রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা ও লুটপাট হয়েছে ঘোষণা দিয়ে। ‘ভুল চিকিৎসায়’ এক ছাত্রের মৃত্যু ঘটেছে দাবি করে এর আগে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে হামলা করে মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের ছাত্ররা কীভাবে জড়িয়ে গেল, সেটা এক রহস্য। মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের এ দুটি কলেজে ঢুকেও ভাঙচুর চালাতে দেখা গিয়েছিল। পুলিশ বলছে, ওই ঘটনা ঘিরেই মোল্লা কলেজে গিয়ে হামলা চালায় সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের ছাত্ররা। সংগঠিত হয়েই হামলা চালায় তারা।
মোল্লা কলেজের লুণ্ঠিত জিনিসপত্র নিয়ে তাদের ‘বিজয়ীর মূর্তিতে’ ফেরার দৃশ্যও টিভিতে দেখেছে মানুষ। উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উত্তেজিত ছাত্রদের কার্যকরভাবে বাধা দেওয়া হলে পুলিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘাত হতো। সেটা এড়ানো হলেও পরিস্থিতির জন্য দায়ীদের ছাড়া হবে না। ঘটনাস্থলে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীও রয়েছে সক্রিয়। পুলিশ এখনো যথেষ্ট সক্রিয় না হওয়ায় ছোটখাটো সংঘাত বন্ধেও তাদের ঘটনাস্থলে যেতে হচ্ছে।
এর কদিন আগেই ঢাকা ও সিটি কলেজের ছাত্ররা পুনরায় জড়ায় সংঘাতে। এমন সংঘাত চলাকালে এর আগে একটি কলেজের ছাত্ররা অন্য কলেজের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে এসেছিল। এ ধরনের লজ্জাজনক ঘটনার খবর সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে যায় ফেসবুকে। দেশের বাইরেও দ্রুত তৈরি হয় প্রতিক্রিয়া। বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশিরা এতে হয় লজ্জিত।
তবে গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী পরিস্থিতি তাদের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি করেছে। এর একাংশ দুর্ভাগ্যবশত এসব ঘটনায় উৎসাহিতও হচ্ছে। এও ঠিক, শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার এ ধরনের পরিস্থিতি দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না। সুদীর্ঘ দলীয়করণের শিকার প্রশাসন, বিশেষত পুলিশের কাছ থেকে তারা সহায়তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগও অমূলক নয়। সরকারের ১০০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার বদলানো হয়েছে সম্প্রতি। এর পরপরই ঘটল পুরান ঢাকা ও যাত্রাবাড়ীতে এমন ঘটনা।
একই দিন রাজধানীর শাহবাগে সারা দেশ থেকে লোক এনে জড়ো করার একটি চেষ্টা আবার বানচাল করতে হয় প্রশাসনকে। বিনা সুদে এক লাখ থেকে কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার উদ্ভট কথা বলে তাদের ঢাকায় আসতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। সরকার মনে করছে, এর পেছনেও হয়তো ছিল কোনো চক্রান্ত। সেটাই হয়ে থাকলে দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা আগে কেন জানতে পারেনি? একই সময়ে দুটি সংবাদপত্র কার্যালয়ের সামনে একদল লোক যা ঘটিয়েছে, এরই বা কী ব্যাখ্যা?
উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, মিডিয়ার সমালোচনা অধিকার বলে বিবেচিত হলেও তার ওপর এভাবে চাপ সৃষ্টি গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশ ও সেনা সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে অবশ্য। রাজধানীর বাইরে একটি সংবাদপত্রের দুটি কার্যালয় আবার ভাঙচুর করা হয়েছে একই সময়ে। ঘটনাগুলো ‘একসূত্রে গাঁথা’ না হলেও উদ্বেগজনক।
এতে সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি ভালো হচ্ছে না। অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশে যে পরিবর্তন এসেছে, তার মর্যাদাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বললে ভুল হবে না। বিশেষত শিক্ষাঙ্গনের ঘটনাবলিতে গণ-অভ্যুত্থানে মুখ্য ভূমিকা রাখা ছাত্রসমাজের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা দেরিতে হলেও ইতিবাচক।
একই সময়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলনের কারণ অবশ্য কিছুটা দূর হয়েছে চেম্বার আদালতের সিদ্ধান্তে। হাইকোর্টের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ আসায় রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে আপাতত কোনো বাধা নেই। তবে এ ইস্যুতে মাঝে পরিস্থিতির কেন এতটা অবনতি ঘটল, তার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে দায়। ব্যাটারিচালিত রিকশার সমস্যাটি তো একদিনে সৃষ্টি হয়নি। তবে রাজধানীর প্রধান সড়কে উঠে আসার আগ পর্যন্ত এ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের গা করতে দেখা যায়নি।
জুলাই আন্দোলন চলাকালে রাজধানীতে এর উপস্থিতি বাড়তে থাকার এক পর্যায়ে একে আপদ বিবেচনা করে চটজলদি ‘সমাধানের’ চেষ্টা যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটাও বলতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার তিন বা ছয় মাসের অধিক সময় থাকছে বলে তাদের এখন এসব সমস্যারও গ্রহণযোগ্য সমাধানের চিন্তা করতে হবে। এমন অনেক পুঞ্জীভূত সমস্যার মুখোমুখি এখন তারা। শুরু থেকেই তাই একের পর এক দাবির মুখে পড়ছে সরকার। এর সিংহভাগ ন্যায়সংগত হলেও তা পরিপূরণের উপযুক্ত প্রেক্ষাপট অবশ্য থাকা চাই; লাগবে সরকারের সামর্থ্যও।
দাবি আদায়কারীরা দৃশ্যতই সেগুলো বিবেচনা করছে না। এটা সাধারণ মানুষও লক্ষ করছে। তারা লক্ষ করছে এ কারণেও যে, দাবি আদায়ের হাতিয়ার হিসাবে অবরোধ করা হচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক। এতে জনভোগান্তি উঠছে চরমে; পণ্য পরিবহণও বিঘ্নিত হচ্ছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলনে রেলপথ অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে। এ পথ অবশ্য দেখিয়েছে তিতুমীর কলেজের একদল শিক্ষার্থী। তারা নিজ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে মহাখালীতে রেলপথ পর্যন্ত অবরোধ করে। শিক্ষার্থীদের একাংশ চলন্ত ট্রেনে ইটপাটকেল ছুড়লে শিশুসহ কিছু যাত্রী আহত হয়। তাদের পক্ষ থেকে এর ‘ব্যাখ্যা’ দেওয়া হলেও ঘটনাটি কিন্তু বদলাবে না।
এদিকে ঢাকার পাশে একাধিক শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা এখনো থেমে থেমে চলছে। এটা চলছে প্রধানত তৈরি পোশাকশিল্পে। প্রতিষ্ঠানের দাবিদাওয়া ঘিরে আন্দোলন দ্রুত চলে আসছে রাজপথে। পাশে মহাসড়ক থাকলে সেটা হয়ে উঠছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। সড়ক অবরোধ করে খবর সৃষ্টি করতে না পারলে ন্যায্য দাবিও আদায় করা যায় না, এটা প্রতিষ্ঠিত ধারণা। এটা অধিকারেরও পর্যায়ভুক্ত! এতে ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে সম্পর্কিত নয় এমন বিপুলসংখ্যক মানুষ যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটা বিবেচনারও প্রয়োজন যেন নেই। সন্দেহ নেই, পোশাক শ্রমিকদের অনেক দাবিই ন্যায়সংগত। চলমান মূল্যস্ফীতিতে তারা ক্রমে দিশেহারা, এটাও মানতে হবে।
এ অবস্থায় অনেক প্রতিষ্ঠানে আবার ঘটছে চাকরিচ্যুতি। চাকরির দাবিতেও কারখানা ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটছে। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের বিষয়ে সহানুভূতিশীল অবশ্য। শিল্পমালিকদের স্বার্থও দেখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি নিশ্চিত করতে লেগে গেছে অনেক সময়। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কোনো কোনো বিজনেস গ্রুপের প্রতিষ্ঠানে আবার চলছে বিশেষ পরিস্থিতি। সরকারকে উদ্যোগী হয়ে এক্ষেত্রে বেতনভাতার নিষ্পত্তি করতে হচ্ছে। পোশাকশিল্পে নিয়মিত বেতনপ্রাপ্তির সমস্যা রয়ে গেছে এখনো। অথচ বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে।
এর কিছু শিল্পকারখানা চট্টগ্রাম অঞ্চলেও গড়ে উঠেছে। আর এ ডামাডোলেও সেগুলো কিন্তু চলছে তেমন কোনো অস্থিরতা ছাড়াই। প্রধান রপ্তানি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ‘চক্রান্তের’ কথা যারা বলছেন, তারা ভেবে দেখতে পারেন চট্টগ্রামে কেন অস্থিরতা নেই? অবশ্য বিশেষ অঞ্চলকে এজন্য বেছে নেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা জরুরি। এ খাতের পুঞ্জীভূত সমস্যা তো রাতারাতি দূর করা যাবে না।
তবে যেটুকু সম্ভব, তা অবশ্যই করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো পক্ষ নেওয়া চলবে না। বেশি করে শ্রমিক স্বার্থ দেখলে আবার উদ্যোক্তারা পড়বেন বিপাকে। সরকার তাদের ঠিকমতো গ্যাস-বিদ্যুৎও দিতে পারছে না। হালে ঋণের সুদের হার উচ্চ। এ সমস্যা অবশ্য অন্যান্য খাতকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাতে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত; পুরোনো বিনিয়োগে কার্যক্রম পরিচালনাও কঠিন। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। বেসরকারি খাত এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখলেও এর ওপর আস্থা এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত। সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি তাই অব্যাহত। হালে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি নিয়েও সরকারকে কম জটিলতা মোকাবিলা করতে হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ ‘জরুরি সংস্কার’ সেরে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে পরবর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু দাবিদাওয়াসহ অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকায় থেকে থেকেই কারও মনে হতে পারে, সরকারটির মূল কাজ আসলে কী! হাসপাতালে কত রোগীরই তো মৃত্যু ঘটে রোজ। তা নিয়ে অভিযোগ ওঠাও নতুন নয়। গাফিলতি যে হয় না, তাও নয়। কিন্তু নিতান্ত অভিযোগ ঘিরে পুরান ঢাকা ও যাত্রাবাড়ীতে যা ঘটে গেল, তাতে হতবিহ্বল হতে হয়। এজন্য অনেকে অবশ্য গণ-অভ্যুত্থানের পর ‘মব জাস্টিস’ বেড়ে যাওয়া এবং তা মোকাবিলায় সরকারের উদাসীনতাকে দায়ী করেন। এর জবাবে সরকার বলছে, পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারত; সরকার বরং অবনতির ধারা রোধ করেছে।
তারা এও বলছেন, পরিস্থিতির অবনতিতে ভূমিকা রাখছে ক্ষমতাচ্যুতদের দোসররা, যারা লুণ্ঠিত বিপুল অর্থ ব্যয় করছে এ কাজে। এ অবস্থায় কোনো পক্ষের বক্তব্যই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে গণতন্ত্রের পথে শান্তিপূর্ণ উত্তরণের দায়িত্ব যেহেতু সরকার নিয়েছে, তাই তাকেই এসব মোকাবিলা করে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে হবে। অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে বিগত সরকার, সেটা মোকাবিলার সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। অনেকে বলেন, সরকার ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ’ ঘোষণা না করায়ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়ছে অস্থিরতা।
দাবি আদায়কারীরা মনে করছে, সরকার তো দীর্ঘদিন থাকবে! রাজনৈতিক দলগুলোও কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বিনিয়োগকারীরাও তাদের কার্যক্রম নিয়ে আছেন পরিকল্পনাহীনতায়। এর প্রভাব উন্নয়ন সহযোগীদের ওপরও পড়তে পারে। এ অবস্থায় সরকারকে স্পষ্ট করে কথা বলতে হবে। সব কাজের ম্যান্ডেট তার আছে কি না কিংবা সব দাবি পূরণ তার পক্ষে সম্ভব কিনা, সেটা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। অরাজকতা রোধে সরকার যে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করবে, তার প্রমাণও দেওয়া চাই ব্যাপক মানুষের স্বার্থে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষের অভিযোগ গ্রহণ এবং দ্রুত এর নিষ্পত্তির পৃথক নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হওয়াটাও প্রয়োজন মনে হচ্ছে।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক