Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ রূপ

Icon

এমএ হালিম

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ রূপ

ফাইল ছবি

২৬ ডিসেম্বর ২০০৪, ভোর ৬টা। আমি তখন হাতিয়ার ওসখালীস্থ (উপজেলা সদর) রেড ক্রিসেন্ট অফিস কম্পাউন্ডের পুকুর ঘাটে বসে শীতের শিশির ভেজা ভোর উপভোগ করছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম, পুকুরে পানি মৃদু ঢেউ আকারে পাড়ে আঘাত করছে, যদিও শীতের সেই সকালে বাতাস বা প্রতিকূল আবহাওয়া কোনোটাই ছিল না। একটু পরেই হাতিয়ায় আমাদের অফিসার মোবাইলে বলল, স্যার ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি হয়েছে। আমি তখন অনুধাবন করলাম শান্ত পুকুরের হঠাৎ অশান্ত হওয়ার কারণ। এরপর যতই সময় ও দিন গড়ায়, ক্রমশ জানতে পারি ইতিহাসের সেই মহাদুর্যোগের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতার খবর। প্রসঙ্গত, সমুদ্রে বড় ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হলে পানি উপচে তীব্র গতির ঢেউ সৃষ্টি হয়, সেটাই সুনামি, যা প্রবল বেগে উপকূলের দিকে ধেয়ে যায়। ২৬ ডিসেম্বর সংঘটিত সুনামির সূত্রপাত ছিল ভারত মহাসাগরে সকাল ৫.৫৮টায় সংঘটিত ৯.২ মাত্রার উচ্চ শক্তির ভূমিকম্প। এর কেন্দ্র (এপিসেন্টার) ছিল উত্তর সুমাত্রা সমুদ্র উপকূল থেকে ১৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে; সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩০ কিলোমিটার গভীরে ইন্ডিয়ান ও মিয়ানমার প্লেটের সংঘর্ষজনিত কারণে এর সূত্রপাত।

ভারতের আন্দামান ও নিকোবার আইল্যান্ড থেকে শুরু করে এপিসেন্টারের ৫ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আফ্রিকার সোমালিয়া দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ১৪টি দেশে সুনামির ধ্বংসলীলা চলে। মৃত্যু হয় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের, যার মধ্যে একমাত্র ইন্দোনেশিয়াতেই সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩১ হাজার। তবে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সংশয় ছিল। সুনামি পরবর্তীকালে রেড ক্রসের মিশনে থাকাকালে বিভিন্ন সূত্র মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষাধিক বলত, যা আমার মতো অনেকেরই বিশ্বাস হতো। কারণ, আচেহ প্রদেশের বিভিন্ন শহর-গ্রাম-জনপথ ঘুরে জেনেছি, প্রতিটি পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই প্রাণ হারিয়েছেন, না হয় নিখোঁজ হয়েছেন। অনেক বিদ্যালয় ঘুরে জেনেছি, তাদের ৫০ শতাংশেরও বেশি ছাত্রছাত্রী সুনামি-পরবর্তীকালে আর বিদ্যালয়ে ফেরেনি।

যা হোক, যে কোনো শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর অনেক ছোট-বড় ভূমিকম্প হয়, যাকে বলে আফটার শক। ভারত মহাসাগরীয় ভূমিকম্পের পরও অনেক ভূমিকম্প হয়েছিল, যার মধ্যে ২৮ মার্চ (২০০৫) রাত ১১.০৯টায় সুমাত্রা প্রদেশের নিয়াস আইল্যান্ডে ৮.৭ মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প ও স্থানীয় সুনামি হয়। উল্লেখ্য, ১৭ হাজারের উপর দ্বীপসংবলিত ২৪ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে ছোট ও মৃদূ ভূমিকম্প একটি স্বাভাবিক ঘটনা। নিয়াস ভূমিকম্পের পর আমি আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশনের (আইএফআরসি) ডেলিগেট হিসাবে সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করি ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা ও মানুষের দুর্ভোগ। সুনামিতে একমাত্র ইন্দোনেশিয়াতেই অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ১০ বিলিয়ন ডলার। আমার অভিজ্ঞতা হয় প্রায় প্রতিদিনই এক বা একাধিক আফটার শক অনুভবের। প্রথমদিকে একটু ভয় করলেও পরে তা স্থানীয় অধিবাসীদের মতোই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

সুনামির পরক্ষণেই ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবিক ও উন্নয়ন সংস্থা দুর্গতদের মধ্যে মানবিক সেবায় এগিয়ে আসে। শুরু হয় ব্যাপক উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম। দুই সহস্রাধিক সংস্থার কার্যক্রমের সুষ্ঠু সমন্বয় এক বড় চ্যালেঞ্জ বলে প্রতীয়মান হয়। পরিস্থিতির ব্যাপকতা নির্ধারণ এবং দক্ষ সমন্বয় নিশ্চিত করার জন্য ইন্দোনেশিয়া সরকার রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন বিষয়ক একটি বিশেষ কর্তৃপক্ষ গঠন করে, ইন্দোনেশিয়া ভাষায় যার নাম বাদান রিহ্যাবিলিটাসি দান রিকনস্ট্রাকসি বা বেএরএর।

যে কোনো দুর্যোগের ফলে মানবিক দুর্দশা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তবে ভারত মহাসাগরীয় সুনামির ব্যাপকতার কারণে মানুষের দুর্ভোগ ছিল কল্পনাতীত। সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ বিতরণ ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমন্বিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা কমাতে বেগ পেতে হয়। নিয়াস ভূমিকম্পের পরক্ষণে এবং সুনামির ১০ মাস পরও আচেহ প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় ধ্বংসলীলার স্পষ্ট নিদর্শন দেখেছি। জেনেছি ও উপলব্ধি করেছি পরিবারের সদস্য ও আপনজন হারানোর ফলে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বা ট্রমার কথা। তাই সুনামি পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংস্থা তাদের পরিকল্পনায় ত্রাণের পাশাপাশি সাইকো-সোশ্যাল সাপোর্ট কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করে। তবে গতানুগতিকভাবেই সমন্বয়হীনতা ছিল এক স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ। এছাড়া মানবিক সংস্থাগুলোর মধ্যে একরকম ‘অতি মানবিক হওয়ার প্রতিযোগিতা’র কারণে বিভিন্ন সেবা প্রদানে অতিমাত্রায় ব্যয় ছিল দৃষ্টিকটু। সমালোচনা ছিল, আচেহ প্রদেশের বিভিন্ন গ্রামে পানি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন সংস্থার যে সম্মিলিত ব্যয় হয়েছে, তা দিয়ে গোটা আচেহ প্রদেশে বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার সরবরাহ সম্ভব। এছাড়া বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তাদের নিজস্ব অগ্রাধিকার বিবেচনায় অনেক ক্ষেত্রেই একই কাজ বা সেবা একই জেলায় বাস্তবায়ন করেছে। আবার সম্পদের প্রাচুর্যতা সত্ত্বেও অনেক এলাকায় সময়মতো সহযোগিতা পৌঁছানো নিশ্চিত করা যায়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা চক্রের অন্যতম উপাদান (কম্পোনেন্ট) হিসাবে দুর্যোগের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে। আচেহ প্রদেশের অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারই বিভিন্নভাবে উন্নয়নের সুযোগে পেয়েছে; যেমন-নতুনবাড়ি, সম্মানজনক কর্মসংস্থান বা জীবিকায়ন ইত্যাদি। এছাড়া সামাজিক অনেক উন্নতিও ঘটেছে; যেমন-নতুন নতুন রাস্তাঘাট, প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থায়ী পানির উৎস, কমিউনিটি সেন্টার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণ ইত্যাদি। আচেহ প্রদেশে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন ঘটেছে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। দুর্যোগ সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠারও সুযোগ আনে। ১৯৭৬ সাল থেকে আচেহ স্বাধীনতা আন্দোলন (ফ্রি আচেহ মুভমেন্ট, ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় গারাকান আচেহ মেরডেকান বা গ্যাম) চলছিল, যে আন্দোলনে ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু সুনামি-পরবর্তী নির্বিঘ্ন ও সম্মিলিত দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলার স্বার্থে ২০০৫ সালের ১৫ আগস্ট সরকার ও গ্যামের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়।

সুনামির অভিজ্ঞতার আলোকে ইন্দোনেশিয়ার পুরোনো দুর্যোগ মোকাবিলা কাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করে, যেখানে বহুমাত্রিক দুর্যোগপ্রবণ দেশটির বিভিন্ন উদ্যোগে সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন এজেন্সির ভূমিকা ও দায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, আইনটি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ফোরামে অংশগ্রহণের সুযোগে আমি আমাদের এসওডি ও তার উল্লেখযোগ্য বিষয়, বিশেষত জাতীয় পর্যায় থেকে ওয়ার্ডভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি (ডিএমসি) এবং তাদের ভূমিকার কথা জানাই। অবশ্য বাংলাদেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় রোল মডেল হিসাবে অনেকেই জানে। তাই বিভিন্ন ফোরামে আমি বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশিরা এক হলে অনেকেই ঠাট্টা করে বলত, ‘হাই, বাংলাদেশি ডিজাস্টার মাফিয়া!’

ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করতে গিয়ে পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার থেকে জানার গুরুত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করেছি; যেমন-এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সিমোলুতে সুনামিতে কোনো প্রাণীরই মৃত্যু হয়নি। কারণ, তারা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে জেনেছে, সমুদ্র পাড়ের পানি হঠাৎ অনেক গভীরে নেমে গেলে সুনামি হয়। ২৬ ডিসেম্বর জেলেরা ও সমুদ্র উপকূলে বসবাসকারীরা সকালে পানি অনেক গভীরে সরে যেতে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রামবাসীকে জানায় এবং তারা সবাই দ্রুত পাহাড়ে উঠে যায়। ২০ মিনিট পরে সংঘটিত সুনামিতে তাদের সম্পদের ক্ষতি হলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক National Oceanic Atmosphere Administration (NOAA) কর্তৃক পরিচালিত Pacific Tsunami Warning System ১৯৪৮ সাল থেকে সুনামি সংকেত প্রচার করে আসছে, যদিও সতর্কতা জারির ১০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই সুনামি ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে সতর্কতা প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৪ সালের সুনামি-পরবর্তীকালে International Oceanic Commission (IOC) ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য সুনামি পূর্বাভাস কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০০৫ সালে থাইল্যান্ড সর্বপ্রথম সুনামি পূর্বাভাস সিস্টেমের সূচনা করে।

সুনামির ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি ইন্দোনেশিয়া ও অপর দেশগুলোর কমিউনিটির স্থানীয় সক্ষমতাকে জানার ও সমৃদ্ধ করার উৎসাহ জোগায়। অনেক প্রত্যন্ত গ্রামের জনগোষ্ঠী তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যে ভবিষ্যতে সুনামি অথবা যে কোনো দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব, এমন কথা বিশ্বাস করেনি; বরং জানতে চেয়েছে, এসব কার্যক্রম করে তাদের লাভ কী? বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিসহ আরও অনেক ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচি এবং অন্যান্য দেশের দুর্যোগ সহযাত্রীদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা ও সফলতার কথা জেনে তাদের মধ্যে আস্থা জন্মায় যে, তারা নিজেরাই ঝুঁকি কমাতে সক্ষম। প্রায় তিন বছর সেখানে অবস্থানকালে ছোট-বড় অনেক দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের স্বপ্রণোদিত অংশগ্রহণ এর সাক্ষ্য দেয়।

ইন্দোনেশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় সুনামির সবচেয়ে বড় শিখন হলো, বিশ্ব সম্প্রদায়ের সংহতি (সলিডারিটি)। জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো এবং অর্ধশতাধিক জাতীয় রেড ক্রস সোসাইটি, আইসিআরসি-আইএফআরসিসহ বিশ্বের সব উন্নয়ন ও মানবিক সংস্থা সেই মানবিক বিপর্যয় কাটাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়ায়। আমেরিকা এবং পাশ্চাত্য অনেক দেশ বিশ্বব্যাপী অনেক যুদ্ধ ও জাতিগত দ্বন্দ্বে ইন্ধন দিলেও ও জিইয়ে রাখলেও সুনামিজনিত মানবিক বিপর্যয় উত্তরণে সবারই লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন; অর্থাৎ মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ, যা সমকালীন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক যুদ্ধ অথবা দ্বন্দ্ব প্রশমনে অনুকরণীয় হতে পারে।

এমএ হালিম : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি; দুর্যোগ, জলবায়ু ও মানবিকবিষয়ক বিশ্লেষক

halim_64@hotmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম