পাথরে লেখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে...
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এদেশের ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা খুব নামপাগলা হন। তারা হয়তো মনে করেন, তাদের এমন মহৎ কোনো গুণ নেই বা তারা মহত্ত্বের স্বাক্ষর রেখে যেতে পারবেন না, যাতে পরবর্তীকালে মানুষ হৃদয়ে তাদের ধারণ করবে। তাদের এতটুকু আত্মবিশ্বাস নেই, কবিগুরুর মতো বলতে পারেন ‘আমার নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’।
মান্না দের বিখ্যাত গানের লিরিকগুলোও বিচার করেন না এরা। গানের কলি তো বলছে, কাগজে নাম লিখলে কাগজ একদিন ছিঁড়ে যাবে, পাথরে লিখলে পাথরও ক্ষয়ে যাবে। একমাত্র হৃদয়ে লিখলে তা রয়ে যাবে মনের গভীরে। তবুও প্রত্যেক রাজনৈতিক সরকার হৃদয় নিয়ে ভাবে না। কাগজে আর পাথরে নিজেদের নেতানেত্রী থেকে সুযোগ পেলে চৌদ্দ পুরুষের নামে নামকরণ করে রাষ্ট্রের নানা স্থাপনার। যেন সবই পারিবারিক সম্পত্তি। যদিও তারা দেখে আসছেন সরকার পরিবর্তন হলে কাগজের নামও ছিঁড়ে যায়, পাথরে খোদাই করা নামও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। তবুও আত্মবিশ্বাসহীন নেতানেত্রী ও তাদের চামচারা নিজ নাম পাথরে খোদাই করে অমর হতে চান।
মনে পড়ছে, পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশের কথা। সাত হাজার বছর আগে প্রাচীন সুমেরের খ্যাতিমান রাজা গিলগামেশকে উপজীব্য করে লেখা হয়েছিল মহাকাব্যটি। সুমেরের প্রাচীন উর নগরীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে কাদামাটির স্লেটে কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা এ মহাকাব্য পাওয়া যায়। শক্তিমান গিলগামেশও মানুষের শেষ পরিণতি ‘মৃত্যু’ দেখে শিউরে ওঠেন।
অমরত্ব পাওয়ার জন্য ডুব দেন মৃত্যু সাগরে। পাতাল থেকে নিয়ে আসেন অমর হওয়ার লতাগুল্ম। কিন্তু এক পর্যায়ে নিয়তির লিখনে লতাগুল্মটি খেয়ে ফেলে এক সাপ। গিলগামেশের নতুন উপলব্ধি হয়। বুঝতে পারেন অমরত্ব দেহে নয়, মানুষ অমর হয় তার মহৎকর্মে। তিনি ছুটে যান নিজ রাজ্যে। মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেন। সত্যিই তিনি অমর হলেন। সাত হাজার বছর পরও আমরা তার নাম নিচ্ছি।
২০১৬ সালে আমি পর্তুগালে গিয়েছিলাম। কিছুদিন থেকেছিলাম লিসবন ও ইভোরা শহরে। একটি প্রশ্ন তখন আমার মনে জাগত। শত শত বছরেও কি এ দেশে কোনো বিখ্যাত জাতীয় নেতা বা রাষ্ট্রনায়কের জন্ম হয়নি! তাদের যেন একজনই জাতীয় নেতা-‘ভাস্কো দ্য গামা’। ব্রিজ, স্টেডিয়াম, সুপারমল সবকিছুই শুধু ভাস্কো দ্য গামার নামে। আমরা বিশ্বের বড় বড় দেশের দিকে তাকাই; যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, দেশকে মুক্ত করতে-স্বাধীন করতে নেতৃত্ব দিয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা শুধু তাদের নামেই নামকরণ করা হয়ে থাকে। তাই সরকার পরিবর্তন হলে সেসব নামের ওপর আঘাত আসে না।
গত ১৪ নভেম্বর একটি সেমিনারে যোগ দিতে এশিয়াটিক সোসাইটিতে এসেছিলাম। চানখাঁর পুলের দিক থেকে মোড় ঘুরতে চোখে পড়ল মাস দুই আগে দেখা শেখ হাসিনা বার্ন হাসপাতালের দিকে। এরই মধ্যে উধাও হয়ে গেছে নামফলক। দেশজুড়ে শেখ পরিবারের অনেকের নামেই নামফলকের ছড়াছড়ি ছিল। এক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই শেখ পরিবারের পাঁচ সদস্য ও বেগম খালেদা জিয়ার নামে মোট ছয়টি স্থাপনা রয়েছে। আপাতত তো শেখ পরিবারের চারটি নাম ঝুঁকিতে আছে। ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে’র নামটি হয়তো বেঁচে যেতে পারে। কারণ শোনা যায়, শেখ হাসিনার সঙ্গে তার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সম্পর্ক খুব মধুর ছিল না। বেগম জিয়ার নামটি হয়তো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আপাতত টিকে যাবে।
ইতোমধ্যে নোটিশ পেলাম ‘বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নাম ছাঁটা হয়ে গেছে। অদ্ভুত সাংস্কৃতিক আচরণ আমাদের। নামকরণ করতেও দেরি করি না, দেরি করি না নাম ছাঁটতেও। এসব দেখে নিজের একটি সংকটের কথা মনে হলো। বইতে একটি উৎসর্গ পাতা থাকে। আমার লেখা অনেক বই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্রদ্ধেয়, সম্মানিত ও প্রিয় অনেকের নামে উৎসর্গ করা হয়ে গেছে। বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এরপর শুরু করলাম পরিবারের সদস্যদের নামে উৎসর্গ করা। অতঃপর সংকটে পড়লাম। এখন উৎসর্গ করছি অচেনা-অদেখা পাঠকদের। আসলে বুদ্ধিমান হলে আমাদের নেতা-নেত্রীদের অনুসরণ করতে পারতাম। একজনের নামে একাধিক বই উৎসর্গ করা যেত। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও শেখ রাসেলের নামে দেশে কতগুলো স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে, তা বোধহয় এখন গবেষণার বিষয়।
এটি আজ নতুন নয়, ক্ষমতা বদলের পর নাম যে পরিবর্তিত হয়, তা তো একরকম অবধারিত। যার নাম উচ্ছেদ করা হয়, তিনি কি এতে অপমানিত হন না! আত্মা লাঞ্ছিত হয় না! তবু তো এ মোহ থেকে বেরোতে পারছি না। নিউইয়র্কে রয়েছে জনএফ কেনেডি এয়ারপোর্ট। এখন যদি অবদানের তুলনায় প্রেসিডেন্ট জিয়াকে অভিন্ন বা আরেক কাঠি বড় ভেবে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামকরণ করি, তো করতেই পারি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নামিয়ে ফেলেছিল জিয়াউর রহমান নামের সাইনবোর্ড। ধর্মীয়বোধ ছড়িয়ে যে কোনো কিছু জায়েজ করা এদেশে খুব সহজ। তাই সিলেটের সুফি হজরত শাহজালালের নাম দিয়ে ঢাকার বিমানবন্দরের নামকরণ করা হলো। বড় কথা, জিয়ার নাম নামাতে হবে। আবার বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৪ সালে যমুনা সেতুর নির্মাণ শুরু হয়। বিএনপিরই শাসনামলে সেতু হস্তান্তরিত হয়েছিল। নামছিল যমুনা বহুমুখী সেতু। এ নামটিই থাকতে পারত। ২০০৮-এর নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এ সেতু নির্মাণে আওয়ামী লীগের ভূমিকা নেই। তারপরও নামপাগলা শেখ হাসিনা সরকার সেতুর নামকরণ করলেন বঙ্গবন্ধু সেতু। এখন বলতে পারব না, এ নামের আয়ুষ্কাল কতটা।
মৃত্যুর পরও দীর্ঘদিন বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদায়িনী স্ত্রী ও শেখ হাসিনাদের স্নেহময়ী মাতা হিসাবে ভালোই ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ষোল বছর আগে নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর হঠাৎ উপলব্ধি করলেন, তার মায়েরও অমরত্ব দরকার। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী হিসাবে তার নাম তো ইতিহাসে থাকবেই। কিন্তু অতটুকুতে পোষাচ্ছিল না যেন। বঙ্গবন্ধুর সমপর্যায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি তো জনগণের অনুমোদিত উপাধি। সুতরাং, তার স্ত্রী হওয়ায় বেগম ফজিলাতুননেসার ‘বঙ্গমাতা’ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ক্ষমতার শক্তিতে তার মাথায় ‘বঙ্গমাতা’র মুকুট বসল। শেখ হাসিনাসহ তোষামোদকারীরা বই লিখতে থাকলেন। একপর্যায়ে তাকে বাংলার রাজনৈতিক ভুবনে বঙ্গবন্ধুর প্রায় সমকক্ষ করে ফেলা হলো। এরপর শুরু হলো নামকরণের পাগলামো। এটিও এখন গবেষণার বিষয় বাংলাদেশে কত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হলসহ নানা স্থাপনায় ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেসা’ নাম ব্যবহার করা হয়েছে; কিন্তু আফসোস, বেগম ফজিলাতুননেসা বেঁচে থাকতে এ দেশে তার যে এত কৃতিত্ব, তা জেনে যেতে পারলেন না। একই রকম দুর্ভাগ্য বিএনপি নেতা জিয়াউর রহমানের। এ মুক্তিযোদ্ধা নিজেও বেঁচে থাকতে জেনে যেতে পারেননি, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক!
আমার মনে হয়, আমরা অধৈর্য জাতি। যার যার মূল্যায়নের দায়িত্ব আমরা ইতিহাসের কাছে ছেড়ে দিতে পারি না। আত্মবিশ্বাসের চরম অভাব থাকায় ক্ষমতার জোরে কাউকে মুকুট পরাই। কারও মাথা থেকে মুকুট কেড়ে নেই। ইতিহাসের সেই অমোঘ নিয়মটি আমাদের স্মরণে থাকা উচিত। যথার্থ ইতিহাস লেখা হবে ঘটনা সংঘটনের দুই প্রজন্ম পরে। অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে। সার কথা, কোনো পক্ষের প্ররোচনায় নয়-তথ্যসূত্র বিশ্লেষণ করে ইতিহাসবিদ মূল্য নির্ধারণ করবেন। পাথরে লিখলেও সে নাম ক্ষয়ে যাবে না। আর অমন মানুষের নাম হৃদয়ে তো লেখা থাকবেই। এখন যতই বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শহিদ জিয়ার স্তুতি করে বই লেখা হোক না কেন, যখন প্রকৃত ইতিহাসবিদ ইতিহাস লিখন পদ্ধতি ব্যবহার করে তথ্য অনুসন্ধান করবেন, তখন বস্তাপচা অনেক কিছুই টিকবে না। সদ্য প্রয়াত আমার খ্যাতিমান প্রকাশক অনেকদিন বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই লিখতে। আমি সময় নিয়েছি। খুব ভালো গবেষণাধর্মী বই লিখতে পারিনি। এর জন্য আরও সময় লাগবে। তবুও যতটা পেরেছি, বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক দুটো বই ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুটো বই লিখেছি। তথ্যটি যুক্ত করলাম অন্য কারণে। বইগুলো পাঠক মহলে আদৃত হলেও সরকারি বড় বড় ক্রয় কমিটি গ্রহণ করেনি। তথ্যমতে, শুধু আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্টতা নেই বলে। আমার প্রকাশক কিছুটা আশাহত হলেও আমার কোনো দুঃখ নেই। এ দেশের বাস্তবতাই এমন।
মানুষ ক্ষমতার জোরে তখনই আত্মপ্রচারে নামে, যখন বুঝতে পারে অন্তরে সে দরিদ্র। সর্বকালে মানুষের অন্তরে অব্যয় অক্ষয় থাকার মতো কৃতিত্ব তিনি অর্জন করতে পারেননি। তখনই জোর করে নিজেকে, নিজের বংশধরদের অমর করার জন্য সাইনবোর্ডে নাম লেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যখন নানা শূন্যতা তাকে মানসিকভাবে হতাশ করে। নিজের টাকায় জনকল্যাণমূলক কাজ করে সেই স্থাপনায় নিজের বা পরিজনদের নাম যত খুশি ব্যবহার করুন, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সরকারি টাকায় গড়া স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানে নিজ বা পরিবারের সদস্যদের নামে নামকরণ করা অভব্য বা অসংস্কৃত আচরণ হিসাবেই বিবেচিত হবে। তবুও মোহটা এমন, জানেন যে, ক্ষমতার পালাবদল হলে এসব নামকরণের সাইনবোর্ড ছুড়ে ফেলা হবে, তবুও যখন যে ক্ষমতায় থাকেন, মনে করেন, তার ক্ষমতা অবিনশ্বর। তাই নামকরণের মচ্ছবে নেমে পড়েন।
আমরা প্রত্যাশা করতে চাই, গণঅভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে ক্ষমতাধর রাজনীতিকরা আত্মচৈতন্যে ফিরে আসবেন। আপনারা ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তুলুন। বেঁচে থাকার জন্য নিষ্কলুষ থেকে দেশবাসীর কল্যাণে আত্মনিয়োগ করুন। মানুষই তাদের হৃদয়ে আপনার বা আপনাদের নাম স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করবে। গিলগামেশের মতো আত্মবিশ্বাস জাগান অন্তরে। নিশ্চয়ই ইতিহাসে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে বেঁচে থাকবেন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com