Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সংস্কারের দাবি উপেক্ষা করা যাবে না

Icon

এরশাদুল আলম প্রিন্স

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কারের দাবি উপেক্ষা করা যাবে না

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নয় দফা, সেখানে থেকে এক দফা-অতঃপর একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন অথবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে। এসব আন্দোলনের সময় আমরা দেশের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা দেখেছি-রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত ইত্যাদি নানা স্লোগান। দেশের আনাচে-কানাচে, গ্রামে ও শহরের দেওয়ালে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি স্পষ্ট। এতে ছাত্র ও জনতা তথা জনগণ আগামীতে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায়, তা লিখে দিয়েছে।

আমরা সংস্কার চাই। আমরা একই স্বৈরতন্ত্রের ঘূর্ণাবর্তে আর ঘুরতে চাই না। আমরা আর ভোটবিহীন কোনো সরকার চাই না। নির্বাচনের নামে প্রহসন চাই না। গুমের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই না। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসাবে পেতে চাই। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ চাই। জনবান্ধব শিক্ষা ও সেবা খাত চাই। এগুলো সবই একটি রাষ্ট্রের জনগণের মৌলিক চাওয়া। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এগুলো পূরণের জন্য গণঅভ্যুত্থান করতে হয় না। এগুলো মূলত দাবি নয়, অধিকার। অথচ এত বড় একটি গণ-অভ্যুত্থান হয়ে যাওয়ার পরও এসব সংস্কার নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করেন। সবচেয়ে হতাশাজনক, যখন বিএনপি থেকেও সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে হাজারের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন। শুধু শেখ হাসিনার পতন বা রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন করে শেখ হাসিনার স্থলে আরেকজনকে গদিতে বসানোর জন্য এত মানুষ শহিদ হননি। শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন একটি অভ্যুত্থানের অভীষ্ট লক্ষ্য হতে পারে না। একটি গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হতে পারে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরকার পতন ও কিছু সংস্কারের বিষয় ওতপ্রোতভাবেই জড়িত। অভ্যুত্থানের পর নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন হবে এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কিছু সংস্কারও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কারকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

এ অভ্যুত্থানে বিএনপিরও অনেক কর্মী যোগ দিয়েছেন; কিন্তু তারপরও এ অভ্যুত্থান বিএনপির একক আন্দোলন নয়। একটি দলের আন্দোলনকে কখনো গণ-অভ্যুত্থান বলাও হয় না। দেশের গণমানুষ যখন একটি আন্দোলনের মূল শক্তি হিসাবে কাজ করে, তখনই একটি আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। অভ্যুত্থানে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ থাকতেই পারে। জুলাই অভ্যুত্থানেও তা ছিল। কিন্তু সর্বোপরি এটি ছিল গণমানুষের অংশগ্রহণের ফল। কাজেই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য হয়নি। মানুষ একটি পরিবর্তন চেয়েছে, যা সংস্কারের মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে মনে হচ্ছে, জনগণ যেন তাড়াতাড়ি একটি নির্বাচন করে তাদের গদিতে বসানোর জন্যই সংগ্রাম করেছে। প্রাণ দিয়েছে। এ মুহূর্তে বিএনপির একমাত্র এজেন্ডা নির্বাচন। বিএনপি যদি এ অভ্যুত্থানের মর্মকথা ধারণ করতে না পারে, সেটি জাতির জন্য হতাশার। কারণ বিএনপিই এখন দেশের রাজনীতি তথা গণতন্ত্রের জন্য একমাত্র আশাজাগানিয়া দল।

যদি জুলাই অভ্যুত্থানের কথা বাদও দেই, গত ১৫ বছরে বিএনপির ওপর যে রাজনৈতিক দমনপীড়ন হয়েছে, সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার প্রতি সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে সংস্কারের ওপর জোর দিতে হবে। বিএনপি বলছে, এ অভ্যুত্থানে তাদেরও অনেক নেতাকর্মী শহিদ হয়েছেন। অবশ্যই তাদেরও অনেক কর্মী এ অভ্যুত্থানে শহিদ হয়েছেন। এখন প্রশ্ন, তাদের এ নেতাকর্মীরাও কি শুধুই একটি নির্বাচনের জন্য প্রাণ দিয়েছেন? শহিদরা কি চাননি দেশে আর কোনো ফ্যাসিস্টের জন্ম না হোক? তারা কি চাননি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ রচিত হোক? এরকম আরও কিছু মৌলিক দাবি অর্জনের জন্যই শহিদরা প্রাণ দিয়েছেন। সহজ কথায়, এতজন মানুষের রক্তের সঙ্গে সুবিচার করতে হলে সংস্কারকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে; এটাই গণ-অভ্যুত্থানের দাবি।

দীর্ঘ ১৫ বছরে তিন তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রহসন হয়েছে। মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের কোনো অধিকার ছিল না। হত্যা, গুম, খুন-এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিএনপি মাঠে ছিল। হাতেগোনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে বিএনপির সঙ্গে শরিক ছিল। কাজেই দল হিসাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপির ত্যাগ অনন্য। কিন্তু এত ত্যাগ ও দীর্ঘ লড়াইয়ের অভীষ্ট লক্ষ্য কি শুধুই একটি নির্বাচন? রাজনীতির যে অন্ধকার অধ্যায় তারা পার হয়ে এসেছে, সংস্কার ছাড়া সে অন্ধকার দূর করার আর কি কোনো উপায় আছে?

একটি কোটা আন্দোলন কেন এমন সর্বজনীন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিল, সেটা বুঝতে হবে। গত ১৫ বছরে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করেনি এটা যেমন সত্য, এবার কোটা আন্দোলন যে এমন একটি বৃহৎ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিল, তার প্রধান অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে ১৫ বছরের অত্যাচার-নির্যাতন। মানুষের অবচেতন মনে কাজ করেছে ১৫ বছরে বিএনপির প্রতি সরকারের নির্যাতন ও দমন-পীড়ন। মানুষ বিএনপির প্রতি নির্যাতনের প্রতিবাদ না করলেও এবার ঠিকই তারা রাজপথে এর সমুচিত জবাব দিয়েছে। জনগণ সময়মতো ঠিকই রাজনৈতিক দলের পাশে দাঁড়ায়, যদি রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের পাশে দাঁড়ায়। সময়ের প্রয়োজনে স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে সবাই যখন পাশাপাশি দাঁড়ায়, তখন তা হয়ে ওঠে গণ-অভ্যুত্থান। জুলাই অভ্যুত্থানে সেটাই হয়েছে।

মানুষ গত ১৫ বছরে যে বিভীষিকার মধ্য দিয়ে গেছে, তার পুনরাবৃত্তি চায় না। সেটি সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়। এদেশের ছাত্র-জনতা সংস্কার চায়। নির্বাচনও তারা চায়। কিন্তু কিছু মৌলিক সংস্কারের আগে নির্বাচন মানে গণ-অভ্যুত্থানকে অস্বীকার করা। বিএনপির একক আন্দোলনের ফলে যদি শেখ হাসিনার পতন হতো, তাহলে বিএনপি অতি দ্রুত নির্বাচন চাইতেই পারত। কিন্তু এটি বিএনপির একক আন্দোলন নয় এবং বিএনপি আন্দোলনের নেতৃত্বেও ছিল না। তাই বিএনপির পক্ষ থেকে অতি দ্রুত নির্বাচন চাওয়ার কোনো যৌক্তিকতাও নেই। তবে রাজনৈতিক দল হিসাবে তারা নির্বাচন চাইবে, সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত লক্ষ্যকে উপেক্ষা করে তাড়াতাড়ি ভোট দিয়ে আমাদের গদিতে বসান-এমন দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।

গত ১৫ বছর বাংলাদেশ উলটোপথে হেঁটেছে। ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবিক মূল্যবোধ সব ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়েছি। শুধু ভৌত অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হয়েছে। সে উন্নয়নকে জনগণ অস্বীকার করে না। কিন্তু অন্যসব ক্ষেত্রে যে মহাবিপর্যয় হয়েছে, তা রোধ করা সম্ভব হয়নি। জাতীয় মূল্যবোধের যে অবক্ষয় হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কিনা জানি না। জাতিকে বিভক্ত করে শাসনকে দীর্ঘায়িত করার যে কৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছিল, তা দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে ঠিকই, কিন্তু জাতি হিসাবে আমাদের শক্তিহীন করেছে। জাতিকে এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। দল ও মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু সে ভিন্নতা আজ বিভক্তিতে পরিণত হয়েছে, যা আমাদের জাতি-শক্তিকে দুর্বল করেছে।

এদেশের মানুষ যে দলই করুক না কেন, তারা সবাই গণতন্ত্রের পক্ষে ও স্বৈরশাসনের বিপক্ষে অবিচল ছিল। কিন্তু গত ১৫ বছর একটি দলকে সমর্থন করতে গিয়ে অনেকেই স্বৈরশাসন ও গুম-খুনের পক্ষাবলম্বন করতে কুণ্ঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগ দেশে শুধু স্বৈরশাসনই কায়েম করেনি, জনগণের একটি অংশের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। ফলে আমাদের আগামীর গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ খুব সহজ নয়। সে কঠিন পথকে কিছুটা সহজ করার এখনই সময়। এটি একটি সুযোগ। আগামীতে গণতন্ত্রের যাত্রা যাতে কিছুটা সহজ হয়, সেজন্যই কিছু সংস্কার প্রয়োজন। ১৫ বছরের পিছিয়ে পড়া চলার পথে কিছুটা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই এ সংস্কার। সংস্কারের পর আগামীর পথটা নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক যাত্রা কেমন হবে, তার ওপর। ক্ষমতাসীন দল কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে তার ওপর। সে যাত্রাটা যাতে গণতন্ত্রের পথে শুভযাত্রা হয়, তাই কিছু সংস্কার প্রয়োজন।

সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির দায়ই বেশি। সংস্কার ছাড়াই যদি তারা গদিতে বসতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে তাদের নিয়ত ভালো নয়। আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজনীতিতে এখন বিএনপি ক্ষমতার অনেক কাছাকাছি। কিন্তু বিএনপিকে বুঝতে হবে, ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থাকা যায়। আবার ক্ষমতায় দেড় দশক থাকার পরও চট করে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে সময় লাগে না। গত ১৫ বছরে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না ঠিকই, কিন্তু নির্বাচন হলে যে বিএনপিই ক্ষমতায় যেত, এটিও জনগণ জানত। এটাই হলো প্রকৃত জনসমর্থন। আর আওয়ামী লীগ এটা জানত বলেই গত তিনটি নির্বাচন না দিয়ে জোর করে ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু এমন জনসমর্থনহীনভাবে ক্ষমতায় থাকার মাঝে কোনো মহিমা নেই। বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল, বিশ্বাস করতে চাই তারা গণতন্ত্রের পথেই হাঁটবে। কিন্তু সে পথটাই তো এখনো গণতান্ত্রিক নয়। এ পথকে সংস্কার না করলে যে-ই সেই পথে হাঁটবে, স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে যাবে। আমাদের সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, আইন, প্রশাসন, পুলিশসহ সব খাতকেই আগে কিছুটা গণতান্ত্রিক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। এটাই সংস্কার। সেই মৌলিক সংস্কারের আগে নির্বাচন মানে আত্মহত্যা। আবারও একই পথে হাঁটা। তাই সংস্কার প্রশ্নে বিএনপিকেই উচ্চকণ্ঠ হতে হবে।

এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম