জনদুর্ভোগ সৃষ্টির কর্মকাণ্ড পরিত্যাজ্য
মো. মুজিবুর রহমান
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন পেশা-গোষ্ঠীর আন্দোলন ও ছাত্র সংঘাত এমন এক সংকট তৈরি করছে, যার কোনো উদাহরণ নিকট অতীতে নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সরকারকে কয়েক প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করতে হয়েছে। বস্তুত আমরা লক্ষ করছি, ৫ আগস্টের পর থেকে নানা কারণে, অনেক সময় তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে রাজধানীতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা সংঘবদ্ধভাবে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। তারা নির্বিচারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর করছে। তাদের এ ধরনের সংঘাতের ফলে রাজধানীর জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়াসহ মহানগরীতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দৈনন্দিন নাগরিক জীবন বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতির মুখে পড়ছে। সড়ক অবরোধে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়ছে; ফলে সাধারণ মানুষ আরও বেশি দুর্ভোগের মধ্যে নিপতিত হচ্ছে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের মানুষ অত্যন্ত কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন; তার ওপর রাজধানীতে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলন-অবরোধ যেন বলতে গেলে এক ধরনের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি অতি দ্রুত মোকাবিলা করা না গেলে রাজধানীবাসীর জীবন আরও বেশি দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এদিকটিতে সংশ্লিষ্ট সবার গুরুত্বের সঙ্গে নজর দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও তৎপরতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে এখনকার ছাত্র আন্দোলন ও সংঘাতের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখনকার আন্দোলন ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পরিচালিত ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান। পরবর্তীকালে এ অভ্যুত্থান ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ওই আন্দোলনের ফলস্বরূপ অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপরিচালনায় আসীন হয়। এদিকটি বিবেচনা করে ওই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে কয়েকদিন আগে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া ছাত্র সংঘাতের কোনো তুলনা বা সম্পর্ক নির্ণয় করা চলে না। ধারণা করা যায়, এখন যে ধরনের আন্দোলন চলছে, আন্দোলনকারীরা একে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপায়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছে কিংবা জনগণের কাছ থেকে এক ধরনের মৌন সমর্থন লাভের ইচ্ছা পোষণ করছে। এটাও ধারণা করা যায়, তারা হয়তো ধরেই নিয়েছে, যে কোনো ছাত্র আন্দোলন হলেই সাধারণ মানুষ তাদের সমর্থন করবে। কিন্তু বাস্তবে এই ছাত্রদের বুঝতে হবে, এখন যে ধরনের আন্দোলন ও সংঘাত চলছে, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে না কিছুতেই এবং জনগণও ঘন ঘন ছাত্র আন্দোলনের নামে তাদের দৈনন্দিন জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এসব কর্মকাণ্ড পছন্দ ও সমর্থন করে না।
গত দুই সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে রাজধানীতে আন্দোলন শুরু করেন ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা। হয়তো তারা ধরেই নিয়েছিলেন, আন্দোলন করলেই তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করে দেবে সরকার। এ উদ্দেশ্যে আন্দোলনের একপর্যায়ে তারা মহাখালীতে রেলপথ অবরোধ করেন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ওইদিন রেলপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওইসময় যা ঘটেছে, তা মোটেও প্রীতিকর ছিল না। চলন্ত ট্রেন লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ফলে শিশুসহ কিছু যাত্রী মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা সম্ভব কিনা, এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য শিক্ষা বিভাগের তরফ থেকে কমিটি গঠনের আশ্বাস পেয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে।
তিতুমীর কলেজের আন্দোলন-পরবর্তী প্রায় কাছাকাছি সময়ে সায়েন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এ সংঘর্ষের ফলে বহু আহত হওয়ার খবর জানা গেছে। সংঘর্ষের পেছনের কারণ হিসাবে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সংঘর্ষের আগের দিন সায়েন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্রের বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে সিটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতাহাতি হয়। এর জের ধরে পরদিন সিটি কলেজের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা কলেজের দুটি বাস ভাঙচুর করে। পরে ঢাকা কলেজের ছাত্ররাও জোটবদ্ধ হয়ে সিটি কলেজে গিয়ে ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করলে ওই এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে বাধ্য হয় পুলিশ। সংঘর্ষের কারণে ওই দুটি কলেজের আশপাশে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয় এবং এর প্রভাব পুরো ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ঢাকাবাসীসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে রাজধানীতে আসা সাধারণ মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে। লক্ষ করা যায়, অনেক সময় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করেই ছাত্রদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বেধে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংঘটিত ঘটনাও টেনে এনে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে থাকে। তাদের সংঘর্ষের কারণে সাধারণ মানুষকে যে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়তে হয়, সেটা তারা একবারও ভেবে দেখে বলে মনে হয় না। অথচ ছাত্রদের কাছ থেকে এ ধরনের মারমুখী আচরণ কাম্য নয় কিছুতেই। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অংশ হিসাবে তারা হাতে আইন তুলে নিয়ে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িয়ে ফেলবে-এটাও কাম্য নয়।
সম্প্রতি একজন অসুস্থ শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুরের কারণ হিসাবে ‘ভুল চিকিৎসায়’ ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এ ভাঙচুরের ঘটনার পালটাপালটি হিসাবে অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর করাসহ ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সেদিন ওই ঘটনা নিয়ে রাজধানীজুড়ে ভয়াবহ তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয় এবং জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসব হামলা ও ভাঙচুরের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কলেজ বন্ধও ঘোষণা করা হয়। কোথাও কোথাও পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে!
সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় ছাত্রদের মধ্যে মারমুখী আচরণ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, রাজধানীবাসী সবসময় আতঙ্ক নিয়ে বাসস্থান থেকে বের হন। এসব ঘটনার পেছনে অনেকে কুচক্রী মহলের উসকানি থাকার কথা বলে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো মহলের উসকানি থাকলেই ছাত্ররা কেন এসবের ফাঁদে পা দেবে? তারা কেন নিজেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে? তাহলে তাদের নিজেদের বিচার-বিবেচনা ও বোধশক্তি থাকল কোথায়? তবে আমরা দেখলাম, ছাত্রদের সংঘাত চলাকালে রাজধানীর আরেকটি বড় ও পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনার সঙ্গে নিজেদের জড়িত করেনি। তারা অত্যন্ত ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেদিনকার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের প্রশংসাও করেছে।
আমরা বিশ্বাস করি, ছাত্রদের চলাফেরা, আচার-আচরণ, শৃঙ্খলাবোধ অবলোকন করে অন্যরা শিখবে। কিন্তু তারা যদি প্রায় প্রতিদিনই দলবদ্ধভাবে কোথাও না কোথাও আক্রমণ করে কিংবা নিজেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে ছাত্র হিসাবে তাদের মর্যাদা থাকে কোথায়? আমরা মনে করি, ছাত্রদের সুপথে পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। এক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকরাও সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য দায়বদ্ধ। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের দায়ও কম নয়।
দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উত্থাপন ও ছাত্র সংঘাতের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা থেকে উত্তরণের কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। অথচ এসব বিচ্ছিন্ন(?) ঘটনার ফলে পুরো ছাত্রসমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ ছাত্রদেরই খুঁজে বের করতে হবে।
মো. মুজিবুর রহমান : অধ্যাপক (শিক্ষা) ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com