ফাইল ছবি
২১ জুলাই, রোববার। মাগরিবের আজান হবে হবে ভাব। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। ওপাশ থেকে জেরা করার মতো বেশকিছু প্রশ্ন করা হয়। পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, তিনি র্যাবের মিডিয়া উইং থেকে কল করেছেন। অসামঞ্জস্যপূর্ণ আলাপ। আমি নাকি তাদের স্যারকে কল করেছিলাম। তিনি আমার নম্বর দিয়েছেন তাকে কথা বলার জন্য। আমি জানালাম, আমি র্যাবের কাউকে কল করিনি। এরপর বললেন, আপনি তো লেখালেখি করেন, তাই না? বললাম, যা লিখি তাকে লেখালেখি করি বলা যায় না। কলাম লিখি পত্রিকায়। কোন পত্রিকায় লিখি জিজ্ঞেস করলেন, বললাম। এরপর তিনি আমার ইউটিউব চ্যানেলের আলোচনা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। বুঝলাম, ও প্রান্তে যিনি আছেন, তিনি কেবল কালক্ষেপণ করতে চাইছেন। কথা বলতে বলতে খুব জরুরি কিছু জিনিস একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেসময় আমি যেখানে থাকতাম, সেখান থেকে বের হওয়ার দুটো পথ ছিল। ফোনটা বাসায় অন রেখে পেছনের পথ দিয়ে বের হয়ে হেঁটে পান্থপথ সিগন্যালে চলে এলাম। এরই মধ্যে মাগরিবের আজান হলো। আসরের নামাজের পর থেকেই মোবাইলে বেশ কয়েকটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। রিসিভ করলেও ওপাশ থেকে কোনো কথা শোনা যায় না। এ অভিজ্ঞতা সেবারই প্রথম ছিল না। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আড়াই মাস আগে ২৬ অক্টোবর প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন আমি বাসায় ছিলাম না। প্রেস ক্লাব এলাকায় ছিলাম। সেখান থেকেই সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস রেখে সরে গিয়েছিলাম। এর পরের তিন মাসে চারবার ডিবি এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ আমার বাসায় এসেছিল খোঁজখবর করতে। ২১ জুলাই সন্ধ্যার ঘটনার পর থেকে আমার বাসার এক্সিট গেটে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ এবং ডিবির নজরদারি ছিল।
সেই সন্ধ্যায় আমি চলে যাই আমার বোনের বাসায়। সেখানে থেকেই চলমান আন্দোলনে অংশ নেই। আমাদের ওপর নির্দেশনা ছিল কোনো রাজনৈতিক, সাংগঠনিক পরিচয়ের বাইরে থেকে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ছাত্রদের সর্বাত্মক সহযোগিতার।
জুলাই অভ্যুত্থানের শুরুতে এ আন্দোলন ছিল কেবল কোটা সংস্কারের। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আদালতকে ব্যবহার করে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে। সেসময় এ আন্দোলনের নেতৃত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ চায়নি। ১৫ জুলাইয়ের পর যখন ছাত্ররা ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক আক্রমণের শিকার হলো, তখন তারা নিজেরাই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সহযোগিতা চাচ্ছিল। বলা বাহুল্য, এর আগে থেকেই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের ব্যানার গুটিয়ে কোটা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল।
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের পর যখন সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না, আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে যোগাযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ল, তখন হঠাৎই তৎকালীন হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপে ডাকা হলো ছাত্র নেতাদের। সেদিন সন্ধ্যার পর পর্যন্ত সংলাপের কোনো সম্ভাবনা দেখা না গেলেও মাঝরাতে হঠাৎ জানা গেল আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর সঙ্গে সরকারি অতিথি ভবন পদ্মায় দেখা করেছেন। সেসময় তারা সরকারের কাছে আট দফা দাবি উপস্থাপন করেন। পদ্মায় সেদিন তারা গণমাধ্যমের সামনে শক্ত ভাষায় বলেছিলেন, তারা কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবিতে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন করছেন। এর বাইরে কেউ যদি আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে বা সরকার পতনের আন্দোলন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একইসঙ্গে ঘোষণা করেন, তারা যে কোনো ধরনের সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল বটে, তবে ক্যারিশমাটা হচ্ছে, যেহেতু তারা এ অভ্যুত্থানের ‘একমাত্র’ শক্তি, তাই তারাই নির্ধারণ করবেন পতিত স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীদের মধ্যে কারা বিচারের মুখোমুখি হবে, কারা সরকারে থাকবে, সরকার কী করবে, কোন শর্তে স্বৈরাচারের দোসররা দায়মুক্তি পাবে, দেশে কবে নির্বাচন হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বলা হলেও জনতার হাতে আর কিছু থাকল না। থাকল গুটিকয়েক ছাত্র নেতৃত্বের হাতে। তাদের কাছে অবশ্য যুক্তি আছে-আমরা অভ্যুত্থানের শক্তি।
স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগের এমন একটা বয়ান ছিল-আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, না থাকলে বিপক্ষের শক্তি। আর সেই বিচারে তারাই দেশের মালিকানার দাবিদার ছিল। ’২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত বাংলাদেশে নতুন বয়ান তৈরির চেষ্টা হচ্ছে-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র সংগঠন এবং পরবর্তীকালে এই নেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা কয়েকটি সংগঠনের পক্ষে থাকলে আপনি জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করেন, আর কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে আপনি সেই স্পিরিটের পরিপন্থি। উদাহরণস্বরূপ, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলের সুবিধাভোগী, তথাকথিত নির্বাচিত কাউন্সিলর, যারা জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে সরাসরি হামলায় অংশ নিয়েছে, নির্দেশ দিয়েছে; নতুন বয়ানের ধারকদের সহযোগিতার শর্তে তারা জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করেন। আবার একজন টকশো সঞ্চালক সেই ধারকদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এক মুহূর্তেই তিনি জুলাই স্পিরিটের বিরোধী হয়ে যান।
আওয়ামী লীগ যেমন শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্বের দাবিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, তেমনি ’২৪-এর অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ একটা কাল্ট দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। নানা পরিকল্পনার কথা এখন শোনা যাচ্ছে। অথচ এ অভ্যুত্থানের চারটি স্পার্ক পয়েন্ট ছিল-শেখ হাসিনার মুখে রাজাকারের বাচ্চা উচ্চারণ, রংপুরে পুলিশের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে লড়তে লড়তে আবু সাঈদের মৃত্যু এবং তা সরাসরি টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়া, ঢাকায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করতে করতে মুগ্ধর মৃত্যু এবং তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুনের ছয় সমন্বয়ককে হেফাজতে নেওয়া। এর কোনোটিই পরিকল্পনামাফিক হয়নি। শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের হল থেকে বেরিয়ে আসা কতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, তার সাক্ষী আমি নিজেই। সেই রাতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমিও টিএসসিতে ছিলাম। এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত, রাত সাড়ে ১২টার দিক থেকে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেও রাজু ভাস্কর্যের সামনে একটা মাইক পর্যন্ত আনা যায়নি। হলগুলো থেকে যে মিছিল আসছিল, সেগুলোও একেকটা একেক দিকে প্রদক্ষিণ করছিল।
’২৪-এর অভ্যুত্থান হয়েছিল ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। সারা দেশে রাজনৈতিক কর্মীরা সামনে থেকে লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। রিকশাওয়ালা, দিনমজুর থেকে শুরু করে সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ পর্যন্ত জীবন দিতে দ্বিধা করেনি। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কলেজ, এমনকি স্কুলের বাচ্চারাও রাস্তায় নেমেছে, লড়াই করেছে। এ অভ্যুত্থানের কোনো মালিকানা নেই। এর ভিত্তি তৈরি হয়েছে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গত সাড়ে ১৫ বছরের লাগাতার সংগ্রাম আর জনগণের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের ওপর। বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন, নিপীড়ন, রিমান্ডে পৈশাচিক অত্যাচার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরও রাজনৈতিক কর্মীরা লড়াই করেছে। শুরুতে নিজের অভিজ্ঞতার সামান্য একটা অংশের কথা বলছিলাম। একই অভিজ্ঞতা বা আরও ভয়ানক কিছু ঘটেছে অনেকের সঙ্গেই। আমরা কি এ অভ্যুত্থানের অংশ নই?
’২৪-এর অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে জরুরি ছিল অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে সর্বব্যাপক ঐক্য প্রতিষ্ঠা। কিন্তু একাত্তরের পর আমরা যেভাবে বিভাজনের পথে হেঁটেছি, এবারও সম্ভবত সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছি। কয়েকদিন আগে হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা আলোচনা শুরু হয়েছিল-‘আমরা কারা’। এ ক্যাম্পেইন ছিল মূলত কেন তারাই জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করে এবং কাউকে এ স্পিরিটের সার্টিফিকেট দিতে পারে, সেটা বোঝাতে। অর্থাৎ কেউ এ রাষ্ট্রের অধিক মালিকানার দাবিদার। জর্জ অরওয়েলের লেখা এনিমেল ফার্মের সেই বিখ্যাত লাইনের মতো-‘অল এনিমেলস আর ইক্যুয়াল, বাট সাম আর মোর ইক্যুয়াল দ্যান আদারস’।
সাকিব আনোয়ার : রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
Email: mnsaqeeb@gmail.com