Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভ্রষ্ট রাষ্ট্রনীতিই কি রাজনীতি?

Icon

মোহাম্মদ হোসেন

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ লেখাটি ২০২৪-এর জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ২৩-২৪ জুলাইয়ে লিখিত। ওই সময় এ লেখকের একজন আত্মীয় মাথায়, বুকে অন্তত ১০০ গুলি-পিলেট বিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে তাকে দেখে এসে এবং বিগত কয়েকদিনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনকারীদের বর্বরতা এবং গত ২ দশকের ভয়ংকর রাজনৈতিক সংস্কৃতির অপছায়ার ছাপ লেখকের মনে বিদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে যে বেদনা বোধের দহন সৃষ্টি হয়েছে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্যই এ লেখা শুরু করা হয়। গত ১ আগস্ট লেখকের ওই আত্মীয় আইসিইউতে শাহাদতবরণ করেন। তখনকার প্রেক্ষাপটে লেখক নিজেই বাস্তব কারণে লেখাটি ছাপাতে সাহস করেননি। সে লেখাটি সামান্য কিছু সম্পাদনা করে ছাপানো হলো। লেখক তার এ লেখাটি ওই শহিদ আত্মীয়কে উৎসর্গ করেছেন।

রাষ্ট্র কী? রাষ্ট্র কেন? রাষ্ট্র কার? রাষ্ট্রব্যবস্থা কে পরিচালনা করবে? তার দায়িত্ব কী? তার রুচি, যোগ্যতা, শিক্ষা, সততা কেমন হওয়া উচিত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এখনকার যুগে বা সময়ে যিনিই লেখালেখি করুন না কেন, আদর্শত নতুন কিছু লেখার নেই। এ বিষয়ে বিভিন্ন যুগে যেসব যুগোত্তীর্ণ তত্ত্বের অবতারণা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে পরিশুদ্ধ হয়েছে, আধুনিককালে তার ভিত্তিতে বহু দার্শনিক বহু তাত্ত্বিক সূত্র রচনা করেছেন। বহু মনীষী, রাষ্ট্রনায়ক তা ব্যবহারিক প্রয়োগ করে চিরস্মরণীয় হয়েছেন। আবার বহু ভুল তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের মাত্রাগত সীমা লঙ্ঘনের কারণে বড় বড় যুদ্ধের সৃষ্টি হয়েছে এবং কিছু মানুষ যুগে যুগে চির ঘৃণার পাত্র হয়ে ইতিহাসনিন্দিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তাহলে এ বিষয়ে নতুন করে লেখার প্রয়োজনীয়তা কী? প্রয়োজনীয়তা এজন্য যে, পুঁথি, পত্রে, ইতিহাসে যা-ই লেখা থাকুক, নতুন প্রজন্মের জন্য তা আবারও আলোচনা করা প্রয়োজন হয়। যারা জানে, তারাও অনেক সময় মৌলিক কাঠামোগুলো ভুলে গিয়ে আবোল-তাবোল বকে, তাদেরও স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়। মধ্যযুগে ধারণা করা হতো রাষ্ট্রের মালিক ঈশ্বর এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করবে ঈশ্বরের প্রতিভূ। প্রকারান্তরে ঈশ্বরের প্রতিভূরাই রাষ্ট্রের মালিক। আর এ মালিকরা হলেন কখনো ধর্মপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, কখনো রাজা বা সম্রাট, কখনো বা তারা মিলেমিশে ক্ষমতাংশ বিভাজন করে সমঝোতাভিত্তিক মালিকানা চর্চা করতেন। তার মানে হলো রাষ্ট্রের মাটি-মানুষ, গরু-গাধা-ঘোড়া-ছাগল সব কিছুর মালিক ওই ঈশ্বরের প্রতিভূরা এবং তারা ওই সব প্রাণী (মানুষসহ) ও বস্তুর সঙ্গে তাদের খেয়াল-খুশি মতো ব্যবহার করতে পারে।

যুদ্ধবিগ্রহ, বিপ্লব-রক্তপাত করে ওই ধারণার পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সমঅধিকারের পত্তনের মাধ্যমে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়েছে। একইসঙ্গে কে, কীভাবে, রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, তার মূলনীতিও নির্ধারিত হয়ে আছে। আর ওই রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়েও বিস্তর আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং অদ্যাবধি চলছে। মানুষই শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনা করবে বা করে। যদিও সাহিত্য-সিনেমায় এখন অন্যান্য প্রাণীদেরও রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসাবে বলে রাখা যায়, মি. জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ উপন্যাসে শূকরেরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। যা-ই হোক, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে যেমন স্বীকৃত, তেমনি মানুষই জীবজগতের নিকৃষ্টতম প্রাণী। গাছপালা, তরুলতা, পশু-পাখি প্রকৃতির নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনিবার্যভাবেই মেনে চলে অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়ম ভাঙে না। একমাত্র প্রাণী মানুষ, যে প্রকৃতির সব নিয়ম ভাঙে বা লঙ্ঘন করে। কাজেই এ দুশ্চরিত্রবান মানবপ্রজাতি নিয়মিত শিক্ষা গ্রহণ না করলে যে কী বীভৎস হতে পারে, তা যুগে যুগে ঊর্ধ্বলোক-ইহলোক সবাই দেখেছে এবং দেখে যাচ্ছে।

রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিকে রাষ্ট্রনীতি বলা হয়; আর এ রাষ্ট্রনীতিকে সরলীকরণ করে বলা হয় রাজনীতি। আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যক্তি এবং ব্যক্তিসমষ্টিভেদে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নীতি বা রাজনীতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষণীয়, কৌশলগত বা প্রয়োগগত দিক থেকে। কিন্তু মৌলিক কাঠামোতে গুরুত্বের কোনো পার্থক্য থাকে না। আর যদি মৌলিক কাঠামোতে গুরুতর কোনো পার্থক্য সৃষ্টি হয়, তাহলে রাষ্ট্র বিকৃত, বর্বরযুগীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়। যদি একজন বা কতিপয় মিথ্যুক বা মিথ্যাবাদী মানুষের রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের পরিণতি কেমন হতে পারে! তার উদাহরণ বাংলাদেশে চলমান সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রের মালিকরা, চৌকিদারেরা, চাকরেরা সবাই মিলে বলছে, আন্দোলন করা নাকি অন্যায় হচ্ছে। গুলি রাষ্ট্রীয় বাহিনী করছে না। আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেই কেউ গুলি করে মানুষ মেরে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে ইত্যাদি।

এরূপ ঘটনা থেকে দুটি পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় : ১. এ রাষ্ট্রের সব মানুষ মিথ্যাবাদী এবং তাদের প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনাকারীও মিথ্যাবাদী। কাজেই সবাই মিলে মিথ্যার মহোৎসব করতে পারে; অথবা ২. রাষ্ট্রব্যবস্থাটি কতিপয় মিথ্যাবাদীর কবলে নিপতিত হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের কাছে মানুষের জীবন মূল্যহীন। প্রকৃত অর্থে কিছুসংখ্যক মানুষ সর্বদাই মিথ্যার মহোৎসবে মেতে থাকে। তারা নির্মম-পাশবিক-বর্বর জীবনের পার্থিব স্বাদ গ্রহণ করতে করতে প্রকৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য ভুলে যায়। পরকাল, আখেরাত বা শেষ বিচার আর জাহান্নামের কথা ভুলে যায়। আর কিছুসংখ্যক মানুষ অমানবিক জীবন নিয়ে প্রার্থনা করতে করতে পারলৌকিক সুখের আশায় বেঁচে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো তৃতীয় আরও এক ধরনের মানুষ নিয়ে, যারা এর কোনোটাই পারে না। তাদের কাছে পার্থিব জীবনটাই একটা জাহান্নাম হয়ে যায়। তারা বিদ্রোহ করে, বিপ্লব করতে চায়, সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তারা ওই বর্বরতা বা ওই অসহ্য জীবন থেকে মুক্তি চায়। ফলে শুরু হয় রক্তপাত, জীবনহানি, ধ্বংস। অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মে জ্বলতে পারে। মিথ্যুক বা মিথ্যাবাদী রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের একটি বড় উদাহরণ হয়ে রয়েছে জার্মানির ‘নাৎসি শাসকগোষ্ঠী’। জার্মানরাই আদি আর্য বা ব্লু ব্লাড। হিটলারের রাজনৈতিক তত্ত্ব হলো, শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে শাসন করা একমাত্র তাদেরই অধিকার। ম্যাকিয়াভেলি ও নীটশের তত্ত্বের ওপর গড়ে ওঠা এ রাষ্ট্রনীতির ভ্রান্ত ব্যবহারিক প্রয়োগ করে নাৎসি বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল এবং বিশ্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়েছিল, তা মানবজাতি বোধহয় প্রায় ভুলতে বসেছে। এখন আবার নাৎসিদের শিক্ষা বহুগুণে ছড়িয়ে পড়েছে, দেশে দেশে। ‘গোয়েবলসের’ মিথ্যাচর্চা সহস্রগুণে বেড়ে গেছে। গোয়েবলসের শিক্ষায় বর্তমানকালের কোনো কোনো রাষ্ট্র পরিচালকরা এতটা উৎকর্ষ এনেছে যে, গোয়েবলস বেঁচে থাকলে তিনিও আশ্চর্য হয়ে হার্ট অ্যাটাকও করতে পারতেন। নিদেনপক্ষে তার উত্তরাধিকারীদের মহাগুরু হিসাবে স্বীকার করে নিতেন। এ মিথ্যা চর্চার একটি অন্যতম কুফল বা সুফল হলো, তা মগজের মধ্যে গাঢ় অন্ধকার তৈরি করে দেয়। ফলে এ মিথ্যাবাদী গোষ্ঠীর দৃষ্টি অন্ধ হয়ে যায়। শ্রবণশক্তি বধির হয়ে যায়। তারা আর কিছু দেখতে বা শুনতে পায় না। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার আর তার অন্ধ অনুগত বাহিনীর অনেক ঊর্ধ্বতন জেনারেল তাদের সম্ভাব্য পরাজয় দেখতে পায়নি বা পরাজয়ের পদধ্বনি শুনতে পায়নি। নাৎসিদের অবস্থা মহাভারতের অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র আর তার সহধর্মিণী এবং সহযোগীদের চেয়ে খারাপ হয়েছিল। ধৃতরাষ্ট্র তো শুধু অন্ধ ছিল। পতিব্রতা স্ত্রী গান্ধারী গামছায় চোখ বেঁধে স্বেচ্ছায় অন্ধত্ববরণ করেছিল। ফলে তারা পুত্রগণ দুর্যোধন আর দুঃশাসকদের কুকর্ম দেখতে পায়নি। তবে তারা বধির ছিল না, ফলে শুনতে পেয়ছে। বিদুর নামক একজন তাদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করে শোনাত। দেখা ও শোনা, এ দু’প্রক্রিয়ায় অনুভূতি সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য আছে। দেখার উদ্দীপনা অনুভূতিকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। যেমন শহিদ আবু সাঈদের হত্যার দৃশ্য দেশব্যাপী প্রবল গণজাগরণ ঘটিয়েছে। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বই হয়তো কুরুক্ষেত্রের সব নির্মম ঘটনার জন্য দায়ী। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র যদি সত্যিটা দেখতে পেত, তাহলে হয়তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেরই প্রয়োজন হতো না। সে চাইলে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারত। সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারত।

একটি আধুনিক রাষ্ট্রের পরিচালকরা যদি ওইরূপ অন্ধ-বধির, মিথ্যুক আর মহাভারতের কৌরবদের মতো অত্যাচারী এবং তাদের মামা শকুনির মতো কুটাচারী হয়, তাহলে এটি যে আর রাষ্ট্রই থাকে না। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, ক্রমান্বয়ে সমতাভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং পরিচালনা করা। মানুষ এমন একটি জীব যে, প্রত্যেকটা মানুষ বৈশিষ্ট্যগতভাবে স্বতন্ত্র। প্রত্যেকের স্বতন্ত্র আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা ও লক্ষ্য থাকে। এ মানুষ নিয়ে, এ মানুষকে দিয়ে এবং এ মানুষের জন্য যে ব্যবস্থাই গড়ে তোলা হোক না কেন, তা কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় না। সবাই সমভাবে সন্তুষ্ট হয় না। পরিচালনাগত ত্রুটির কারণে ব্যবস্থাটি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ে বা একপেশে হয়ে যায়। কাজেই ব্যবস্থাটি সমতাভিত্তিক কার্যকর করার জন্য সময়ে সময়ে মেরামত ও শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন হয়। কিন্তু পরিচালক অধিকর্তারা যদি অন্ধ এবং বধির হয়, তারা তো ব্যবস্থায় ক্ষয় দেখতে পায় না বা ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পায় না। তখন বিষয়টা এ রকম হয় : যেমন, একজন অন্ধ-বধির গাড়িচালক তার গাড়ির নিচে শতসহস্র জনতা চাপা দিয়ে দিতে পারে বা তার সব যাত্রীসহ গাড়িটি খাদের মধ্যে নামিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ যারপরনাই এ রকম জঘন্য বীভৎস ঘটনা ঘটাতে পারে। তা না ঘটা পর্যন্ত অনেকেই বুঝতে পারে না। এ গাড়িচালক যদি হয় মিথ্যাচারী, তাহলে সে এ জঘন্য ঘটনার জন্য কোনো দায়ও স্বীকার করে না। বরং যাদের জীবনহানি হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে, তাদের অথবা রাস্তার পাশে কোনো খাদ থাকলে তার ওপর দায় চাপিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করে। এরূপ একটি ব্যবস্থায় কোনো বোধ, বুদ্ধি বা অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ বাঁচতে পারে না।

সমতাভিত্তিক একটি গড়পড়তা ন্যায্য ব্যবস্থা চালু থাকলে শতকরা আশি ভাগ মানুষ তার সঙ্গে মানিয়ে চলে। ব্যবস্থাটা আরও একটু উন্নত হলে আরও কিছু মানুষ সন্তুষ্টিসহ ব্যবস্থার সঙ্গে চলে। কিছু মানুষের ভিন্নমত-ভিন্নধারা থাকতে পারে, তাদের বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য মাত্রায় সমন্বয় করা হলে সন্তুষ্টিসূচক আরও ঊর্ধ্বগামী হয়। কিন্তু ব্যবস্থাটা যদি শুধু কতিপয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণিকে সব সুবিধা অবারিত করে দেওয়ার জন্যই তৈরি করা হয়, তাহলে ওই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠবেই। তাতে কে মরবে, কে বাঁচবে সে প্রশ্ন গৌণ হয়ে যায়। ব্যবস্থা নির্মাণকারী কলাকুশলীরা, ব্যবস্থা পরিচালনাকারীরা অন্ধ-বধির এবং অকাট্য মিথ্যাচারী এবং প্রবল হিংস্র না হলে এ ধরনের একটা ধ্বংসাত্মক অমানবিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই পারে না। তখন এ ধরনের বিকৃত ব্যবস্থা নির্মাণকারী-পরিচালনাকারী এবং নির্মিত ব্যবস্থাটি পরস্পর পরিপূরক হয়ে যায়। ইঞ্জিন দেখে বোঝা যায় ইঞ্জিনিয়ার কারা, বিপরীতে ইঞ্জিনিয়ার দেখে বোঝা যায় ইঞ্জিন কেমন হবে। এখন আমাদের সেই নিষ্ঠুর ব্যবস্থার মধ্যেই বসবাস করতে করতে জীবন জাহান্নামে পর্যবসিত হয়েছে। এখন বোধহয় এ অন্ধ, বধির, মিথ্যার সাম্রাজ্যে রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতির সব সংজ্ঞা পালটে গেছে। এ ধরনের অপরাজনীতি সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন প্রকাশ না করলেই নয়। আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার কোনো একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তার ক্লাসে ছাত্রদের প্রশ্ন করেছিলেন, রাজনীতিবিদরা কখন মিথ্যা বলা শুরু করে। ছাত্ররা অবাক দৃষ্টি নিয়ে অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে রইল। তিনিও মুখ বন্ধ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ছাত্ররা তখন পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিল। ক্লাসের অবস্থা বেগতিক দেখে প্রফেসর সাহেব নিজেই তার উত্তর দিয়ে বলেছিলেন, ‘When a politician opens his lips’. আমেরিকার একজন সরকার বা সরকারপদ্ধতি বা রাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রবীণ অধ্যাপকের উপলব্ধি এমনই। আমরা সাধারণ মানুষ আর কী বলব! ওই সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ছিলেন।

পরিশেষে বলে রাখা ভালো, একটা সময় ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিকে রাজনীতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হতো বা সমাস নির্ণয় করতে গিয়ে নীতির রাজাকে রাজনীতি বলা হতো। তবে এখন রাজনীতির নামে যা হচ্ছে, তা কোনো সভ্য মানুষের সহ্যসীমার মধ্যে নেই। এখন বোধহয় বলা যায় ‘রাষ্ট্রনীতি’ যখন ভ্রষ্ট হয়, তখন তা ‘রাজনীতি’ হয়। অথবা রাজার নীতিই রাজনীতি, হোক তা ভ্রষ্ট বা নষ্ট নীতি।

মোহাম্মদ হোসেন : লেখক ও বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম