রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে সরকারের সংলাপ জরুরি
জুলাই-আগস্টে যে ছাত্র অভ্যুত্থান হয়েছে, তা সত্যি অসাধারণ। প্রায় ১৫ বছর ধরে চলছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন। বিশাল বিশাল সভা, সমাবেশ, মিছিল হয়েছিল। বিভাগীয় সমাবেশ যেগুলো হয়েছিল, তার প্রতিটি ছিল একেকটি অভ্যুত্থানের সমান। মানুষ মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, নদী সাঁতরে সমাবেশে এসে যোগ দিয়েছিল। শীতের রাতে উন্মুক্ত আকাশের নিচে ঘাসের ওপর শুয়ে কাটিয়েছিল। সরকার সে আন্দোলন দমন করার জন্য যে কী বীভৎস অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছিল, তা আমরা জানি। আমরা আয়নাঘরের কথাও জানি। তাতে আন্দোলন দমিত হয়নি। আবার এ কথাও ঠিক, সে আন্দোলন বারবার বিজয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসছিল। কারণ ওটা ছিল ফ্যাসিবাদী শাসন। গুলি করে সরাসরি মানুষ হত্যাসহ সব ধরনের বীভৎস অত্যাচার তারা চালাচ্ছিল। তাদের কথা খুব পরিষ্কার ছিল। তারা জানত, জনগণের সমর্থন নিয়ে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। তাদের গায়ের জোরে থাকতে হবে এবং সেজন্যই ক্রসফায়ার, আয়নাঘরসহ সব ধরনের নির্যাতনমূলক পদ্ধতি অবলম্বন করছিল তারা।
পরিস্থিতি খুবই নির্দয় ছিল। প্রয়োজন ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর। ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে হলে এ চ্যালেঞ্জ নিতেই হতো। রাজনৈতিক দলগুলো এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারেনি। তাদের মধ্যে হয়তো দ্বিধা ছিল। হয়তো ভাবছিলেন, এর ফলে যে হাজার হাজার লোক মারা যেতে পারে, এর দায়িত্ব তারা নিতে পারবেন না। শিক্ষার্থীরা এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল। আফ্রিকার তরুণ শিক্ষার্থীরা একসময় সেখানকার দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিল, আপসের এই জীবনযাপন করতে করতে আমরা ক্লান্ত। এবার কিছু সাহস দেখাতে চাই। বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা সেই সাহস দেখালো রাজপথে; যে সাহসের সামনে শেষ পর্যন্ত মাথানত করতে বাধ্য হলো ইতিহাসের জঘন্যতম ফ্যাসিবাদ। পুলিশ পাখির মতো গুলি করে হত্যা করল আন্দোলনকারীদের। আকাশ থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে সরাসরি গুলি করা হলো তাদের ওপর। মারা গেল হাজারের ওপর। কিন্তু দমন করা গেল না তাদের। তাদের একজন মারা গেলে আরেকজন দাঁড়িয়ে গেল। বলল, ভয় পেয়ো না বন্ধুগণ; এগিয়ে চলো। সামনে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। শুধু তাই নয়, সবাইকে ফেলে দেশ ছেড়ে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেলেন তিনি।
প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এজন্যই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত যে, তারা শেখ হাসিনার নিকৃষ্ট স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ নিতে পেরেছিল এবং তাতে বিজয় অর্জন করেছিল। ৪ আগস্টেও অনেকেই দ্বিধান্বিত ছিলেন, আন্দোলন কি সত্যি সত্যি জিতবে? শেখ হাসিনাকে এবং তার সরকারকে পরাজিত করা সম্ভব হবে? এই শিক্ষার্থীরা সেটা সম্ভব করে দেখিয়েছিল। এটা তাদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য।
তিন মাসেরও বেশি হয়ে গেছে সরকারের। অনেকদিন নয়, কিন্তু একেবারেই কম দিনও নয়। মানুষ পেছনে ফিরে দেখতে চেষ্টা করছে। এ সরকারের তিন মাস কেমন গেল। নতুন নতুন প্রশ্ন উদিত হচ্ছে মনে। কিছু প্রশ্ন তো তারা নিজেরাই তুলে দিচ্ছেন। একটা প্রশ্ন তো তারা নিজেরাই, মানে যারা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বা যাদেরকে তারা সম্ভবত তাদের আদর্শিক নেতা মনে করেন, তারাই তুলেছেন। তারা মনে করেন, এটা একটা বিপ্লব ছিল এবং শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা উচিত ছিল। কোনোক্রমেই শেখ হাসিনার অনুগত চুপ্পুর কাছে শপথ নেওয়া উচিত হয়নি। বঙ্গভবনে নয়, শপথ নেওয়া উচিত ছিল হয়তোবা শহিদ মিনারে।
বিপ্লব শব্দটি বেশ রোমান্টিক। এটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণকারীর মধ্যে এক ধরনের তরঙ্গ খেলে যায়। সেই যে সুকান্ত লিখেছিলেন, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন; অনেকটা সেই রকম। আমাদের দেশে অবশ্য মুজিববাদী পান্ডারা এটাকে বিকৃত করে আবৃত্তি করত, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমি মুজিব। বুঝে দেখেন বিপ্লব শব্দটির মাহাত্ম্য কেমন!
একশ্রেণির হাত থেকে আরেক শ্রেণির ক্ষমতা গ্রহণের নাম হলো বিপ্লব; মার্কসবাদীরা ধ্রুপদীভাবে এরকম করে বিপ্লবকে ব্যাখ্যা করেন। এখন অবশ্য সেরকম করে আর কেউ ভাবে না। তবে বিপ্লব শব্দটির একটি নান্দনিক দিক আছে, একটি সৌন্দর্যের দিক এবং সবচেয়ে বড় কথা, গুণগত উৎকর্ষের দিক। সাদামাটাভাবে বললে, বিপ্লবের মাধ্যমে যাকে কেন্দ্র করে বিপ্লব তার গুণগত উৎকর্ষ নিশ্চয়ই সাধিত হতে হবে। সেভাবে দেখলে জুলাই-আগস্টের এই আন্দোলনকে আমি এখনো বিপ্লব বলব না। এটি একটি গণঅভ্যুত্থান। চুপ্পু সাহেবের কাছে শপথ না নিয়ে একজন শ্রমজীবী মানুষের কাছে শপথ নিলে কিংবা বঙ্গভবনের বদলে শহিদ মিনারে শপথ নিলেও এটিকে বিপ্লব বলা যেত না। উগ্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং অতঃপর একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন এবং সেই কাউন্সিলের পক্ষ থেকে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করলেই সেটি বিপ্লব নয়। আমি বুঝি বিপ্লব অবশ্যম্ভাবীরূপে বস্তুর বা বিষয়ের গুণগত উন্নতি সাধন করবে।
এ কারণে আমি মনে করি, এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, এখনো যা হচ্ছে, অতঃপর যদি ঠিকমতো চলা যায়, তাহলে দেশের গুণগত রূপান্তর সাধন করা যায়। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, সেক্ষেত্রে কি একে বিপ্লব বলা যাবে? পাঠক খেয়াল করেছেন, কিছুদিন আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছিল। তারা বলেছিল, তারা আরেকটি বিপ্লব করতে চায়। যে বিপ্লবটি হতে গিয়েও হয়নি, এই পাঁচ দফা আদায় করার মাধ্যমে তারা সেই অসমাপ্ত বিপ্লবকে সমাপ্তি দেবে। পাঁচ দফা দাবি আদায় হয়ে গেলেই সেটা বিপ্লব হয়ে যাবে কিনা, তা আলোচনাসাপেক্ষ। কিন্তু বিপ্লব বেপথু হলে তাকে পথে আনা যায়, অসমাপ্ত থাকলে তাকে সমাপ্ত করা যায়। প্যারি কমিউন বা প্যারিসের বিপ্লব পরপর কয়েকটি হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা, এমনকি মার্কসীয় পণ্ডিতরাও এগুলোকে বিপ্লব বলেছেন। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ায় মেনশেভিকদের নেতৃত্বে যে বিপ্লব হয়েছিল, তার এক বছর যেতে না যেতেই আরেকটি বিপ্লব হয়েছিল অক্টোবরে। প্রকৃতপক্ষে অক্টোবর বিপ্লব ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। কিন্তু অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা ভি আই লেনিন ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতা পরিবর্তনের ঘটনাকেও মেনশেভিক বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক কমিটি কি এই পরিবর্তনের একটি বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাতে পারবে? তারা যেভাবে আরেকটি বিপ্লবের কথা বলেছে, সেটা আনতে পারবে? ৫ আগস্ট আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি, তা প্রাথমিকভাবে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়। এখন এই বিজয়কে সংহত করা দরকার। কারণ এখনো পালটা অভ্যুত্থানের বা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চলছে। সরকারের তিন মাস পার হয়েছে। কিন্তু একথা আমরা বলতে পারছি না যে বিজয় সংহত হয়েছে। বরং এ কথা শোনা যাচ্ছে, কেমন যেন সব এলোমেলো মনে হচ্ছে। পুলিশসহ জনপ্রশাসন সংহত হওয়া পরের কথা, ঠিকমতো কাজেই লাগেনি। অথবা বলা যেতে পারে, প্রশাসনের অভ্যন্তরে পতিত স্বৈরাচারের ছায়া পরিদৃষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারে স্পর্শকাতর, যে ব্যাপারে বেশি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, সেই দ্রব্যমূল্য এখনো মানুষের নাগালের বাইরে।
আন্দোলনে বিজয় অর্জনকারী যে শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ওরাই আমার প্রাথমিক নিয়োগকর্তা, সেই শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তী সরকারের বেশকিছু সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধিতা করেছে। প্রথমটি ঘটেছিল রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অবস্থান নিয়ে। শিক্ষার্থীরা তার অপসারণ চাইছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি অপসারিত হননি। বহাল তবিয়তে আছেন এবং শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থানের পরিবর্তন করেনি। দ্বিতীয় বিষয়টি ঘটেছে অতিসম্প্রতি তিনজন, বিশেষ করে নতুন দুজন উপদেষ্টার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে, যার সরাসরি বিরোধিতা করেছে ছাত্রসমাজ। তাদের অভিযোগও গুরুতর এবং রীতিমতো প্রণিধানযোগ্য। বলেছে, এই দুজনেই বিগত স্বৈরাচারের আশীর্বাদপুষ্ট। এদের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা আছে। এই দুজন উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে। সরকার এই দুজনকে সরায়নি এবং কেন তাদের নেওয়া হলো, এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি।
সব মিলে এরকম করে বলা যায়, পরিস্থিতিটা বেশ এলোমেলো। আমি যেদিন এ লেখা লিখছি, সেদিন গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সামনে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। আহত ব্যক্তিদের দাবি : বিদেশে উন্নত চিকিৎসা, আর্থিক সহায়তা এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সাক্ষাৎ। এ কথা আমরা সবাই জানি, যারা এই দাবি তুলছেন, তাদেরই অসাধারণ ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারের বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। আন্দোলনের বিজয়ের পর থেকেই সবাই এই আহতদের সুচিকিৎসার দাবির কথা বলে আসছেন। এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা জনগণের কাছেও এ ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা চেয়েছিলেন এবং আমরা দেখেছি জনগণ ব্যাপকভাবে তাতে সাড়া দিয়েছে। এখনো তারা সে সাহায্য পাননি কি? পত্রিকার খবর অনুযায়ী, গতকাল সারারাত এই আহতদের অনেকে এবং তাদের বন্ধু-বান্ধব স্বজনরা শাহবাগ চত্বরে একই দাবিতে অবস্থান করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন মাসেরও বেশি হয়ে গেছে। সমস্যাগুলো সমাধানের চেয়ে আরও মুখ ব্যাদান করে প্রকাশিত হচ্ছে। এরপর আছে মূল প্রশ্ন; রাজনীতির প্রশ্ন, নির্বাচনের প্রশ্ন, সংস্কারের প্রশ্ন। ডক্টর ইউনূস যদিও বলেছেন, সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে সংস্কার করা হবে, কিন্তু সেদিকে কতটা এগিয়েছে এ সরকার, তা পরিষ্কার নয়। সরকার কোনো ব্যাপারেই কথা বলছে না। এটা একটা সমস্যা। তারা যদি মনে করে থাকেন, পরে কথা বলে নেবেন, তাহলে তারা ভুল করছেন। সংলাপ প্রথম থেকেই করা দরকার ছিল। এখনো সময় আছে, এখনই শুরু করা যেতে পারে। দেরি করলে সমস্যা বেশি ও জটিল হতে পারে।
মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য