সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এক ধাপ অগ্রগতি

এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত তিন দশক ধরে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে, তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১৯৯৬ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক মাঠ সরগরম রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর যৌথ রাজনৈতিক আন্দোলনের ফল ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা। এটি জামায়াতে ইসলামীর ব্রেইন চাইল্ড হলেও তার সফল পরিণতি হয়েছিল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফলেই।
আন্দোলনের ফলে বিএনপি তাদের এ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বিএনপি মাগুরা নির্বাচনের মতো একটি বিতর্কিত নির্বাচন করে এবং সে সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ হয়। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারই একটি উত্তম বিকল্প এবং এ পর্যন্ত এর চেয়ে ভালো কোনো নির্বাচনি সরকার বাংলাদেশে হয়নি। এটি অবশ্যই একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি নয়-শুধুই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন পরিচালনা করা ও নির্বাচিত সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই সম্পন্ন করেছি। স্বাধীনতার পর ১৯৯১-এর নির্বাচন বাদে ওই তিনটি নির্বাচনের চেয়ে ভালো নির্বাচন আমরা হতে দেখিনি। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনা না করলেও সেটিও কার্যত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ছিল, নির্বাচিত সরকার ছিল না। তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করে যে যার কাজে চলে গেছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীন বিচারাঙ্গনে ফিরে গেছেন। এরপর রাজনৈতিক অঙ্গনে বহু জল গড়িয়েছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মীমাংসিত রাজনৈতিক ইস্যুকে আবার সামনে নিয়ে আসে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন শুরু করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল ২৯১-১ ভোটে পাশ হয়েছে। একমাত্র বিরোধিতাকারী ছিলেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের বেশকিছু জায়গায় পরিবর্তন আনা হয়। তার মধ্যে বড় পরিবর্তনটি ছিল ত্রয়োদশ সংশোধনীর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেওয়া। নতুন করে আরও কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলো, যেগুলো ছিল মূলত আওয়ামী লীগের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের একেকটি অজুহাত মাত্র। সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতার বিধান সংযুক্ত করা হলো। সংবিধান দ্বারা জাতির পিতা নির্ধারণের এমন নজির আর নেই। জাতির পিতা একটি সর্বজনীন ও জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়। সংবিধান দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া বা তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি অর্জন করা কোনো কথা হতে পারে না এবং এসব অমান্য করলে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা মধ্যযুগীয় রাজতান্ত্রিক ধারণারই নামান্তর।
এছাড়া বলপ্রয়োগ করে সংবিধান সংশোধন, বাতিল, স্থগিত ও সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থাহীনতা সৃষ্টি ইত্যাদি এবং এ কাজে সহযোগিতা বা উসকানি প্রদান ও সমর্থন রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসাবে চিহ্নিত হলো। আপাতত কথাগুলো শ্রুতিমধুর মনে হলেও এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি হাসিল করাই ছিল কাম্য। পরপর তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করে সরকার গঠন করার পর সংবিধানের দোহাই দিয়ে এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করাও হতে পারে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এটি স্বৈরশাসন ও সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ কায়েমের একটি সংশোধনী ছিল। আদালত সেটি বাতিল করেছেন।
তবে পঞ্চদশ সংশোধনীতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও আনা হয়। নারী আসন বাড়ানো হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের সব ইতিবাচক পরিবর্তনকে পাশ কাটিয়ে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসহ অপরাপর সংশোধনী আমাদের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকেই ব্যাহত করেছে। এ সংশোধনী একদলীয় ও এক পরিবারের শাসনকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা অপরাপর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়নের কোনো বিধান এতে যুক্ত হয়নি।
সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের আগে সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। যে কমিটিতে বিএনপির কেউ ছিলেন না। কমিটি সে সময় ২৭টি বৈঠক করে। এছাড়া কমিটি তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১১ শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ১৮ বুদ্ধিজীবী, ১৮ জন সম্পাদক, রাজনৈতিক দল ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নেতাদের মতামত নেয়। তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার বিপক্ষে মতামত দেন। কিন্তু সরকার সে কথা রাখেনি। সংসদকে ব্যবহার করে সবাইকে উপেক্ষা করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়। এমনকি বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের দোহাই দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় আসার আগেই সংসদে বিল পাশ করার নমুনা সৃষ্টি করা হয়।
কিন্তু ২০১১ সালের ১০ মে এক সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছিল, ‘The Constitution (Thirteenth Amendment) Act, 1996...is prospectively declared void and ultra vires the Constitution.’ অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ও অসাংবিধানিক। কিন্তু এর পরেই বলা হয়েছে, ‘The election to the Tenth and the Eleventh Parliament may be held under the provisions of the above mentioned Thirteenth Amendment on the age old principles, namely, quod alias non est licitum, necessitas licitum facit (That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful), salus populi suprema lex (safety of the people is the supreme law) and salus republicae est suprma lex (safety of the State is the Supreme Law).’ কিন্তু সরকার সুবিধামতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করল। কিন্তু পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই করার যে মতামত দেওয়া হয়, তা পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়। তৎকালীন সরকার জনগণের নিরাপত্তা তথা তাদের ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকার পরের তিনটি প্রহসন নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থেকেছে। ফলে আজ আমাদের জনগণের তথা আমাদের ভোটের, এমনকি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ করার ব্যবস্থা করেছে।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর গত ১৮ আগস্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে রিট আবেদন করা হয়। গতকাল এর রায় প্রকাশ পেল। পুরো রায় এখনো হাতে আসেনি। এ রায় অনুযায়ী পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের কিছু ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হলো। কারণ, সংবিধান বলছে, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা সংবিধানের মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক যে কোনো আইন ও সংশোধনী বাতিলযোগ্য। আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ৭ক,৭খ, ৪৪(২) সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিলযোগ্য। ৭ক বলছে, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে-তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। এছাড়া (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। এ বিষয়ে আগেই বলা হয়েছে। ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গদিতে থেকে গেলে তার বিরুদ্ধে কথা বললেই যদি সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়, তবে সে সংশোধনী শুধু আইনগতভাবেই বাতিলযোগ্য নয়, নৈতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাও সংবিধানের মূল নীতির বিরোধী।
তবে আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটাই বাতিল করে দেননি। যেগুলো বাতিল করা হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে আগামী সংসদের। এছাড়া সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তিসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ গণভোটের বিধানও ফিরে এসেছে।
সংবিধান বা আইন যে কোনো সংশোধনী-পরবর্তী সময়ের জন্য কার্যকর হয়। ভবিষ্যতে সংবিধান যদি নতুন করে সংশোধন হয়, সে অনুযায়ী আগামী নির্বাচন হবে। যেহেতু এ রায়ের মাধ্যমে আপনা-আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা পাবে না, তাই এর অধীনে আগামী নির্বাচনের বিষয়টিও আসে না।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক