আমলাতন্ত্র কি রাজনীতিকদের সহযোগী ছিল না?
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থনীতিসংক্রান্ত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সচিবদের বৈঠকে তারা দাবি করেছেন, ‘বিগত সরকারের আমলে জনপ্রশাসন সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির কাছে জিম্মি ছিল।’ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলি, তাদের এ বক্তব্য মোটেও পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়, আংশিক সত্য মাত্র। সত্যের সিংহভাগটুকু এই যে, আমলারা এ সময় যতটা না জিম্মি দশায় ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি তাদের কেউ কেউ রাজনীতিকদের জিম্মি করে তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মূলধারার গণমাধ্যম-এসব সূত্রের তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিগত ১৫ বছরে অবৈধ ও অযৌক্তিক হারে সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের তুলনায় আমলাদের কেউ কেউ কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিলেন না। এটি দেশের অভ্যন্তরে সম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনই সমান সত্য অবৈধ উপায়ে বিদেশে সম্পদ পাচার করে সেখানে বাড়ি-ফ্ল্যাট ও অন্যান্য সম্পত্তির মালিকানা অর্জনের ক্ষেত্রেও। এ ধরনের প্রবণতায় অতিষ্ঠ ও বিরক্ত হয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন তো প্রকাশ্যেই আমলাদের অর্থ পাচারের এসব ঘটনায় তার বিরক্তি ও অস্বস্তির কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তো, আমলারা যদি রাজনীতিকদের কাছে জিম্মিই থাকতেন, তাহলে রাতারাতি তাদের কেউ কেউ দেশে-বিদেশে এত অবৈধ সম্পদের মালিক হলেন কেমন করে? জিম্মি থাকলে তো এমনটি হওয়ার কথা নয়।
তবে এটি অবশ্যই সত্য যে, আওয়ামী ঘরানাবহির্ভূত হিসাবে চিহ্নিত আমলারা বিগত সরকারের আমলজুড়েই ব্যাপকভাবে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশকেই হয় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হয়েছিল কিংবা বিভিন্ন অধস্তন বা গুরুত্বহীন পদে পোস্টিং দিয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, সেখানে তাদের পক্ষে কাজ করার বা অবদান রাখার কোনো সুযোগই ছিল না। তবে বাদবাকি সংখ্যাগরিষ্ঠরা যে প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গেই ছিলেন, তাতে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই। এবং এতটা দাপটের সঙ্গে ছিলেন যে, মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য ও অন্যদের নিয়মিত অভিযোগ ছিল যে, আমলারা রাজনীতিকদের কথা শুনছেন না। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক শিল্প মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন যে, ‘আমলারা...কিচ্ছু পরোয়া (কেয়ার) করেন না। তারা তাদের মতো করে চলেন। আমি মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে এ কথা বলছি’ (প্রথম আলো, ২৩ মে ২০২৩)। রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ তখন হরহামেশাই ছিল। এমনকি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েও সংসদ-সদস্যরা এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এসব নিয়ে তারা তাদের অনুযোগের কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে কোনোই প্রতিকার মেলেনি। আসলে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত ও প্রশ্রয়ে আমলারাই বস্তুত ওই সময় দেশ চালিয়েছেন এবং তারাই ছিলেন প্রকৃত সরকার। ফলে আমলারা যে ৩ নভেম্বর বললেন, বিগত সরকারের আমলে তারা রাজনীতিকদের কাছে সম্পূর্ণ জিম্মি ছিলেন-এ কথা সর্বাংশে অসত্য।
পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ কিংবা ছাগলকাণ্ডখ্যাত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান অথবা আমলাতন্ত্রের আরও অনেক সদস্যই যে বিগত সরকারের আমলে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন, তারা যদি সত্যি সত্যি জিম্মিই থাকতেন তাহলে এটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে? বরং বলা যেতে পারে, দেশে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছি থাকা এমন আমলা খুব কমই রয়েছেন, যারা গত ১৫ বছরে নিজেদের শান-শওকত ও সম্পদের জৌলুসে স্ফীত হননি। এ সময় তারা বরং রাজনীতিকদেরই উলটো জিম্মি করে নানা অনানুষ্ঠানিক কৌশলে তো বটেই, আনুষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে থেকেও নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। এ জিম্মি কৌশল প্রয়োগ করে তারা নিজেদের জন্য যে বেতন কাঠামো ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি বাগিয়ে নিয়েছেন, তা কি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও সমাজের অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষের আয়-উপার্জনের সঙ্গে এতটুকু সংগতিপূর্ণ? মোটেও নয়। বরং এসবের কারণেই বাজেটের ৪৩ শতাংশ এখন আমলাদের করতলগত, অর্থাৎ এ ৪৩ শতাংশ অর্থ এখন ব্যয় হচ্ছে তাদের বেতনভাতা ও আনুষঙ্গিক পরিচালন ব্যয় বাবদ। এরপরও কি মানতে হবে যে, বিগত সরকারের আমলে আমলারা রাজনীতিকদের কাছে জিম্মি ছিলেন?
দেশে বিগত তিনটি সাধারণ নির্বাচন যে অংশগ্রহণভিত্তিক হতে পারল না, তার জন্য দরবেশ-কাদের-আসাদ-হাছান পরিবেষ্টিত শেখ হাসিনার স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত যেমন দায়ী, তেমনই প্রায় সমান দায়ী এসব অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে আমলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতাও। আমলারা, বিশেষত ইন্ধন ও সহযোগিতা না জোগালে শেখ হাসিনার পক্ষে কিছুতেই ও কোনোভাবেই এরূপ একতরফা নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হতো না। অথচ একতরফা নির্বাচনের দায়ভার এখন শুধু রাজনীতিকদের ওপর চাপিয়ে তাদেরই বিচার করা হচ্ছে-আমলারা পুরোপুরিই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। কিন্তু ২০১৮-এর সাধারণ নির্বাচনের দিনের জন্য নির্ধারিত ব্যালটগুলো আগের রাতে প্রশাসনের হাতেই ছিল এবং সিলগুলোও তারাই মেরেছিল। আর যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সে রকম একটি অবৈধ নির্বাচন আয়োজনের অপতৎপরতায় সরাসরি যুক্ত থাকার অপরাধে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না? কেন ২০২৪-এর নির্বাচনে অস্বাভাবিক ভোটদান দেখিয়ে বানোয়াট স্ফীতকায় ফলাফলের জন্য নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি আমলাদেরও দায়ী করা হবে না?
একইভাবে সম্ভাবনাবিহীন মেগা প্রকল্পের ডিপিপি তো আমলারাই তৈরি করে একনেকের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিলেন। আর এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়নকালীন দুর্নীতির সিংহভাগ যে তাদের মাধ্যমেই হয়েছে, সেটি তো এখন সর্বজনবিদিত। এ সময় তারাই তো অসৎ উদ্যোক্তাদের অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কোটি কোটি টাকার কর-শুল্ক মওকুফ পাওয়ার সুবিধা করে দিয়েছিল। করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের নাম করে তথাকথিত প্রণোদনা তহবিল গঠনের মাধ্যমে সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনাগুলো আমলাদের সহযোগিতা ছাড়া কখনোই সম্ভবই ছিল না। ব্যাংকিং ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সহযোগিতা ছাড়া বিদেশে অর্থ পাচার কি কোনোদিন সম্ভব ছিল? জনস্বার্থবিরোধী শর্তে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন ও আদানির গাড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বহু কেনাকাটা বিনা দরপত্রে করে ফেলা, নিয়মনীতি ভঙ্গ করে অনুগতদের রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি ও জমি বরাদ্দ-দান ইত্যাদি আমলাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা ছাড়া হয়েছে, এটি কোনো শিশুও বিশ্বাস করবে না। তাহলে এসব দুর্নীতির জন্য বিচারের আওতায় শুধু রাজনীতিকরা আসবেন কেন? কেন একই অভিযোগে একই সঙ্গে আমলাদেরও অভিন্ন শাস্তির আওতায় আনা হবে না?
মোট কথা, আমলারা যে তাদের ৩ নভেম্বরের বক্তব্যে বোঝাতে চাইলেন, বিগত সরকারের আমলে তারা যেসব অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেগুলো তাদের ইচ্ছাকৃত নয়, নিছকই রাজনীতিকদের চাপে পড়ে করা, তাদের সেসব দাবি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তারপরও যদি তারা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চান, তাহলে সেটি তাদের করা উচিত আদালতে গিয়ে। কিন্তু ওইসব অন্যায়ের জন্য রাজনীতিকদের মতো আমলাদেরও আদালতের কাছে ন্যস্ত করা প্রয়োজন। এতকাল রাজনীতিক ও আমলা-তারা ছিলেন সমন্বিত ভাগবাঁটোয়ারাজনিত বন্দোবস্তের অধীনে। এ থেকে বেরোতে হলে এখন সে কায়েমি বন্দোবস্ত অবলোপন করে রাজনীতিক-আমলা সম্পর্ককে সর্বাগ্রে রাষ্ট্রস্বার্থের অনুগামী করে তুলতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের যেসব কথা বলছে, তার মধ্যে রাজনীতিক-আমলা সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণের এ বিষয়টির একটি অন্যতম বড় সংস্কার হওয়া উচিত বলে মনে করি।
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক)
atkhan56@gmail.com