অন্যমত
স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন ধৈর্যের
আবু আহমেদ
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায়ের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বর্তমান এ সরকারের ১০০ দিন পার হয়েছে। তারা কী করতে পেরেছে বা পারেনি, সময়ই তা বলে দেবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে কিছুটা সময় তো তাদের দিতেই হবে। দেশের অর্থনীতির ডাউনকাউন্ট তো শুরু হয়েছে হাসিনার আমল থেকেই। বড় বড় মেগা প্রকল্পের আওতায় দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়ে গেছে। আর এসব মেগা প্রকল্প থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা লুটেরারা লুট করে নিয়ে গেছে। এসব লুট করা অর্থের বিশাল অঙ্ক দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির এসব ঘাটতি মোকাবিলা করা হুট করেই সম্ভব নয়। এসব কিছুকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে হলে কিছুটা সময় তো লাগবেই। হাসিনার সময় অলিগার্কই বলি আর মাফিয়াই বলি, তাদের হাতেই বন্দি ছিল দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এ অবস্থায় অর্থনীতিকে প্রকৃত জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনা কঠিন তো বটেই। সুতরাং, আমাদের একটু ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করতে হবে টানেলের শেষে আলো দেখার জন্য।
আলহামদুলিল্লাহ, ডলারের মূল্য একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। এতে কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা যায়। তবে দেশের বিনিয়োগ অতটা পিকআপ করতে পারেনি এখনো। দেশের অবস্থা স্থিতিশীল থাকলে ধীরে ধীরে বিনিয়োগেও ভালো কিছু আসবে বলে আশা করা যায়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকারকে সুদের হার বাড়াতে হয়েছে। তবে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফলপ্রসূ কিছু হবে বলে মনে হয় না। তারপরও যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক টাইট মানিটারি পলিসি পার্স্যু করছে, সেহেতু অতটা হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। কিন্তু টাইট মানিটারি পলিসির পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে। এটি করতে গেলে সুদের হার বেড়ে যায়। সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ কমে যায়, কনজাম্পশনও কমে যায়। শুধু তাই নয়, এর ফলে ট্যাক্স কালেকশনও কমে যায়। আবার লিবারেলি মানিটারি পলিসি পার্স্যু করলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। এটাই হচ্ছে অর্থনীতির মন্ত্র। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সুদের হার কমানো হচ্ছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাথায় রাখা উচিত। তাছাড়া লুটেরাদের অর্থ পাচার এবং মেগা প্রকল্পের কারণে অনেক ব্যাংকই খালি হয়ে গেছে। তারল্য সংকট চলছে। গ্রাহকের টাকা তারা দিতে পারছে না। এতে করে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই ঝুঁকি আছে জেনেও অনেকে নিজ গৃহেই টাকা রাখছে। যার ফলে ব্যাংকে লেনদেন কমে যাওয়ায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আমি একটা অনুরোধ করতে চাই, সেটা হচ্ছে, যেসব ব্যাংক খুব দুর্বল অবস্থায় রয়েছে, যাদের ডিপোজিটরদের টাকা দিতে অসুবিধা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের টাকার জোগান যেন দেওয়া হয়। তা না হলে ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কারণ, আমরা অতীতে দেখেছি, একটা-দুইটা ব্যাংক সমস্যায় পড়ে গেলে, অন্য ব্যাংকগুলোও সমস্যায় পড়ে যায়। ফলে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং ব্যাংকে লেনদেন করা থেকে বিরত থাকে। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তত কিছু ব্যাংককে, বিশেষ করে ইসলামি ধাঁচের ব্যাংকগুলোকে তারল্য সরবরাহ করে একটু হলেও সাপোর্ট দেওয়া উচিত। তবে আমাদের ব্যাংক গ্রাহকদেরও মনে রাখা উচিত, ভয়ে হোক বা আতঙ্কে হোক, সবাই যদি একসঙ্গে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেলতে চায়, তাহলে ব্যাংকে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, যায় ফলে কেউই টাকা তুলতে পারবে না। আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে কিছুটা ধৈর্য ধরলে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে আসবে। ব্যাংকের নিয়ম হচ্ছে, কেউ ডিপোজিট রাখবে, কেউ হয়তো তুলবে। এখন যে ব্যাংকে ডিপোজিট হচ্ছে না এবং লুটেরারা আগে থেকেই টাকা-পয়সা লুট করে নিয়ে গেছে, এমন ব্যাংককে গ্রাহকের টাকা দিতে সমস্যা তো হবেই। এ অবস্থায় মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে একটু লিবারেল হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেটা আগে বলেছিল, শক্তিশালী ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলো যেন টাকা ধার করে, সেটা হয়তো এখন আর হচ্ছে না। কারণ, সবল ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলো ঠিকমতো অর্থ পাচ্ছে না। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের মাথায় রেখে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
রিকনস্ট্রাকশন বা ব্যাংকের পুনর্গঠন করার সময় ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ইসলামী ধাঁচের লোক দেওয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ বোর্ড গঠন করার সময় ইসলামী ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাস করে এমন লোক দেওয়া উচিত ছিল। সেক্যুলার লোক দিলে, ইসলামবিদ্বেষী লোক দিলে ওটা তো ইসলামী ব্যাংক হবে না। কারণ ইসলামী ব্যাংক তো ইসলামী বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই চলে। যারা সুদি কারবারে দক্ষ, তাদের যদি বসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তো ওই ব্যাংক ঠিকমতো চলার কথাও নয়। কারণ এতে বিশ্বাসের ঘাটতি থাকবে।
বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। আইপিওতে কয়েক হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে। ওটা যদিও পাইপ লাইনে আছে, তবে হয়ে যাবে হয়তো, আশা করা যায়। তবে আমি রেগুলেটরকে অনুরোধ করব, মার্জিন লোনের কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, এ বিষয়টি যেন আমলে নেওয়া হয়। সুদের হার কমাতে হবে। কারণ ১৬-১৭ পার্সেন্ট সুদ দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে লাভ করা দুষ্কর। শেয়ারবাজার দুই বছর ফ্লোর প্রাইসে পড়েছিল এবং বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত অর্থের সুদও কাউন্ট হয়েছে। ফলে তারা অনেকটা ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছে। অথচ শেয়ারবাজারের গ্যাম্বলাররা গেম খেলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। তারা যে শেয়ারের দাম ১০০ টাকায় উঠিয়ে ছিল, সে শেয়ারের দাম এখন ২০ টাকা। তার সঙ্গে আবার সুদও যোগ হয়েছে। ট্রেজারি বন্ডে চলে গেছে এসব টাকা-পয়সা। ফলে শেয়ারবাজারে একটা ডিপ্রেশন চলে এসেছে। শেয়ারবাজারের এ ডিপ্রেশনকে ওভারকাম করার জন্য সুদের হার একটা সময় যদি কমে আসে, তাহলে হয়তো সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সহসা সুদের হার যদি না-ও কমে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে কমবে বলে আশা করা যায়। মার্জিন লোনের ব্যাপারে সরকারকে শক্ত অবস্থানে থাকা উচিত বলে মনে করি। মার্জিন লোনের মাধ্যমে শেয়ার ট্রেডিং করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কখনো সুবিধা করতে পারেনি। সুবিধা করেছে ওই গ্যাম্বলাররা। যারা শেয়ারবাজারে কারসাজি করেছে, যারা বড় জুয়াড়ি ছিল; এসব লোক ৮০ টাকার শেয়ার নিয়ে গেছে ৮০০ টাকায়, আবার ২০ টাকার শেয়ার নিয়ে গেছে ২০০ টাকায়। ৪৫ টাকার শেয়ার নিয়ে গেছে ৩০০ টাকায়। আকাশচুম্বী এসব দাম তো ওই জায়গায় থাকে না, এগুলো হচ্ছে মেনুপুলেটেড প্রাইস। এসব মেনুপুলেটেড প্রাইসে শেয়ার কিনে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীরাই নিঃস্ব হয়েছে। এজন্য আমি মনে করি, মার্জিন লোনের ভিত্তিতে শেয়ার ব্যবসা করার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, এটি বন্ধ করতে হবে। এজন্য আমাদের বাজারে হয়তো টার্নওভার কম হবে। কিন্তু সর্বনাশ থেকে অনেক বিনিয়োগকারীই রক্ষা পাবে। প্রকৃত বিনিয়োগকারী, যারা মার্জিন লোন ছাড়া ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে, তারা অতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, হলেও তারা হয়তো বিনিয়োগের ২০-২৫ পার্সেন্ট হারিয়েছে। আর যারা মার্জিন লোনের ওপর নির্ভর করে শেয়ার ব্যবসা করত, তাদের বিনিয়োগের ৬০-৭০ পার্সেন্টই নেই।
শেয়ারবাজারকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আনতে হলে ভালো ভালো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে। যদি সেটা করতে পারে, তাহলে সেটা হবে বড় সাফল্য। ভালো শেয়ার আনতে হলে তাদের প্রণোদনা দিতে হবে, ট্যাক্স রিলেটেড ইনসেনটিভ দিতে হবে। প্রণোদনা ছাড়া ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসবে কেন। একটা হচ্ছে, তারা বুকবিল্ডিংয়ে মার্কেট প্রাইস পাবে। ট্যাক্স হ্রাসের পাশাপাশি তাদের আরও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তাদের সঙ্গে বসে চাহিদাগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে। যা-তা আইপিও শেয়ারবাজারের তালিকায় আনা ঠিক হবে না। যেটা আগে হয়েছে। অতীতে যা-তা আইপিও এনে সেগুলোকে মেনুপুলেটেড করে ওপরে দাম উঠিয়ে বিনিয়োগকারীদের খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব অখ্যাত শেয়ারের আকাশচুম্বী দাম উঠিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে টাকাগুলো বস্তা ভরে নিয়ে গেছে শেয়ারবাজারের অসাধু ব্যক্তিরা। শুধু তাই নয়, এ টাকার অধিকাংশই তারা বিদেশে পাচারও করে দিয়েছে। সুতরাং, যা-তা শেয়ারবাজারে স্থান দেওয়া উচিত নয়।
সরকারি শেয়ারগুলোকে বিক্রি করে দেওয়া উচিত। তাতে সরকারের লাভ দুই দিকে। একটা হচ্ছে সরকার টাকা পাবে। সরকার ঘাটতি বাজেট থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। আরেকটি হচ্ছে এগুলো যদি মেজরিটি অফলোড করে, তাহলে যারা আইডল বসে আছে; যেমন-ল্যান্ড বলি বা পুরোনো মেশিনারিজই বলি, সেগুলো এক্টিভিটেড হবে। প্রোডাক্টিভ ইউজে যাবে। আর এসব রি-প্রোডাকশন জিডিপিতে কন্ট্রিবিউট করবে। এতে করে শেয়ারবাজারের গভীরতাও বাড়বে। এখন তো শেয়ারবাজারের অবস্থা একেবারে ন্যারো। ১০-১৫ বছর আগে যেখানে ছিল, সেটা এখন তার থেকেও ছোট হয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও কমে গেছে। মার্চেন্ট ব্যাংক কিংবা মার্জিন লোন বাড়ছে। কিন্তু বাড়েনি শেয়ারের সাপ্লাই বা শেয়ারের কোয়ালিটি স্টক। এখন যারা অ্যাক্টিভ আছে, তারা ঋণ বিক্রি করতে চাচ্ছে। নিজেরা কোনো বিনিয়োগ করছে না। মার্চেন্ট ব্যাংকের পেরেন্ট কোম্পানি থেকে টাকা নিয়ে ১৭ পার্সেন্টে ঋণ দিচ্ছে, যারা অতি উৎসাহে তাড়াতাড়ি ধনী হতে চায় তাদের কাছে। এতে করে অর্থনীতিতে একটা বাজে প্রভাব পড়ছে। আমাদের এ বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। (অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)
অধ্যাপক আবু আহমেদ : অর্থনীতিবিদ; চেয়ারম্যান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ