স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনাপর্ব

সালেহ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সাংগঠনিক কাঠামো ও মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল, ১৯৬৯-এর পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। দেশের অন্যান্য ঐতিহাসিক আন্দোলনের মতো ১৯৬৯-এর আন্দোলনও শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নেতৃত্বে।
উনসত্তরের আন্দোলন নিয়ে খুব একটা লেখালেখি বা বিশ্লেষণ হয়নি। এর প্রধান কারণ সম্ভবত ১৯৬৯ ও ১৯৭১-এর মাঝে সময়ের দূরত্ব। ১৯৬৯-এর রেশ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় ১৯৭১-এর সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাকিস্তানি বাহিনীর সীমাহীন বর্বরতা ও বাংলার মানুষের দুর্বার প্রতিরোধের অসংখ্য ঘটনাবলির মাঝে চাপা পড়ে যায় ১৯৬৯-এর অনেক না-বলা কাহিনি।
সময়টা ১৯৬৯। ঘটা করে পালিত হচ্ছে আইয়ুব খানের বাংলাকে শোষণের আরও এক দশক, সরকারি নাম ‘ডিকেড অফ রিফরমস’। চারদিকে খুব ধুমধাম, আইয়ুব শাসনের এক দশক সম্পন্ন হলো। পাকিস্তানের সরকারি মাধ্যমগুলোতে সারাক্ষণ প্রচারিত হচ্ছে আইয়ুব খানের জয়জয়কার। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর মোনেম খানের নেতৃত্বে একদল তোষামোদকারী বাঙালিও ঢাকঢোল নিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সভাতে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বতন্ত্র ও স্বাধিকারের ঘোষণা দেন। অন্যদিকে, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে চিরতরে পাকিস্তানের কলোনি বানিয়ে রাখার জন্য ষড়যন্ত্রের নীল নকশার বাস্তবায়ন শুরু করে। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার একটা প্রেস নোট জারি করে। সেখানে বলা হয়, পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার একটা নীলনকশা তৈরি করা হয়েছে আগরতলায়। ১৮ জানুয়ারি ঘোষণা করা হয়, এ ষড়যন্ত্রের প্রধান আসামি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯ মে আরও কয়েকজনসহ শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে জেলখানায় নেওয়া হয়। শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি করে বিচার শুরু হয় বিশেষ সামরিক আদালতে। চারদিকে থমথমে ভাব। ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশ। রাজনৈতিক নেতারা সবাই কারারুদ্ধ বা পলাতক।
রাজনৈতিক নিগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়। বাংলা ভাষাকে উর্দুকরণ করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। ‘বিমান’ হয়ে যায় ‘হাওয়াই জাহাজ’, ‘সংবাদ’ হয় ‘সমাচার’। মাঝে মাঝে শুধু প্রতিবাদ শোনা যেত সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে। রমনার বটমূলে রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের সংখ্যা বেড়ে হয় দশগুণ। শামসুর রাহমানের ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাটি খুব আলোড়ন সৃষ্টি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে আইয়ুব-মোনেমের আজ্ঞাবহ এনএসএফের দৌরাত্ম্যে প্রগতিশীল ছাত্রমহল তখন একদম কোণঠাসা। এমনই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ।
আস্তে আস্তে প্রতিবাদের কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। তোফায়েল আহমেদ তখন ডাকসুর সহ-সভাপতি। ডাকসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। মূল লক্ষ্য, সব রাজবন্দিকে কারাগার থেকে বের করে আনা। আগরতলা ষড়যন্ত্রের উদ্ধত ছোবল থেকে বাঁচাতে হবে বাংলার সেই সাহসী মানুষগুলোকে। নতুবা এদের সবার ফাঁসি হয়ে যাবে সামরিক আদালতে। মোট এগারো দফার ভিত্তিতে তাই আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের দেওয়া ছয়দফা দাবিও হয় এর অন্তর্ভুক্ত।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে প্রথমে ছিল শুধু ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া/সামসুদ্দোহা)। ছাত্রলীগ তখন ভাগ হয়নি, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ববৃহৎ দল। প্রতিদিন সভা হতো বটতলায়। বক্তৃতা করতেন তোফায়েল আহমদসহ অন্য ছাত্র নেতারা। প্রথমে খুব ছোট পরিসরে সমাবেশ হতো। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে ছাত্রদের অংশগ্রহণ। যোগ দেয় বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও ইসলামি ছাত্র সংঘের মতো অন্য ছাত্র দলগুলোও। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ছিল চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলনের সমর্থক। পশ্চিম বাংলায় তখন নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে। যদিও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিল খুব সীমিত, বটতলায় এদের দেখা যেত মাথায় লাল ফিতা বেঁধে বেশ জঙ্গিভাবে মঞ্চের কাছে স্লোগান দিতে। আস্তে আস্তে বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও মিছিল করে সমাবেশে আসতে শুরু করল। ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ প্রায়ই আসত। একদিন হঠাৎ একটা নতুন মিছিল এলো, ধানমন্ডি রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে। আমরা সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে দেখলাম সেই অল্পবয়সি ছেলেগুলোকে।
এদিকে আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে লাগল। সরকারি প্রতিরোধও বাড়তে থাকল। ছাত্ররা চেষ্টা করত মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট দিয়ে বের হতে। কোনোভাবেই তা সম্ভব ছিল না। প্রতিদিনই পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস প্রতিরোধ করত মিছিলের যাত্রা। তবে যতই প্রতিরোধ বাড়ল, আন্দোলন আরও তীব্রতর হলো, সমাবেশও বড় হতে থাকল।
তখন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নাজিম কামরান চৌধুরী, এনএসএফের নেতা, সরকারি দলের সমর্থক। এর মধ্যে এনএসএফ ভাগ হয়ে গেল দুই গ্রুপে। একদল জমীর আলীর নেতৃত্বে মোনেম খানের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট। অন্য গ্রুপ মাহবুবুল হক দোলনের নেতৃত্বে মোনেম খানের স্নেহবঞ্চিত। কিন্তু দুই গ্রুপই আইয়ুব খানের সমর্থক। নাজিম কামরান চৌধুরী দোলন গ্রুপের নেতা। স্রেফ মোনেম খানকে জব্দ করার জন্য দোলন গ্রুপও আন্দোলনে যোগ দিল। গড়ে উঠল আট দলের এক বড় কোয়ালিশন।
আন্দোলন তখন তুঙ্গে। প্রতিদিনই বটতলায় সভা হতো। সবদলের নেতা-কর্মীরা রীতিমতো যোগ দিতেন সভাতে। নিজ নিজ দলের স্লোগান ও কর্মসূচি প্রাধান্য পেত তাদের নিজ নিজ গণ্ডিতে, বক্তৃতা ও স্লোগানে। প্রতিটা সভায় নিজ নিজ দলের প্রাধান্য বিস্তারের প্রবণতা ছিল দর্শনীয়। ছাত্রলীগের মূল স্লোগান ছিল ছয় দফাভিত্তিক, শেখ মুজিবকে মুক্ত করার অঙ্গীকার ও বাংলার স্বাধীনতাভিত্তিক। ছাত্র ইউনিয়নের মূল দাবি মনি সিংকে মুক্ত করা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের স্লোগান ছিল নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা। ইসলামি ছাত্র সংঘ মূলত ধর্মভিত্তিক বক্তব্য প্রকাশ করত। দোলনপন্থিরা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কিছু বলত না, তাদের মূল স্লোগান ছিল মোনেম খানের বিরুদ্ধে। প্রায়ই নতুন নতুন স্লোগান শোনা যেত। প্রতিটা স্লোগানের ভাষা, তাল ও সুর থাকত ভিন্ন। অনেক সময় একই স্লোগানকে নানা সুরে উচ্চারণ করা হতো। স্লোগানে মূলত প্রাধান্য থাকত ছাত্রলীগের। দল হিসাবে ছাত্রলীগ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তখন বিপুলভাবে জনপ্রিয়। ছাত্রলীগের আফম মাহবুবুল হক, আফতাব আহমদ, কুমিল্লার নজরুল ইসলাম, হিলালুর রহমান চিশতী (৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ)-এরা ছিলেন স্লোগানে দারুণ পারদর্শী। এরাই ছাত্রলীগের মিছিলে স্লোগানের নেতৃত্ব দিতেন। অন্য দলগুলোকে সৃজনশীল হতে হতো ছাত্রলীগের সঙ্গে তাল মেলাতে।
একদিন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা লাল ফিতা মাথায় বেঁধে মঞ্চের সম্মুখটা অনেকটা জোর করে দখল করে ফেলল-‘বিপ্লব, বিপ্লব, বিপ্লব’-খুব দ্রুতলয়ে স্লোগান দিয়ে এগিয়ে, অন্য দলের কর্মীরাও চেষ্টা করল বিপ্লবীদের সামনে থেকে হটাতে, নিজ দলের স্লোগান দিয়ে। কোনোভাবে সুবিধা হলো না। পরের দিনও বিপ্লবীদের প্রাধান্য, ‘বিপ্লব, বিপ্লব’ দ্রুতলয়ের স্লোগান দিয়ে। ছাত্রলীগের কর্মীরাও দ্রুতলয়ের স্লোগান বের করল ‘বাংলা, বাংলা, বাংলা’। এভাবে স্লোগান, পালটা স্লোগান আর প্রাধান্যের পালটাপালটি চেষ্টা চলতে থাকল। হঠাৎ ছাত্রলীগের ব্লক থেকে কে যেন বলে উঠল ‘জয় বাংলা’। আর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের সব কর্মী মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’ বলে। ‘জয় বাংলা’র তীব্রতার মাঝে হারিয়ে গেল বিপ্লব। ছাত্রলীগ ফিরে পেল তার প্রাধান্য। এরপর ‘জয় বাংলা’ ছাত্রলীগের মুখ্য স্লোগান হয়ে গেল। ক্রমান্বয়ে ‘জয় বাংলা’ অন্য দলগুলোর মধ্যেও গ্রহণযোগ্যতা পেল। সত্তর-একাত্তরে এটা হয়ে উঠল বাংলার মানুষের দাবি আদায়ের মুখ্য স্লোগান।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে দলীয়করণ করে বন্দি করেছিল দলীয় স্লোগানের রেকর্ডারে। তাদের শাসনকালে এটাকে সরকারিকরণ করে চাপিয়ে দেওয়া হয় মানুষের মুখে। যে স্লোগানটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতীক, তা হয়ে গেল জোর করে চাপিয়ে দেওয়া দুটি শব্দ। এই আন্দোলনে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি শহিদ হয়েছিলেন সূর্য সেন হলের (তখনকার জিন্নাহ হল) আসাদ। এতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাঞ্জাবি পাহারাদারদের অবজ্ঞা করায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আরেক আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে খুন করা হয়। জহুরুল হকের মৃতদেহ দেখার জন্য তার বড় ভাইয়ের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র ভিড় জমায় ও পরে জানাজায় অংশ নেয়। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা সেনাবাহিনীর বেয়নেট চার্জে মৃত্যুবরণ করেন। ছাত্র জনতা একসময় আইয়ুব খানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের ঢাকার পরীবাগের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। একের পর এক এই ঘটনাগুলো আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে এবং আইয়ুব খানের ক্ষমতার আসনকে টলমল করে তোলে।
১৯৬৯-এর আন্দোলন ছিল অভাবনীয়ভাবে সফল। গণআন্দোলনের চাপে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্রের লৌহ কপাট ছিন্ন করে শেখ মুজিবসহ সব বন্দিদের মুক্ত করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রমনা রেসকোর্সের মাঠে শেখ মুজিবকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
এই আন্দোলনের পর আইয়ুব খানের পক্ষে আর ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। মার্চের ২৫ তারিখ আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদ ত্যাগ করেন। এরপর সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসেন। তাই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানই রচনা করে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি। ১৯৭১ সালে বীর বাংলাদেশিরা যুদ্ধ করে অর্জন করেছে ভৌগোলিক ও জাতীয় স্বাধীনতা। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নিয়মতান্ত্রিকতায় ফিরে আসার সংগ্রাম এখনো চলছে। আশা করব, বাংলাদেশের তরুণ সমাজ তাদের পূর্বসূরিদের ভুলে যাবে না এবং উনসত্তর ও একাত্তরের ধারাবাহিকতায় এ সংগ্রামেও তরুণরা জয়ী হবে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ : লেখক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ডাকসুর সাবেক সম্পাদক (১৯৭০-৭২)
salehpublic711@gmail.com