Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার

Icon

মোহাম্মদ হোসেন

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার

বাংলাদেশের সূচনাকাল থেকেই সংবিধান নিয়ে বোদ্ধা, যোদ্ধা ও অবোদ্ধা মহলে একটা আলোচনা ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে। তবে এ সময় এসে তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। সংবিধানবোদ্ধাদের একটি মহল মাঝে মাঝে ঝড় তুলছেন যে, সংবিধান সম্পর্কে জ্ঞান নেই, এমন লোকেরাই এখন সংবিধান নিয়ে কথা বলছেন। যোদ্ধারা বলছেন, মারো টান হে-ই-ও, ওটা উড়িয়ে দাও। বোদ্ধা-অবোদ্ধা কেউ কেউ বলছেন, সংবিধান গেল তো সবই গেল, এ জাতি রসাতলে গেল। অন্যরা বলছে, গত রেজিম সংবিধানকে পরিবর্তন করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে; তাই সংবিধান সংশোধন করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হবে। এ আলোচনার তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে আমরা আমজনতা ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছি! তাই মনে হলো আমজনতা হিসাবে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা দরকার।

সংবিধানের এত সংশোধনের পরও তো রাষ্ট্রে একজন নাগরিকের ‘সার্বভৌম’ সত্তা রক্ষা করা যায়নি। রাষ্ট্রের জননিরাপত্তা বাহিনী সরাসরি নাগরিকের বুকে বুলেট বসিয়ে দিয়েছে। তাহলে কে সার্বভৌম? নাগরিক, সংবিধান, না বুলেট? সংবিধানবোদ্ধাদের কাছে আমার এ বোকা প্রশ্নটা থাকল। কোনো একটা বৈঠকে আমি একটি প্রশ্ন তুলেছিলাম। প্রশ্নটা হলো, দেশের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আইন কোনটি? আমার জ্ঞানের এত অভাব দেখে অনেকেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, কেন সংবিধান! একজন বললেন তিনি মানেন না যে, সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী আইন। সবাই তাকে চেপে ধরল, কেন কেন? তাহলে সবচেয়ে শক্তিশালী আইন কী? তিনি নির্বিকারভাবে বললেন যে, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী আইন হলো ‘কিল’। সবাই তো তার ওপর আরও চটে গেল। ‘What nonsense you are talking about?’ কিল মানে কী? তিনি বললেন, ‘কিল’ মানে ‘কিল’ বা ‘ঘুসি’ বা মুষ্টিবদ্ধ হাতের আঘাত। তাকে রীতিমতো সবাই চেপে ধরল যে, ‘কিল-ঘুসি’ কী করে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইন হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য। সে বলল তোমরা দেখ, গত দেড় দশক যাবত আমরা শুনে আসছি সংবিধানের বাইরে কিছু হবে না। সংবিধান লঙ্ঘন করলে মৃত্যুদণ্ড হবে। ’৭২ সাল থেকে শুনে এসেছি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান ’৭২-এর সংবিধান ইত্যাদি। ’৭২-এর সংবিধানের ধাঁচে ’৯১তে সংবিধান সংশোধন হলো। এত ভালো সংবিধান কি নাগরিকের বুকে বুলেট বিদ্ধ করা আটকাতে পেরেছিল? পারেনি তো! সংবিধানের বাইরে কিছু হবে না, এ কথা শুনতে শুনতে দেশের শিয়াল-শকুন, কাক-চিলেরা পর্যন্ত সংবিধান সংবিধান বলে চিৎকার শুরু করেছিল। কিন্তু জনগণ যখন একত্র হয়ে বুলেটের বিপরীতে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ‘কিল’ দেখাল, তখন গুলি বন্ধ হলো। মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীসহ শকুন-শিয়াল-কাক সবাই তো সংবিধান-ঢংবিধান ফেলে পালিয়ে গেল। সংবিধান কি তাদের পলায়ন থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল? তাহলে সহজ হিসাব সংবিধানের চেয়ে বুলেট শক্তিশালী, তার চেয়েও শক্তিশালী জনতার ‘কিল’। সংবিধান না জনগণকে রক্ষা করতে পারে, না প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করতে পারে। কাজেই জনতার ঐক্যবদ্ধ কিলই সবচেয়ে বড় আইন বা বিধান। এ কথা শুনে আমরা সবাই তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। এমন অকাট্য যুক্তি, প্রতিযুক্তি দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেল না কেউই।

এ ঘটনা থেকে আমার মধ্যে সংবিধান সম্পর্কে একটু ঔৎসুক্য দেখা দিল। তাই এ সম্পর্কিত চলতি আলাপ-আলোচনা, সমালোচনাগুলো লক্ষ করতে থাকি। লেখালেখিগুলো একটু পড়ি। এ সম্পর্কিত তাত্ত্বিক সূত্রগুলো সম্পর্কে যৎসামান্য অনুসন্ধান করি। সংবিধান সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তার উৎপত্তি বা বিকাশ বেশি দিনের নয়। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভিত্তি থেকে আধুনিক রাষ্ট্র বিস্তারের সূত্রপাত। অতঃপর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়া পত্তন। এর আগে রাজা বা সম্রাটের সার্বভৌম আদেশের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হতো। সে ব্যবস্থায় রাজা বা সম্রাটই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার এ সার্বভৌমত্বের ভিত্তি ছিল উত্তরাধিকার, ঈশ্বরের প্রভুত্ব এবং রাষ্ট্রীয় সৈন্যবাহিনী; সর্বোপরি যোদ্ধা হিসাবে নিজের দক্ষতা এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতা। এ একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব থেকে জন্ম নিত নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচার-স্বৈরাচার। ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে ভলতেয়ার, মন্টেস্কু এবং রুশো এ অবস্থা থেকে মানুষের মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে যে তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেন, তাকে কেন্দ্র করেই বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্মেষ ঘটে।

ভলতেয়ার শোনালেন গণতন্ত্রের একটি মূলমন্ত্র-‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি; কিন্তু তুমি যাতে তোমার মত তুলে ধরতে পারো, আমি তার জন্য জীবনপণ লড়াই করে যাবো।’ রুশো বললেন সামাজিক চুক্তির কথা। মন্টেস্কু বললেন, সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্যমূলক বিভাজনের কথা। লিখিত বা অলিখিতভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের এসব মূলনীতির চর্চাকে সাধারণভাবে সংবিধান বলা যায়। সুতরাং আধুনিক একটি রাষ্ট্রের সংবিধানের পেছনে রয়েছে তিনটি সত্তা, যথা : সার্বভৌমত্ব, সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্যমূলক বিভাজন এবং সম্ভাব্য ন্যায়নিষ্ঠ চর্চা। কাজেই সুন্দর সুন্দর শব্দের মালা গেঁথে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত বাক্য বিন্যাসে হীরক জহরতময় জ্বলজ্বল করা অধিকারগুলো চর্চা করা না হলে ওই সংবিধান একটি অথর্ব পুস্তক ছাড়া আর কিছুই নয়। কালির হরফে লিপিবদ্ধ সংবিধান আধুনিক রাষ্ট্রের একটি অতি নগণ্য অনুষঙ্গ মাত্র। এটি কোনো লক্ষ্য বা পূজনীয় সত্তা নয়। ব্রিটিশদের এখনো কোনো লিখিত সংবিধান নেই। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র আছে যাদের সংবিধান নেই। তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কি চলছে না? পশ্চিমা সভ্যতা তো মুসলমানদের অনেক জিনিসই স্বীকার করে না। তারপর বিশ্বাসী হিসাবে আমাদের জেনে রাখা ভালো যে, ‘মদিনা সনদ’ই প্রথম লিখিত সংবিধান, যা সামাজিক চুক্তি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল।

আমরা জানি, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংবিধান খুব বেশি দিনের পুরোনো বিষয় নয়। লিখিত হোক আর অলিখিত হোক, সংবিধান আসলে কী? আমি যতটুকু বুঝেছি তা রাষ্ট্রের সংবিধান বা আর কোনো সংগঠনের গঠনতন্ত্র যা-ই হোক, সংবিধান হলো কিছু নির্ধারিত স্বীকার্য, কিছু মৌলিক নীতি এবং এসব মৌলিক নীতিগুলোর সুরক্ষা ও বাস্তবায়নের জন্য প্রধান প্রধান সাংগঠনিক কাঠামোর গঠন এবং কার্য পরিচালনার প্রধান প্রধান পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ সভ্যগণের সর্বসম্মত এবং রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সার্বভৌম জনতার সম্মতি বা স্বীকৃতি।

আধুনিক রাষ্ট্রে সাংবিধানিক ব্যবস্থা বুঝতে হলে আমাদের সার্বভৌম এবং সার্বভৌমত্ব শব্দগুলো বোঝা দরকার। বর্তমানে আমরা এ শব্দ দুটি ব্যবহার করি ইংরেজি ‘sovereign’ ও ‘sovereignty’-এর প্রতিশব্দ হিসাবে। বিশ্বে, বঙ্গে বা ভারতবর্ষে প্রাচীন যুগে কোনো কোনো রাজা নিজেকে সার্বভৌম বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সাহিত্যে, ইতিহাসে হয়তো তার প্রমাণ আছে। সার্বভৌম হতে হলে তাকে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে হবে। যেমন শ্রী রামচন্দ্র যখন নিজেকে রাজা সার্বভৌম ঘোষণা করতে চাইলেন, রাজ ঋষি তাকে অশ্বমেদ যজ্ঞ করার পরামর্শ দিলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া লব ও কুশ আটকে দিলে নতুন উপাখ্যান তৈরি হলো। গ্রিক মাইথোলজি অনুসারে জিউস সার্বভৌম দেবতা, কেননা তার শক্তির প্রকাশ ‘Thunder bolt’-ই জিউসের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এ সময় ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশেষত ইবরাহিম (আ.)-এর ধারা থেকে আগত ইহুদিরা Yahweh, খ্রিষ্টানরা ঈশ্বরকে এবং মুসলমানরা আল্লাহকে সার্বভৌম সত্তা হিসাবে বিশ্বাস করে। তিনিই সার্বভৌম, কেননা তিনি প্রবল পরাক্রমশালী। এ জগৎ-মহাবিশ্ব তারই সৃষ্টি এবং নিয়ন্ত্রণাধীন। এখন তাহলে প্রশ্ন জাগে স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ কীভাবে সার্বভৌম হয়? এখানে বিশ্বাস অনুসারে মানুষ স্রষ্টার প্রতিভূ হিসাবে সৃষ্ট, তাই সার্বভৌম সত্তার অংশ হিসাবে মানুষের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু মানুষ কি পরম, মানে সার্বভৌম? তা কিন্তু কোনোভাবেই নয়। কেননা একমাত্র স্রষ্টাই পরম সার্বভৌম সত্তা। কাজেই মানুষ আংশিক সার্বভৌম। এর পরের প্রশ্ন সব মানুষ কি সমান সার্বভৌম? তুলনামূলক তত্ত্ব বলে যে, সব মানুষ সমভাবে সার্বভৌম নয়। একজন রিকশাচালকের সার্বভৌমত্ব এবং একজন ট্রাকচালকের সার্বভৌমত্ব সমান নয়। একজন গরিব মানুষের এবং একজন ধনী মানুষের সার্বভৌমত্ব সমান নয়। পার্থিব জগতে সৃষ্টির সার্বভৌমত্ব আংশিক, পরিমাণগত বিবেচনায় এবং গুণগত বৈশিষ্ট্যে তারতম্য দ্বারা খণ্ডিত। স্রষ্টার অংশ হিসাবেই হোক, স্রষ্টার ঘোষণামতে হোক এবং আংশিক বা খণ্ডিতই হোক, মানুষের একটি সার্বভৌম সত্তার অস্তিত্ব আছে। বিজ্ঞানের বা শক্তির তত্ত্ব অনুসারে মানুষও শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। তার শক্তির উৎস হলো তার জীবন। সে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে, এটিই তার শক্তিমত্তা প্রকাশের প্রতীক। তাই প্রত্যেকটি মানবসত্তা সার্বভৌম। এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সার্বভৌম সত্তা যখন একত্রে লাখ লাখ মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে ধরে, তখন তা তুলনামূলক বিচারে বুলেটের চেয়ে অধিকতর সার্বভৌম হয়ে ওঠে। বুলেট যখন বক্ষ বিদীর্ণ করে জীবনে আঘাত করে, জীবন তখন আরও সার্বভৌম হয়ে ওঠে বিসর্জনের মাধ্যমে। মুষ্টিবদ্ধ হাত তখন আরও সার্বভৌম হয়ে ওঠে। তখন তা-ই সবচেয়ে বড় আইন হয়। মুষ্টিবদ্ধ হাত-ই সবচেয়ে বড় সংবিধান, অবশ্যই তা কাগজে লেখা বিধানের চেয়ে সার্বভৌম।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সার্বভৌম ক্ষমতার স্থানান্তর হয়েছে ছাত্র-জনতা এবং মজলুম মানুষের কাছে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার আংশিক পতন এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী পলায়নের মাধ্যমে প্রচলিত ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। অঘোষিতভাবেই কার্যত সংবিধানও আংশিক বিলুপ্ত হয়েছে। একইসঙ্গে এ ঘটনাটি আমাদের গর্বের এবং লজ্জার। লজ্জার এজন্য যে ’৬৯, ’৭০ ও ’৭১-কে পুঁজি করে ’৭২-এর সংবিধানের জপমালা ধারণ করে যে ভয়ংকর স্বৈরশাসকের উত্থান হয়েছিল, আমাদের রাজনৈতিক মেধা ও শক্তি ওই বীভৎস উত্থানকে আটকাতে পারেনি। অতঃপর এ দানবকে তাড়াতে আমাদের ১৫ বছরের বেশি সময় লেগেছে এবং কয়েক সহস্র মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। কয়েক সহস্র মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছে। তবুও শেষ পর্যন্ত রাক্ষস তাড়াতে পেরেছি বলে জুলাই বিপ্লবের এ অর্জন ঐতিহাসিকভাবে গৌরবের। ব্রিটিশ শাসন-পরবর্তী সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমাদের গৌরবের বিষয় ’৫২, ’৬৯, ’৭১, ’৯০ ও ’২৪। ’৭১ ও ’৯০-এর অঙ্গীকার নিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর ’৭২-এর সংবিধান আংশিক প্রত্যাবর্তন করলেও শেষ পর্যন্ত তা জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ’৯০-পরবর্তী সংবিধানের প্রস্তাবনায় অভ্যুত্থানের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়নি। জনগণের সঙ্গে চরম প্রতারণা ওই সময় থেকেই শুরু হয়েছে। নূর হোসেন-বসুনিয়া-রাজুদের নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা হয়েছে, তাদের জীবন উৎসর্গের দাবির বাস্তবায়ন হয়নি।

’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও সে প্রক্রিয়াই শুরু হয়েছে। যারা শহিদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন তাদের নিয়ে আলোচনা দেখা যায় না। অনেকের ভাবখানা এমন যে, গত ১৫ বছরে বা ’২৪-এর জুলাই-আগস্টে যেন কিছুই ঘটেনি! আলোচনা হচ্ছে কীভাবে ’৭২-এর সংবিধান রক্ষা করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার তার দলবল নিয়ে কি রাজনীতি করতে পারবে? কী পারবে না? তা নিয়ে ঘোরতর আলোচনা হচ্ছে। কথার মধ্যে ছোঁ মেরে চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে গেল গেল বলে। সংবিধান পুনর্লিখন মানেই কি ’৭১ অস্বীকার করা? মোটেই না। সংবিধানের পুনর্লিখনে প্রস্তাবনায় যেমন ’৭১-এর গৌরবের কথা থাকবে, তেমনি ’২৪-এর সাহসকেও স্থান দিতে হবে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করতে হবে যে, এ দেশের মানুষ ’৭১-এ যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তেমনি ’২৪-এ এক ভয়ানক স্বৈরাচারকে তাড়িয়ে মানুষের অধিকারকে শৃঙ্খলমুক্ত করেছে।

রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে যুক্তি এবং গণিত বিদ্যার প্রয়োগ করে রাষ্ট্র কাঠামোতে এমন বিন্যাস আনতে হবে, যেন স্বৈরাচারের লক্ষণ দেখা যাওয়া মাত্র তাকে রাষ্ট্র কাঠামো থেকে নিষ্কাশন করা যায়। পুঞ্জীভূত ক্ষমতা কেন্দ্রে আসীন ব্যক্তিকে স্বল্পসময় পরই আবার সাধারণ মানুষের সমতলে দাঁড়ানোর সামাজিক চুক্তি এবং পদ্ধতি স্থাপন করতে হবে। গণতন্ত্রের নামে পরিবারতন্ত্র, রাজতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ করতে হবে। গত ৩৪ বছর যাবতই আমরা আইন সভার ৩টি দ্শ্চুরিত্র দেখেছি, তাহলো একইসঙ্গে এটি ‘স্তুতিকাব্য সভা’, আবার ‘ডাহা মিথ্যুক সভা’ এবং ‘গালাগাল সভা’। এ চরিত্র পালটানোর জন্য আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দরকার, তার উন্মেষ ঘটাতে হবে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেওয়া। আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম আরেকটি দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জন্য সুযোগের সমতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। বারবার নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ব্যর্থতার দায় স্বীকার করার মতো একজন সৎ লোকও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা যায়নি। সমাজে বা রাষ্ট্রে এর ভয়ংকর, বিষাক্ত ফলাফল সম্পর্কে ভেবে দেখার অবকাশ দুঃশাসকদের ছিল না। আমাদের এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা করতে হলে সাংবিধানিক কাঠামো অবশ্যই পুনর্গঠন করতে হবে। কাজেই ১. পুনর্গঠিত সংবিধানে ১৯৭১-এর পাশাপাশি ২০২৪-এর প্রেক্ষাপট এবং গণবিপ্লবের স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাবনা থাকতে হবে; ২. ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষস্থানীয় পদগুলোর মেয়াদ স্বল্প হতে হবে এবং কোনোক্রমেই মেয়াদের ধারাবাহিকতা রাখা যাবে না; ৩. শীর্ষস্থানীয় অর্থাৎ এমপি, মন্ত্রী, সিনেটর, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি পদগুলোয় জীবনে ২ বারের বেশি আসীন হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে; ৪. শীর্ষস্থানীয় একাধিক নির্বাহী পদের মধ্যে একটা সুষম ক্ষমতা বণ্টন এবং ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে; ৫. বিচার বিভাগে নিয়োগ থেকে শুরু করে সোপান-মেয়াদ এবং বিচারিক পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে; ৬. প্রয়োজনে তিন কক্ষবিশিষ্টি আইনসভা স্থাপন করতে হবে এবং ভারসাম্যমূলক ক্ষমতা ও কর্ম বিভাজন করতে হবে। পরিশেষে আমরা আমজনতা হিসাবে পণ্ডিতদের তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক দেখতে চাই না। আমরা জ্ঞানী লোকদের বিজ্ঞানসম্মত কাজ দেখতে চাই সংবিধান পুনর্গঠনে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে পেছনে টেনে নেওয়ার যে প্রয়াশ লক্ষ করা যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে পুনর্জাগরণ চাই। আমরা জরাজীর্ণতাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

মোহাম্মদ হোসেন : লেখক ও বিশ্লেষক

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম