সংস্কৃতির চর্চাটা ঠিকমতো হচ্ছে তো?
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খবরের ছড়াছড়ি চারদিকে। ফলে খবর জট পেকে যাওয়ায় অনেক খবরের প্রতিই আর মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠে না। এজন্য মাঝে-মধ্যে ঘরের খবর পরের কাছ থেকে শুনতে হয়। তেমনি পশ্চিমবঙ্গের এক পরিচিত লেখক-অধ্যাপক কলকাতা থেকে ফোন করে ‘গুজবে’র সত্যাসত্য জানতে চাইলেন। তিনি কলকাতায় রোকেয়া চর্চার একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বললেন, তারা শুনেছেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে রোকেয়ার নাম সরিয়ে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নাম রাখার জন্য স্মারকলিপি দিয়েছে। আমার কাছে তথ্যটিকে ‘গুজব’ই মনে হলো। তবুও আমি স্নেহভাজন অধ্যাপককে বললাম, আমি খবর নিয়ে জানাব। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে ফোন করলাম। আমি স্তম্ভিত হলাম। ঘটনা নাকি সত্য।
তারপরও গুরুত্ব দিলাম না। ভাবলাম এটি হয়তো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা। মহীয়সী রোকেয়া তো শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের কেউ নন, ‘ফ্যাসিবাদে’র স্মারক সব নাম উচ্ছেদ করতে হবে। আমি তো উলটোভাবে ভাবতে চাই। রংপুরে গড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম মহীয়সী রোকেয়ার নামে করা না হলে বরঞ্চ দাবি জানানোর কথা-আন্দোলন করার কথা। দিনাজপুরে হাজী দানেশের নামে, সিলেটে হজরত শাহজালাল-এর নামে, ত্রিশালে কবি নজরুলের নামে, পাবনায় রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারলে, রোকেয়ার নামে হওয়ায় বাধা কেন! আমি তবুও ঘোর কাটাতে পারলাম না। নিজে নিজেই নিশ্চিত হলাম এমন অসংস্কৃত দাবি নিশ্চয়ই অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর নয়। এখন চারদিকে যেমন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ছড়াছড়ি, তেমন কোনো মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাওয়া হতে পারে এটি। একজন নারীর নামে নামকরণ হওয়াটা সম্ভবত তাদের পছন্দ হচ্ছে না। শুনলাম প্রায় একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কোনো অন্ধকারের শ্বাপদ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ছবি বিকৃত করেছে। অধ্যাপক জানালেন, এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী কেউ এখনো কোনো কথা বলেনি। দেখুন, আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা মতাদর্শের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত সত্য বোঝার চেষ্টা করলাম। তাতে মৌলবাদী দলের সমর্থক শিক্ষকের কাছে অমন দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে। কেউ কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বন করছেন। আবার কেউ কেউ এ ঘটনায় ব্যথিত হওয়ার কথা বলেছেন। জেনে অবাক হলাম, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের নামফলকে বেগম রোকেয়া নামের ওপর কালো কালি লেপন করা হয়েছে।
গত জুলাইয়ে সংঘটিত গণ-আন্দোলন দেশের ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনার নানা অপকাণ্ডের কারণে সত্যিই ফুঁসে উঠেছিল। তারা রক্তমূল্যে জগদ্দল পাথর সরিয়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার পথ তৈরি করেছিল; কিন্তু বিগত তিন মাসে আন্দোলনে মাঠে থাকা ছাত্র-জনতার বড় অংশ হতাশাগ্রস্ত এখন। পেশাগত কারণে ছাত্রদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কথা বলার সুযোগ আমার হয়। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও একাডেমিক কারণে একটি প্রথম শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ রয়েছে। বিগত গণআন্দোলনে ওদেরও যথেষ্ট অবদানের কথা আমরা জানি। দেখলাম, সবার মধ্যেই দিনে দিনে হতাশা বাড়ছে। ওরা অনেকেই বলছে, যারা আমাদের উসকে দিয়ে পথে নামিয়েছে, এখন বুঝতে পারছি, ওরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমাদের ব্যবহার করেছে। আমরা স্বৈরাচারকে বিদায় করতে পেরেছি, সেই তৃপ্তি ঠিকই আছে, কিন্তু যা চাইনি, তেমন একটি পরিবেশের ভেতর আটকে গেলাম। এ গোষ্ঠীটি এখন সবল।
এ কারণেই নানা তথ্য যাচাই করে আমার মনে হলো, স্মারকলিপি সাধারণত যেমন হয় তেমনই। উদ্যোক্তা হয়তো কোনো মতাদর্শের গোষ্ঠী হতে পারে। শক্তিশালী হলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয় অনেককে বা স্বাক্ষর তৈরিও করা হয়। ফলে বলতে হয়, সব শিক্ষার্থীর মতামতের প্রতিফলন এ স্মারকলিপিতে নেই। এটুকু বোধ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিশ্চয় থাকার কথা যে, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শেখ হাসিনা বা স্বৈরাচারের দোসর কেউ নন। নাকি বিশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজের অচলায়তন ভেঙে নারীদের শিক্ষার আলোতে আনাটা অপরাধ হয়ে গেছে রোকেয়ার? তাই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে পরিত্যাজ্য! এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলাম, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম ছাঁটাই করার প্রশ্ন কেন এলো? তিনি বললেন, ওরা চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এটি বিশেষণহীন রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় হোক। যুক্তিটি বড় অদ্ভুত লাগল। হজরত শাহজালাল, হাজী দানেশ, রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মতো ক্ষণজন্মা মানুষের নাম উঠিয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনঃনামকরণের আব্দার নিশ্চয়ই করা হবে না! এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, রংপুরে স্থাপিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ রংপুরেরই কৃতী সন্তান মহীয়সী রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অত্যন্ত অভব্যভাবে এ কৃতী নারীর নাম উঠিয়ে ফেলার জন্য অসংস্কৃত আচরণ করছে কীভাবে! তাহলে এ তালিকায় একমাত্র নারী বলে রোকেয়ার নাম সহ্য হচ্ছে না! আমি বুঝতে পারছি না, এই একুশ শতকে মানবসভ্যতা যখন আধুনিকতার অত্যুচ্চে পৌঁছে যাচ্ছে, তেমন সময়ে একটি গোষ্ঠী অত্যন্ত কদর্যভাবে নারীকে পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে কেন! প্রশ্ন করছিলাম কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর শিরঃপীড়ার কারণে যদি অমন স্মারকলিপি উপস্থাপিত হয়ে থাকে, তাহলে অন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা প্রতিবাদ করছেন না কেন? উত্তর একই, চারদিকে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। অবাক হলাম, এ পর্যন্ত আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা একটি কথাও বললেন না। আমি বিশ্বাস করি, অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনে কথা বলবেন।
চারপাশের এতসব অন্ধকার দেখে আমার প্রয়াত শিক্ষক জাতীয় প্রফেসর ইতিহাসবিদ এএফ সালাহউদ্দিন আহমেদ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। এক পর্যায়ে স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলেন। তবে স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে যোগদানের কিছুদিন পর স্যারের সঙ্গে দেখা হলো। কথা বলে মনে হলো, আমার এ যোগদানে স্যার খুব খুশি হতে পারেননি। আমি একটু বিস্মিত হলাম। স্যার বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই জানো ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির প্রকল্প যখন নেওয়া হয়, তখন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল গাজীপুরের শালনাতে। ধামরাইয়ে বাড়ি, সরকারের অংশ একজন রাজনীতিবিদ প্রভাব খাটিয়ে বর্তমান লোকেশনে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে আসেন। স্যার বললেন, তখন একমাত্র আমি এর বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ পৃথিবীজুড়ে যে সত্য প্রতিষ্ঠিত, তা হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে শুধু সেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারই নয়, আশপাশ অঞ্চলের মানুষও সাংস্কৃতিক ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত হয়। সাভারের যে জায়গায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে এখানে সাংস্কৃতিক ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ থাকবে না। কারণ এক টাকা ভাড়া দিলেই বাসে চড়ে যে কোনো সময় ঢাকা আসা যায়। তাই আড্ডা দিতে বা একটি খাতা কিনতে হলেও ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা চলে আসবে। এ কারণে প্রকৃত অর্থে নাগরিক জীবন গড়ে ওঠা ও ক্যাম্পাসের বাইরের জনজীবনের চিন্তায় আধুনিকতা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগও এখানে কম থাকবে। স্যার বললেন, আমি আশঙ্কা করছি, এ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর বড় অংশ নান্দনিকতা চর্চার বদলে গ্রাম্যতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। এ কারণেই আমি চাইনি তুমি এখানে শিক্ষকতা করো। স্যারের শেষ পরামর্শ ছিল, শিক্ষা ও গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে এখানকার সামাজিক বলয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চল। স্যারের পরামর্শেই আমি কখনো নিজেকে শিক্ষক রাজনীতিতে জড়াইনি।
এ কারণে যখনই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বোধের অভাব দেখি, তখনই আমার শ্রদ্ধেয় সালাহউদ্দিন স্যারের কথা মনে চলে আসে। এজন্য বিগত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা যখন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়া শুরু করলেন, তখন ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে নানা লেখায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানসৃষ্টির পীঠস্থান। আর তেমন প্রতিষ্ঠানকে মুড়ি-মুড়কি বানিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশালত্বকেই যেন খাটো করে দিচ্ছি। আমাদের দেশে প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার বিন্যাস ও বিকাশে সংকটের অন্ত নেই। কিন্তু সব পর্যায়ের শাসকরাই সবচেয়ে উদাসীন থেকেছেন শিক্ষা সংস্কারে। ধারণা করেছিলাম, বর্তমান সরকার যখন নানা সংস্কারে হাত দিয়েছে, তখন শিক্ষা সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করবে; কিন্তু হতাশ হয়ে বুঝলাম, বিগত সরকারগুলোর মতো শিক্ষা সংস্কার বিষয়টি এ সরকারের কাছেও গৌণ।
বলা হয়, ইতিহাসচর্চা জীবন্ত জাতির পরিচায়ক। কিন্তু আমাদের এ সময়ের প্রজন্ম ইতিহাসবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তাই একটি উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তোলা বাংলার গৌরব তাদের অনেকেরই অজানা। বর্ণপ্রথায় বিপর্যস্ত সেন বংশের শাসকদের বলয় ভেঙে গিয়েছিল মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই সুফিসাধকদের তৎপরতায়। সুফিরা মানুষের প্রতি ভালোবাসা স্থাপনের কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছে আসতে পেরেছিলেন। প্রায় পাঁচশ বছর সুফিদের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটেছিল এ দেশে। ষোল শতকের শুরুর দিকেই হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার জন্য শ্রীচৈতন্য দেব তার নব্যবৈষ্ণব আন্দোলন নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনিও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ায় ভূমিকা রাখেন। আর এসব মানবিক ভক্তিবাদের প্রতিক্রিয়াতেই বাউল মতের জন্ম ও বিকাশ ঘটে। এসব বিচারে বলাই যায়, এ দেশের শেকড়ের গভীরে প্রোথিত অসাম্প্রদায়িক চেতনা। তাই সুবিধাবাদী ছাড়া আর কাউকে ধর্মান্ধ বানানো সম্ভব নয়। কারণ, এ দেশের মানুষ-বিশেষ করে সাধারণ মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাই লালন করে। তাদের বিভ্রান্ত করা কঠিন হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com