পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান কোন পথে
পিডিশন প্রধান
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যেমন, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান পালন না করা ছিল একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এছাড়া গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে চারজন পাহাড়ির মৃত্যু এবং অনেকের আহত হওয়ার ঘটনা, বাড়িঘরে আক্রমণ করা, আগুন দেওয়া, আক্রান্তদের বাড়িঘর ছেড়ে বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়া, বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙা, মন্দিরে আক্রমণ-ভাঙচুর ইত্যাদি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় সেটেলার যুবকের মৃত্যু হয় যাদের পিটুনিতে, তারাও বাঙালি সেটেলার; মৃত ব্যক্তির স্ত্রী তার মামলায় এর উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে কল্পনাপ্রসূত গুজব, অন্য দেশে সংঘটিত ঘটনা, ফেক ভিডিও বা ছবি, যেগুলো অতীতে বিভিন্ন সময় শেয়ার করা হয়েছে, সেগুলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে এ ধরনের ভিডিও শেয়ার করতে দেখা গেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসী প্রসঙ্গ বা পাহাড়ি ও সেটেলার বিতর্কটাও অনেককে সামনে নিয়ে আসতে দেখা গেছে। আজকের আলোচনায় আমি শুধু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়েই আলোচনা করব। আদিবাসী, ইতিহাস, জাতি এগুলো নিয়ে অন্য কোনোদিন লিখব, যদিও এ নিয়ে দেশি-বিদেশি নৃবিজ্ঞানী, পণ্ডিত, গবেষকদের অনেক বই বা লেখা রয়েছে, পাঠক চাইলেই সেগুলো দেখতে পারেন।
২.
পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতে ঘটা ঘটনাবলির খবর সেভাবে আমরা পেতাম না অথবা মিডিয়া বা কোনো মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তা আসত না। কিন্তু বর্তমানে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে মোটামুটি সব ঘটনাই আমরা জানতে বা দেখতে পারি। এর আগেও বেশ কয়েকবার এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও একটি ঘটনারও আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি, এমনকি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি। ফলে ঘটনা সংঘটনকারীরা পুনরায় এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে। সেখানে এক ধরনের চাপা পরিস্থিতি প্রায় সবসময় বিরাজমান। আগে পদক্ষেপ নিলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যেত। সমস্যার মূল খুঁজতে গিয়ে একটি প্রশ্ন বারবার এসেছে-বিশ্বের বহু দেশে, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোয় আদিবাসী, পাহাড়ি বা সংখ্যালঘু জাতিগুলোর সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকলেও আমাদের সংস্কৃতিতে সেটি সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
৩.
ঐতিহাসিকভাবে, দেশ বিভাগের আগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম আলাদা রাজ্য বা এলাকা হিসাবে পরিগণিত হতো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি নিয়েও বেশ টানাপোড়েন হয়েছিল। পাহাড়িরা বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদি বাসিন্দা ছিলেন, যেমনটি ছিলেন উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতাল, মুন্ডা, কোল, ভিল জাতিগুলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে যে জনসংখ্যা বা ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন দেখা যায়, তা অস্বাভাবিক। অতীতে সেখানে বসবাসরত আদি বাঙালিদের কোনো ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে সেখানকার পাহাড়িরাই বাঙালিদের নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের কৃষিকাজে সাহায্যকারী হিসাবে। যেমনটি ঘটেছিল পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের ক্ষেত্রেও। ত্রিপুরা রাজারা এক সময় বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের নিয়ে গিয়েছিলেন রাজকার্য পরিচালনায় সহায়তার কাজে নিয়োজিত করার জন্য। কিন্তু সরকারিভাবে সেটেলারদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছিল না। দরিদ্র, ভূমিহীন এবং সহায়-সম্বলহীন বাঙালিদের সমৃদ্ধ জীবনযাপনের আশ্বাস; নগদ টাকা, রেশন, নানাবিধ সুবিধা, বিনা পয়সায় জমি প্রদান ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিব্যবস্থার সঙ্গে দেশের অবশিষ্ট অঞ্চলের ভূমিব্যবস্থার পার্থক্য রয়েছে। দেশের অন্যান্য পাহাড়ি জাতির মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের ভূমির প্রথাগত ও সামষ্টিক মালিকানা ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ সেটেলারদের সেখানে ভূমি বরাদ্দ দেওয়া বা পুনর্বাসিত করার আগে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে সেটেলাররা সেখানে পাহাড়িদের যৌথ মালিকানাধীন ঐতিহ্যগত ভূমি দখল করে, গাছপালা ও বন উজাড় করে নিজেদের জীবিকার জন্য। আদিকাল থেকে পাহাড়িদের সঙ্গে আদি বাঙালিদের চমৎকার সহাবস্থান থাকলেও সমস্যা শুরু হয় সেখানে সেটেলারদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে।
৪.
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির অনুরূপ চুক্তি ভারতের সরকারগুলোও বিভিন্ন সময়ে নাগাল্যান্ড, মিজোরাম বা আসামের আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পাদন করে ওইসব এলাকা বা রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বে এ ধরনের চুক্তির অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু এখানে শান্তিচুক্তি হলেও সে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। চুক্তিগুলোর ধারাগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে ভূমি সমস্যার সমাধান হচ্ছে না এবং এ সমাধান না হওয়ার কারণে সেখানে সমস্যা বিরাজ করছে। বিভিন্ন বাধার মুখে ভূমি কমিশনও কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ভূমি কমিশন কার্যকর না হওয়ার কারণে একদিকে পাহাড়িরা নিজেদের ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে সংঘাত থামানো যাচ্ছে না। সেখানে সেটেলার ও পাহাড়িদের মধ্যে দ্বন্দ্বের নিরসন হচ্ছে না। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া পাহাড়িদের এক ধরনের ধোঁকা দেওয়ার শামিল। অথচ দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা খুবই প্রয়োজন। অন্যদিকে পাহাড়িরা তাদের দখল হয়ে যাওয়া ভূমি ফেরত পাননি। উল্লেখ্য, সেখানে অনেক পরিবারকে একাধিকবার ভূমি হারাতে হয়েছে। প্রথমবার কাপ্তাই বাঁধ দেওয়ার ফলে; দ্বিতীয়বার দখল হয়ে যাওয়া ভূমি ফেরত না পাওয়ার কারণে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো ঘটনা ঘটার পর প্রায়ই বলতে শোনা যায়, সেটি কোনো গোষ্ঠী বা বিশেষ মহলের কাজ। ওই এলাকা দখল বা পাহাড়িদের বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের তৎপরতা ইত্যাদি কথা বলা হয়। অথচ বাস্তবতা হলো, বিশ্বায়নের এ যুগে আজকের বাজার অর্থনীতির বিশ্বে কেউ দেশ দখল করে না, বাজার দখল করে। পাহাড়ের কোনো দল বা পাহাড়িদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি কখনো শুনিনি, বরং তাদের সম্পৃক্ততার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার বীজ রোপিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো হয়েছিল। তাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করার কারণে এ অস্থিরতা শুরু হয়। আমরা অদ্যাবধি এ সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেশে বা বিদেশে কোনো অনুষ্ঠান বা সভায় বিদেশি অংশগ্রহণকারী বা বন্ধুদের কাছে যখন দেশের গর্বিত নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশের সাফল্য বা অর্জনের কথা বলি, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সম্পর্কিত প্রশ্নে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মাধ্যমে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার উন্নতির কথা বলে থাকি। কিন্তু কখনো কি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সেখানে পর্যটনশিল্প থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের বা পাহাড়িদের কত অংশ এর সুবিধা পাচ্ছে? খুবই নগণ্য একটি অংশ এর সুবিধা হয়তো লাভ করছে, কিন্তু পাশাপাশি এসব পর্যটনকেন্দ্র, হোটেল ইত্যাদি তৈরিতে কত পাহাড়ি পরিবার তাদের জমিজমাসহ সহায়-সম্বল হারিয়েছে, আমরা কি তার খোঁজ রাখি? কাপ্তাই লেকের বাঁধের কারণে হাজার হাজার একর সুফলা জমি হারিয়ে শরণার্থী হিসাবে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়ার করুণ কাহিনি আমরা জানি না।
৫.
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আগে ও পরে সব মিলিয়ে অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও আজ অবধি আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। অথচ একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রথা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বজায় রেখে বিভিন্ন কার্যক্রম ও পদক্ষেপ নেওয়া হলে ওই অঞ্চলকে সমগ্র দেশের জন্য সম্পদশালী এলাকায় পরিণত করা যেত। প্রতিবেশ ও পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এ অঞ্চলকে একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করা হলে এবং বিভাজনমূলক নীতি পরিহার করে সেখানকার প্রথা অনুযায়ী ভূমি সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা সবার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। এ সমস্যার সমাধান না হলে সেটা হবে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।
পিডিশন প্রধান : সংগঠক ও খাসি জাতির প্রতিনিধি