শতফুল ফুটতে দাও
অশুভ প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না
ফাইল ছবি
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন অভ্যুত্থানকারীদের কঠোর হস্তে দমন করতে। অভ্যুত্থান দমনে পুলিশ বাহিনীর নির্দয় ভূমিকাকে শেখ হাসিনা প্রশংসা করেন। তিনি আরও বলেন, সামরিক বাহিনীকে, পুলিশ বাহিনীর মতো কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। এ পর্যায়ে পুলিশের আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, পুলিশের পক্ষে এর চেয়ে বেশি কঠোর হওয়া সম্ভব নয়। সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকেও শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, লাখ লাখ মানুষের যে দুটি মিছিল গণভবন দখলের জন্য এগিয়ে আসছে, তা কোনোক্রমেই রোধ করা সম্ভব নয়। সামরিক বাহিনীর এ অবস্থান শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলে। শেখ হাসিনা কিছুতেই ক্ষমতা ছাড়তে রাজি ছিলেন না। শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয়। জয় বুঝতে সক্ষম হন যে, চরম বিস্ফোরণোন্মুখ এ অবস্থার মুখে তার মাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। লাখ লাখ বিক্ষোভকারী গণভবনের দেওয়াল ভেঙে প্রবেশ করবে এবং তারা যাদের ওপর বিক্ষুব্ধ, তাদের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। অবশেষে শেখ হাসিনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং জীবন রক্ষার জন্য দেশ ত্যাগ করতে রাজি হন। সামরিক নেতারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা করে তাকে দেশ ছাড়ার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে, সামরিক নেতৃত্ব শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ সচেতন ছিল। তারা চাননি শেখ হাসিনাকে উন্মত্ত জনতা টুকরা টুকরা করে হত্যা করুক। মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে শেখ হাসিনাকে নিরাপদে দেশ ত্যাগ করার একটি ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা বড়াই করে বলতেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পালাতে হয়েছে। গণভবন থেকে একটি হেলিকপ্টারে শেখ হাসিনাকে সামরিক বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা একটি সি-১৩০ সামরিক পরিবহণ বিমানে দেশত্যাগ করে ভারতের রাজধানী দিল্লির নিকটবর্তী হিন্দান বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছান। সেই থেকে শেখ হাসিনা ভারত সরকারের আনুকূল্যে ভারতেই অবস্থান করছেন। অতীতেও তিনি বেশ কবছর দিল্লিতে ভারত সরকারের আশ্রয়ে থেকেছেন। সেটা ছিল ১৯৭৫-পরবর্তী সময়। ১৯৮১ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদারতায় দেশে ফিরে আসেন। তার হাতে তাদের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে যেসব মূল্যবান সামগ্রী ছিল সেগুলো তুলে দেওয়া হয়। ১৯৮১-এর ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে সামরিক অফিসারদের এক অভ্যুত্থানে নিহত হন। সাধারণ মানুষ এ ঘটনার সরলীকৃত বিশ্লেষণ হিসাবে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করেছেন। অনেকে মনে করেন, ১৯৭৫-এর পর শেখ হাসিনা যতদিন দিল্লিতে ছিলেন, সে সময় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা তাকে রাজনৈতিক ও সামরিক কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্ম হয়। এ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ গ্রহণ করেন এবং একই সময় উপদেষ্টারাও শপথ গ্রহণ করেন। ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে দেশে কোনো সরকার ছিল না। এ রকম পরিস্থিতি একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। ১৯৭৫-এর নভেম্বর মাসেও বাংলাদেশ সরকারবিহীন অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। নভেম্বরের ৩ থেকে ৭ পর্যন্ত প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। প্রতিবেশী ভারত এ সুযোগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করতে পারত। কিন্তু তারা এ হস্তক্ষেপ করার সাহস পায়নি। এর কারণ হলো-বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিপুল অংশ ভারতীয় আধিপত্যবাদ কিছুতেই বরদাশত করতে রাজি ছিল না। বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ শক্তিশালী জাতীয় ঐক্যে দৃঢ়ভাবে সংহত ছিল। এবারও জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক প্রবণতা থাকলেও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সব অংশ ঐক্যবদ্ধ।
ভারতীয় পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনকে খুবই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে অবিরত বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরম বন্ধু হিসাবে বিবেচনায় নেয়। ভারত বিভিন্ন চুক্তি ও লেনদেনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। খোদ শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি, তার জন্য চিরকাল ভারত মনে রাখবে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে এক সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো। মোমেনের এ উক্তিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক নাগরিকরা অনেক তির্যক মন্তব্য করেছেন। ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে ভারত বাংলাদেশে তার অবস্থানের ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের মন্তব্য হলো যে, রাষ্ট্রটির সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। সেই বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা পরাজিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহে ভারতের অবস্থানের মূল অনেক গভীরে প্রোথিত আছে। বাংলাদেশে ভারত ছাড়া অন্য কোনো পরাশক্তির শিকড় অত গভীরে প্রোথিত নয়। কাজেই বাংলাদেশি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভারতের অনুপ্রবেশের জটাজলকে ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশে নিজের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে সংহত করতে পারে। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী মুজিব হত্যার বদলা নিতে সংকল্পবদ্ধ হন। তিনি তার বেশ কিছু অনুসারীকে ভারতে নিয়ে যান এবং তাদের ব্যবহার করে র’-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশের সীমান্ত পোস্টগুলোতে সশস্ত্র হামলা চালাতে শুরু করেন। সামরিক শক্তির দিক থেকে তখন বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্বল ছিল। সীমান্তে কাদেরিয়া বাহিনীর অনেক হামলা বিডিআর প্রতিহত করতে সক্ষম হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পর্যুদস্ত হতে হয়। ফলে বাংলাদেশে সে সময়কার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন এবং তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেনকে গণচীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের নির্দেশ দেন। কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী খুব বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সীমান্তে হামলা চালাতে পারেনি। এক্ষেত্রে একদিকে ভারতকে নিয়ে বাংলাদেশের কূটনীতি এবং চীনের আশ্বাস বাংলাদেশকে শক্তি ও সাহস জোগায় এবং ভারত নিবৃত্ত হয়।
এবার ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক মোজাইক ভারতের অনুকূলে থাকেনি। এখন সমাজের সব স্তরে নানাভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব চাঙা হয়ে উঠেছে। এর জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করা সংগত নয়। ভারত যেভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বুনন তৈরি করেছে, তার কারণেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে।
ভারত কীভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক হাওয়া তার অনুকূলে নিতে পারে, তা এক গভীর চিন্তার বিষয়। এ বছরের ৫ আগস্টের পর আমরা লক্ষ করেছি, বিভিন্ন স্থানিক পর্যায়ে নানামুখী বিক্ষোভ ও অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
৫ আগস্টের পর ঢাকায় যেসব আন্দোলন বিক্ষোভ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে-আনসার সদস্যদের আন্দোলন, গার্মেন্ট সেক্টরে মজুরি নিয়ে সহিংস বিক্ষোভ, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ বছর করার দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকার ৭ কলেজের ছাত্রদের আন্দোলন, এক কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে অপর কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলন, পরীক্ষার ফল নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সবশেষে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন ইত্যাদি। লক্ষণীয় যে, আন্দোলনকারী ছাত্র এবং আনসাররা সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে বেশ কয়েক ঘণ্টা সচিবালয়কে অবরুদ্ধে করে রাখে। অতীতের কোনো আন্দোলনে বিক্ষোভকারীরা সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেনি অথবা প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি। প্রায় প্রতিদিন নানা ধরনের বিক্ষোভের ফলে ঢাকার নাগরিক জীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ছে। ৫ আগস্টের পর ঢাকা নগরীর কোনো কোনো এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ডাকাতদের প্রতিহত করতে এলাকাবাসী রাত জেগে পাহারা দেয় এবং তাদের সেনাবাহিনী সহযোগিতা করে। কয়েক দিনের মধ্যেই ডাকাতির ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়। এবারের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যায়। ফলে নানা ধরনের অপরাধচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বেশির ভাগ কাজে ফিরে এলেও সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। এ সমস্যার সমাধান হতে পারে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে নতুন রক্ত প্রবেশ করানো। যেহেতু জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম চেতনা ছিল বাক্ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, এ রকম একটি আবহে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমনে উৎসাহিত নয়। যদি তারা অধিকতর সক্রিয়তা প্রদর্শন করে, তাহলে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে এবং জনগণ ভাবতে শুরু করবে এত রক্ত দিয়ে অর্জনটা কী হচ্ছে? অন্যদিকে ধারণা করা হচ্ছে, একটি বহিঃশক্তি এসব বিক্ষোভ-আন্দোলনে ইন্ধন জোগাচ্ছে এবং কোনো কোনো ঘটনায় টাকা ছিটাচ্ছে। বাংলাদেশকে বিপজ্জনক অস্থিরতার মধ্যে নিক্ষেপ করতেই বিভিন্ন ধরনের দাবি-দাওয়ার আওয়াজ তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের বুঝতে হবে, অশুভ শক্তি বিবিধ পন্থায় চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে দিচ্ছে। সব পর্যায়ের নাগরিকদের দায়িত্ব হবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হওয়া।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ