Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জনগণের অনেক চাওয়া চলে যাচ্ছে আড়ালে

Icon

মো. মুজিবুর রহমান

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জনগণের অনেক চাওয়া চলে যাচ্ছে আড়ালে

দেশে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকটি এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবত এটি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশের সর্বত্র এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

একইসঙ্গে জনদুর্ভোগের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসছে। সাধারণ মানুষ সবসময় এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ ছাড়া চলাফেরা করতে গিয়ে নতুন নতুন আন্দোলনের মুখে কে, কখন, কোথায় কী ধরনের বাধা-বিঘ্নের মুখে পড়বেন-এটি সম্পূর্ণরূপে অজানা থাকায় সেটাও দুশ্চিন্তার আরেক বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

অথচ নতুন সরকারের কাছে জনগণের যেসব চাওয়া ছিল, সেগুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা আনয়ন, দুশ্চিন্তামুক্ত নিরাপদ কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা, নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, নগর-মহানগরকে যানজটমুক্ত করে গড়ে তোলার প্রত্যাশা ছিল অনেক।

এছাড়া আরও একটি বড় রকমের জনপ্রত্যাশার কথা এখানে উল্লেখ করা সমীচীন বলে মনে করি। সেটি হলো, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভোটারদের পছন্দমতো ও অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে জনরায় পাওয়া দলের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা;

কিন্তু আমরা দেখছি, বিভিন্ন দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে আন্দোলন ও অবরোধের ফলে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চাপে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের চাওয়াগুলো কার্যত আড়ালে চলে যাচ্ছে! শুধু দাবি আদায়ের জন্য গত কয়েক মাসে দেশে যতগুলো আন্দোলন-অবরোধ হয়েছে, সে রকমটি এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

যুগান্তরের অনলাইনে (২৮.১১.২৪) প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রায় চার মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন শতাধিক আন্দোলন হয়েছে। দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেসব আশা ও আকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছিল, এখন বিভিন্নমুখী দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের মুখে সেগুলোও চলে যাচ্ছে আড়ালে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে বহুমুখী আন্দোলন-অবরোধের নামে দেশের জনগণের জন্য নানা ধরনের দুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব দুর্ভোগ সৃষ্টি করার ঘটনা কোনো বড় রকমের অপরাধ কিনা, সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এবং আদালতের।

কিন্তু সাধারণ মানুষ দেশের সরকার পরিচালনার কার্যপদ্ধতি, পুলিশ ও আইন-আদালতের কার্যক্রমের অনেক কিছু না বুঝলেও অন্তত এসব আন্দোলন-অবরোধের মুখে তাদের যে সীমাহীন কষ্ট ও দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে, সেটা পরিষ্কারভাবে ঠিকই বুঝতে পারছে। তারা দেশের আইন-আদালতকে অবজ্ঞা করে না কখনো। কিন্তু কারা এবং কীভাবে দেশের আদালতের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে, তার একটি দুঃখজনক নমুনা সম্প্রতি দেখা গেছে চট্টগ্রামে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, সমাজে বসবাসকারী অনেকের ভেতর আদালতকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, কোনো একটি মামলার রায়ে বিচারপতির করা মন্তব্যের জেরে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে প্রথমে হট্টগোল ও একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটে। এরপর ওই বেঞ্চের দুই বিচারপতি এজলাস থেকে নেমে যান।

এটা কী ধরনের আচরণ এবং এগুলো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে কিনা, তা ওই আইনজীবীরা ভালো বলতে পারবেন। মামলার রায়ে আপত্তিজনক কোনোকিছু থাকলে তা আইনি উপায়ে নিষ্পত্তি করার পথ তো আইনজীবীদের অজানা ছিল না। তাহলে আদালতে এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসহিষ্ণু আচরণের প্রকাশ কেন? আমরা মনে করি, এ ধরনের পরিস্থিতি কাম্য নয় কিছুতেই। এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

এদিকে চট্টগ্রামের আদালত অঙ্গনে যে ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেল, তা স্বাভাবিকভাবেই এক অচিন্তনীয় ব্যাপার। সম্প্রতি একটি ধর্মীয় সংগঠনের নেতা হিসাবে পরিচিত একজনকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রামে একটি আদালতে তোলে। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া শেষে আদালত ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন।

পরে পুলিশ কর্তৃক ওই ব্যক্তিকে জেলহাজতে নিয়ে যাওয়ার পথে আদালত অঙ্গন থেকেই তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তার একদল সমর্থক সংঘবদ্ধভাবে প্রিজনভ্যানে হামলা করে। এ ধরনের হামলার ঘটনা যে দেশে আগে কখনো ঘটেনি, তা নয়। তবে এবারের ঘটনার সঙ্গে পূর্বেকার সংঘটিত সব ঘটনার পার্থক্য হলো, এবার জেলহাজতে পাঠানোর আদেশাধীন একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বলপূর্বক ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে পুলিশের উপস্থিতিতে প্রিজনভ্যানে হামলা করা হয়।

এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে অত্যন্ত নৃশংসভাবে আদালত অঙ্গনে একজন তরুণ আইনজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

মানুষ কতটা নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে একজন আরেকজনকে কুপিয়ে মেরে ফেলতে পারে, দেশে এটাই তার প্রথম ও একমাত্র উদাহরণ নয়। এমনকি আদালত অঙ্গন থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টার ঘটনা আগেও ঘটেছে। একজন আরেকজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা কিংবা অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। হত্যাকাণ্ডের চিত্র দেখে মনে হয়, এসব খুন-খারাবি এখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

কিন্তু আসামি ছিনিয়ে নিতে গিয়ে নিরপরাধ আইনজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। এ ঘটনা থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দিকটি বোঝা যায়। এ ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কিনা, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। কারণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এটাই আসল কথা। এ ঘটনার সঙ্গে অন্য কোনো ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে কী নেই, সেটিও বড় বিষয় নয়। তাই ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিংবা পরিকল্পিত, তার বিবরণ উপস্থাপন জরুরি নয় এবং এ রকম ধারণাও সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। আমরা মনে করি, যথাযথ তদন্ত ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে জড়িত দোষীদের দ্রুত খুঁজে বের করা হবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের স্বার্থে উপযুক্ত আদালতের কাছে সোপর্দ করা হবে।

কারণ মানুষের কাছে আদালত এখনো আস্থার জায়গা এবং শেষ ভরসাস্থল। এ দেশের সাধারণ মানুষ কখনো রাষ্ট্রীয় আইনকে অবজ্ঞা করে না, আদালতকে উপেক্ষা করে না, আদালতের মর্যাদাহানিকর কিছু করার চেষ্টা করে না। তারা দুর্নীতি করে না। যারা শিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত, তাদেরই একটা নগণ্য অংশ আদালতকে অবজ্ঞা করে, আদালতের বিরুদ্ধে মিছিল করে, আদালতকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটা ক্ষুদ্র অংশ। অথচ ওই ক্ষুদ্র অংশের দুর্নীতির মাশুল দিতে হয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে; আর্থিকভাবে দুরবস্থায় নিপতিত হতে হয় রাষ্ট্রকে। যারা দুর্নীতি করে, তাদের মনের ভেতরে আইন-আদালত নিয়ে সামান্য পরিমাণ ভয়ডর বলে কিছুই থাকে বলে মনে হয় না।

দেখা যায়, বড় বড় দুর্নীতি করে অনেকেই কী স্বাভাবিকভাবেই পার পেয়ে যায়, এমনকি দেশ থেকেও চলে যায় নির্বিঘ্নে। একসময় অস্বাভাবিক দুর্নীতির সব ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই চাপা পড়ে যায় অন্য ঘটনার আড়ালে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই এ রকম একেকটি অস্বাভাবিক ঘটনা, যা একসময় স্বাভাবিকভাবে হারিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের মতো এসব অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো হারিয়ে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রও কম দায়ী নয়! রাষ্ট্রের কাছ থেকেও এ ধরনের আচরণ কাম্য নয়।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কিত যেসব ঘটনা দেশে ঘটছে, সেগুলো যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে দেশে একটি শান্তিপূর্ণ, অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান বিঘ্নিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এমনকি এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের নির্বাচন প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে তুলতে পারে। এ অবস্থায় সম্মিলিত নাগরিক ও রাজনৈতিক শক্তির সহায়তা ছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সহজ নয় বলে মনে করি।

মো. মুজিবুর রহমান : অধ্যাপক (শিক্ষা) ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ

mujibur29@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম