অ্যাকাডেমিক মান অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় এগিয়ে; যেমন-টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়, তারা কেন্দ্রীয় পরীক্ষার পরও আরেকটি পরীক্ষাও নিয়ে থাকে।

আমাদের দেশে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কোনো পরীক্ষা দিতে হতো না। ষাটের দশকের মাঝামাঝি আমরা শুধু আমাদের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ভর্তি হওয়ার আগে বিভাগীয় প্রধান একটা মামুলি মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছিলেন, যা ভর্তির ওপর প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল কম, শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ছিল সেরকম। সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শিক্ষার্থী বাছাই করার জন্য কিছু কিছু বিষয়ে নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছিল। একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিট পদ্ধতিতে (ক, খ, গ, ঘ ইত্যাদি) ভর্তি করার নিয়ম চালু হলে তা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ও অনুসরণ করা শুরু হয়। অনলাইনে ভর্তি ফরম পূরণ করার সুযোগ তৈরি হওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের লাইন করে ফরম নিয়ে তা পূরণ করে আবার লাইন দিয়ে ডিন অফিসে জমা দিতে হতো। তাদের সেই কষ্ট লাঘব হয়েছিল অনলাইন চালু হওয়ার পর।

কিন্তু দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের দেশজুড়ে ছোটাছুটির হয়রানি এবং অভিভাবকদের ওপর আর্থিক চাপ শুরু হলো। নিঃসন্দেহে গুচ্ছপদ্ধতির পরীক্ষা তাদের জন্য দুশ্চিন্তার অবসান হওয়ার সুযোগ হিসাবে এসেছে।

এখন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছপদ্ধতি থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছে, কারণ হিসাবে তারা অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বা তাদের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলতে পারে। এগুলো কোনো জোরালো কারণ বলে আমার কাছে মনে হয় না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের যাবতীয় খরচের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। অকিঞ্চিৎকর ছাত্র বেতন তাদের আয়ের যৎসামান্য অংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার বিষয়ে তারা এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেন, যা আদতে শিক্ষা প্রদান ও গবেষণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। তবে নিন্দুকরা বলে, এ ভূমিকায় তারা অনেকেই তেমন উজ্জ্বল নন। কিন্তু আর্থিক দায়-দায়িত্বের বেলায় তাদের কোনো স্বায়ত্তশাসন থাকার কথা নয়। তাদের বাজেট তৈরিতে তারা স্বাধীন হলেও খরচের বেলায় না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

জনমানুষের টাকায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় যখন, তখন জনঅভিপ্রায় তাদের ওপর দায় চাপিয়ে দিতে পারে। গুচ্ছভর্তি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ যখন, তখন শিক্ষকদের কোনো সংকীর্ণ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হওয়া নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি করার ব্যবস্থার সঙ্গে জনগণের স্বার্থ জড়িত, যা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল বাদ দিতে পারে না। তাছাড়া সরকার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগান দেয়, তখন তারও দায়িত্ব আছে-শুধু অনুরোধ করার মধ্যে দায়িত্ব শেষ করা নয়, শিক্ষকদের গুচ্ছপদ্ধতির ব্যাপারে প্রভাবিত করতে হবে।

কেন্দ্রীয় পরীক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম বিক্রি বাবদ যে অর্থ আয় হয়, তা হয়তো আলাদা আলাদা পরীক্ষা নেওয়ার তুলনায় কম হবে। আলাদা পরীক্ষার মতো গুচ্ছ পরীক্ষায়ও পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট সব শিক্ষকই তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব অনুযায়ী সম্মানি গ্রহণ করবেন। প্রশ্ন প্রণয়ন ও মডারেশন, পরীক্ষা হলে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব, খাতা মূল্যায়ন, সব ভূমিকার জন্য আগের মতো সম্মানি গ্রহণ করবেন, তবে অঙ্কের হিসাবে তা আলাদা পরীক্ষার তুলনায় কম হবে।

গুচ্ছ পরীক্ষা নেওয়ার বিরুদ্ধে কেউ যুক্তি দিতে পারেন, কেন্দ্রীয় পরীক্ষা দ্বারা তাদের মান অনুযায়ী শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। এটি কোনো জোরালো যুক্তি বলে আমার মনে হয় না। যারা এ পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবেন, তাদের মানসিকতার ওপর নির্ভর করবে মান কীভাবে রক্ষা করা যাবে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিট ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেখানে ইউনিটের অধীন বিভাগগুলোতে মান কীভাবে রক্ষা করা হচ্ছে? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজগুলো কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে, তখন মানের প্রশ্ন কেউ কি উত্থাপন করেন?

আমার সাবেক সহকর্মীদের কাছে আমি অনুরোধ করব, তারা শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে তাদের স্বার্থের ওপর স্থান দেবেন। তাদের আবারও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটাছুটি করতে, তাদের ওপর অর্থের বোঝা চাপিয়ে দিতে, অভিভাবকদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দেবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা বরং ভর্তি-পরবর্তী শিক্ষার মান, প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা, নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নত করার বিষয়ে মনোযোগী হলে এ ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় দায়িত্ব পালন করা যাবে।

ড. আকমল হোসেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম