Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

সরকারকে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারকে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে

ছবি: সংগৃহীত

মঙ্গলবার ২৪ ডিসেম্বর একটি দৈনিকে শিরোনাম ছিল, ‘কক্ষে কক্ষে পড়েছিল রক্তাক্ত দেহ’। কোথায়, কিসের কক্ষে রক্তাক্ত দেহগুলো পড়ে ছিল? সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায়, মেঘনায় একটি মালবাহী জাহাজে সাতজন জাহাজকর্মীর রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এই সাতজনের মধ্যে পাঁচজনকে জাহাজ থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত ঘোষণা করা হয়। একজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

নোঙর করা জাহাজের কর্মীদের হত্যার বীভৎসতার খবর দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছাপা হওয়ার আগে জানা গেছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে। একইসঙ্গে সামাজিক মাধ্যমেও এ হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচারিত হয়। খবর শুনে অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর দেখতে হবে তার জন্য অনেকেই প্রস্তুত ছিলেন না। বাংলাদেশে সাধারণ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে না। ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, খুন-খারাবি, সংঘাত-সংঘর্ষ এদেশে নিত্যদিনের ঘটনা। যে কোনো দিনের সংবাদপত্র পড়ে দেখলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের কোনো না কোনো প্রান্তে ভয়াবহ অপরাধের ঘটনা ঘটছে।

এ বছর জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দেশবাসীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে নিয়ে আসাই তাদের অগ্রাধিকার। কিন্তু এসব আশ্বাস বাণী সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি কারোরই উদ্যোগে উন্নতির দিকে যাচ্ছে না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, তা হলো, একটি দেশে যখন বড় ধরনের অভ্যুত্থান হয়, তখন এর পরিণতিতে সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। কারণ ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতার উৎসগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সমাজের এ যাবৎকালীন গড়ে ওঠা ক্ষমতা কাঠামো ভেঙে পড়ে। হতে পারে তা কয়েক দিনের জন্য কিংবা কয়েক সপ্তাহের জন্য। এমনকি তা হতে পারে চিরদিনের জন্য। একদিকে যখন ক্ষমতা কাঠামো ধসে পড়ে, অন্যদিকে তখন ক্ষমতাবহির্ভূত শক্তিগুলো ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এমনই পরিস্থিতিতে শান্ত-স্বাভাবিক-নিস্তরঙ্গ অবস্থা আশা করা যায় না। ফরাসি বিপ্লবের পর রেইন অব টেরোর হয়েছিল। রুশ-বিপ্লবের পর বলশেভিকরা ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হলেও সোভিয়েত রাশিয়াতে দেখা দিয়েছিল গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি। বিপ্লববিরোধীরা জারি করেছিল শ্বেত সন্ত্রাস। প্রতিবিপ্লবীদের গৃহযুদ্ধের প্রয়াস দমন করতে লাল ফৌজকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। লাল ফৌজ ট্রটস্কি’র নেতৃত্বে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান চালায়। শেষ পর্যন্ত লাল ফৌজেরই বিজয় হয় এবং বলশেভিকরা তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এটাই স্বস্তির বিষয় ছিল না। দেখা দিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটল। লেনিন এ পরিস্থিতিতে বলেছিলেন, Never was the condition of the Proletariat was so bad, as under the dictatorship of the proletariat. রুশ বিপ্লবের ওপর একটি রুশ চলচ্চিত্র দেখেছিলাম। এই ফিল্মটির নাম ছিল ‘Lenin in October’. এ ছবিতে দেখা যায়, একজন কমরেড মস্কো থেকে অনেক দূরবর্তী জায়গায় খাদ্য নিয়ে পৌঁছান। আবার সেখান থেকে খাদ্যের বস্তাগুলো শূন্য করে মস্কোতে এসে লেনিনের সঙ্গে দেখা করেন। লেনিনকে তিনি জানান যে, তিনি সফলভাবেই খাদ্য সংকটগ্রস্ত এলাকাটিতে খাদ্যশস্য পৌঁছে দিয়েছেন। একথা লেনিনকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢলে পড়েন। কারণ তিনি এ দায়িত্ব পালনকালে কোনো খাবার গ্রহণ করেননি, যদিও তার জিম্মায় বস্তা বস্তা গম ছিল। এমনই ছিল বিপ্লবী বলশেভিকদের চরিত্র এবং বিপ্লবী নিষ্ঠা। একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেমন অনেক নিষ্ঠাবান ও পরীক্ষিত মানুষের সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিপ্লববিরোধী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীরও উদ্ভব হয়। যদি দেখা যায়, একটি সমাজে বিশাল গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে অথচ সে পরিমাপে ন্যায়-নিষ্ঠ চরিত্রবান দৃঢ়চেতা মানুষ সৃষ্টি হয়নি, তাহলে বুঝতে হবে গণ-অভ্যুত্থানটি যথাযোগ্যভাবে নতুন সমাজের জন্য নতুন মানুষ সৃষ্টি করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে চিত্রনির্মাতা খান আতাউর রহমান ‘আবার তোরা মানুষ হ’, নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে খান আতা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তৎকালীন ভয়াবহ সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখে। যারা বিপথগামী হয়েছিল, তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগটি করতে প্রস্তুত ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় বিদ্যমান নেতৃত্ব এ সাহসী তরুণদের ভালো কোনো কাজে লাগাতে পারেনি।

বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ঘটনা ১৯৬৯ সালেও ঘটেছিল। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানটি যখন বিজয়ের পথে, তখন জামালপুর ও চাঁদপুরের হাইমচর থেকে খবর এলো কৃষকরা গরু চোরদের ধরে ধরে জবাই করছে। আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে কৃষকরা ছিল শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন। কিন্তু আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাশালী দুর্বৃত্তরা যখন দুর্বল হয়ে পড়ল, তখন কৃষকরা নিজেদের কিছুটা হলেও ক্ষমতায়িত করার সুযোগ পেল। এ সুযোগে তাদের দীর্ঘদিনের শত্রুদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার মওকা খুঁজে পেল। এক অর্থে কৃষকদের এ আচরণ ছিল আইন হাতে তুলে নেওয়ার শামিল। তবে বিপ্লবী পরিস্থিতিতে একে আইন হাতে তুলে নেওয়ার শামিল বিবেচনা করা এক বিচারে সমীচীন নয়। কৃষকদের ক্ষোভের দিকটিও ভেবে দেখতে হবে। হালের গরু কিংবা দুধের গরু কৃষকদের মাতৃসম। কৃষক যখন একটি গবাদিপশু হারায়, তখন সে মাতৃহারানো শোকের মতো মুহ্যমান হয়ে পড়ে। ১৯৬৯-এর যে সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তখন পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর ফলে পুলিশ মানসিকভাবে হীনবল হয়ে পড়েছিল। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সেই সময় সমাজের ভেতর ক্রিয়াশীল নানাশক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাত সম্পর্কে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলাম।

এবারের গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশ শুধু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েনি, এরা কর্মস্থল থেকে পালিয়ে গেছে এবং দীর্ঘদিন পলাতক থেকেছে। এখনো অনেকে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেনি। যারা কর্মক্ষেত্রে ফিরে এসেছে, তারাও কর্তব্য পালনে বা অপরাধ দমনে সক্রিয় হয়ে উঠছে না। যারা কাজে যোগ দিয়েছেন, তারা অনেকে দায়সারা গোছে দিন পার করছেন। এর ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না, বরং অবনতি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫ আগস্টের পরপর রাজধানী ঢাকার কয়েকটি এলাকায় ডাকাতরা লুণ্ঠনের জন্য হামলা চালিয়েছে অথবা লুটতরাজ করেছে। সাধারণ মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিরোধের ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই ডাকাতির ঘটনা দমিত হয়ে যায়। আসলে সমাজে যখন প্রতিষ্ঠানগত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা দেয়, তখন সংগঠিত জনশক্তির মাধ্যমে এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব।

মেঘনায় জাহাজে সাত খুনের ঘটনা প্রাথমিকভাবে প্রচণ্ড রহস্যের সৃষ্টি করেছে। জাহাজের কর্মচারীদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়। জাহাজটিতে মাস্টারসহ বেশ ক’জন কর্মচারী ছিল। তাদেরকে হার মানাতে যারা এসেছিল, তাদের সংখ্যা ওদের চেয়ে বেশি হওয়ারই কথা। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাহাজটি একটি খালের মধ্যে নোঙর করা ছিল এবং এর আশপাশের এলাকা ছিল জনশূন্য। খুনির দল এ জনশূন্যতার সুযোগ গ্রহণ করেছে। পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, নৌ-পুলিশের ঘাটতিও অপরাধীদের অপরাধকর্মে উৎসাহিত করেছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, খুনিরা মানিব্যাগ নেয়নি, মোবাইলও নেয়নি। তাহলে তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল? ঘটনার প্রাথমিক বিবরণ দেখে মনে হয়, টাকা-পয়সা কিংবা মূল্যবান কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য হামলা চালায়নি। তাদের আরও কোনো বড় ধরনের মতলব থাকতে পারে। একসঙ্গে সাতজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং আরও একজনকে গুরুতরভাবে আহত করে এ খুনির দল আসলে কী অর্জন করতে চেয়েছিল। এ ঘটনা কি আরও নতুন নতুন টেরোর সৃষ্টি করার প্রয়াস? এরা কি দেখাতে চেয়েছিল এদের নৌপথে চলাচল নিরাপদ নয়? আর এভাবেই তারা চেয়েছিল নৌপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের পণ্যসামগ্রী পরিবহণ ও যাতায়াত বিপদসংকুল করে তুলতে! তারা কি চেয়েছিল তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করতে। সাত খুনের ভয়াবহতা যদি আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবার সুযোগ করে দেয়, তাহলে ভালো, অন্যথায় বিপদ আরও ঘনীভূত হতে থাকবে। দেশে পুলিশ বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে এ ধরনের ঘটনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ মুহূর্তে প্রয়োজন নতুন করে নিরপেক্ষতার সঙ্গে পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা, যে বাহিনী দলত্যাগী গণবিরোধী পুলিশদের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে। সরকারকে সক্রিয়ভাবে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম