শতফুল ফুটতে দাও
বাংলাদেশে বেকারত্বের অভিশাপ কাটবে কি?
বেকারত্ব একটি অভিশাপ। এ অভিশাপে বাংলাদেশ জর্জরিত হয়ে আছে। ১৯৭২ সালে রেনে দুমো নামে একজন ফরাসি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশে তার কাজ ছিল সোনার বাংলা কীভাবে গড়ে তোলা যায়, সেজন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তিনি আলাপ করেছিলেন। এ আলাপের উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির খোঁজখবর নেওয়া। একটি দেশের মানুষ কী অবস্থায় আছে, তা জানতে হলে জানতে হবে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কেমন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, দুমো এ দেশে বিপুল পরিমাণ বেকারত্ব দেখতে পেয়েছিলেন। সোনার বাংলা গড়ে তোলা সংক্রান্ত তার প্রতিবেদনে তিনি একটি চমৎকার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কত কাজ পড়ে আছে আর কত লোক বেকার আছে! কাজ করার ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে বেকার লোকগুলোকে যুক্ত করতে পারলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। অথচ গত ৫৩ বছরেরও অধিক সময়ে যুক্ততার এ কাজটি করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে দেশে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বেকারত্বের ফলে আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধ হারিয়ে ফেলছে। বেকার জীবনের গ্লানি অনেকের মধ্যে এমন হতাশার জন্ম দিয়েছে যে, কখনই সুদিন আসবে না। এক কথায় বলা যায়, বেকার জনগোষ্ঠী দেশ সম্পর্কে ভীষণ হতাশ! এ দেশে জন্মে তারা মনে করেন এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। অনেকে চেষ্টা করেন বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশে কাজ পাওয়ার জন্য। অনেক সময় তারা হিসাব মেলাতে পারেন না, বিদেশ গমনের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা বিদেশে কাজ করে তুলে আনা সম্ভব কিনা। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই মানুষগুলো খুবই অসহায় জীবনযাপন করেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারী শ্রমিক। নারী শ্রমিকদের অসহায়ত্ব পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
এক সময় অর্থনীতিবিদরা মনে করতেন, প্রবৃদ্ধির হার যদি বেশি হয়, তাহলেই একটি দেশ উন্নতি করছে বলে ধরে নেওয়া যায়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো বড়ই নড়বড়ে থেকে গেছে। এ কারণে ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ডাডলি সিয়ার্স বললেন, কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন নয়। একটি দেশ সঠিকভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে গিয়েছে কিনা, তা জানতে হলে জানা দরকার, What happened to growth? What happened to income distribution? What happened to employment? What happened to literacy? What happened to life expectancy? দেখা যাচ্ছে উন্নয়নের সূচক হিসাবে কর্মসংস্থানের অবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষ যদি কাজ পায়, তাহলে তাদের সন্তানরা লেখাপড়া করতে পারে, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে স্বাস্থ্যবান হতে পারে, স্বাস্থ্যবান হলে আয়ু বৃদ্ধি পায়। কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে মানুষ ক্ষমতায়িত হয়। মানুষ ক্ষমতায়িত হলে একটি দেশের গণতন্ত্রের ভিতও মজবুত হয়। তারা কিসে দেশ ও দশের মঙ্গল হবে সে ব্যাপারে মতপ্রকাশ করতে পারে। দেখা যাচ্ছে, কর্মসংস্থান একটি সবল সুধাম জাতি গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে।
২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, তখন বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এ বেকারদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ৭ লাখ ৯৯ হাজার। এর মানে হলো মোট বেকারের প্রায় ৩১ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। দেশের মোট বেকারের প্রতি ৩ জনের ১ জন বিএ-এমএ পাশ করেও চাকরি পাচ্ছেন না।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বেকার তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা যোগ করলে চিত্রটি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। দেশের মোট বেকারের ৫১ শতাংশই কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। আরও পেছনের দিকে কোভিডের আগে ২০১৬-১৭ সালের দিকে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকার পরিস্থিতি কেমন ছিল তা দেখা যেতে পারে। ২০১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, তখন দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এ বেকার তরুণ গোষ্ঠীর মধ্যে ৪ লাখ ৫ হাজারের চাকরি প্রত্যাশীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল কমপক্ষে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ লাখ। তবে শিক্ষার সুযোগ পাননি কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছেন, এমন তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারের হার কম। কারণ তারা যে কোনো ধরনের কাজ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। দেখা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষা লাভ করে একজন তরুণ কিংবা তরুণী এমন ধরনের মানসিকতায় আচ্ছন্ন হন, যার ফলে তারা যে কোনো কাজ করতে চান না। তারা মনে করেন কাজ করতে গিয়ে তাদের হাত-পা ময়লা হবে, যা তাদের অর্জিত ডিগ্রির সঙ্গে যায় না। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা নিয়ে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একজন অধ্যাপক একটি চমৎকার শব্দবন্ধ রচনা করেছেন। শব্দবন্ধটি হলো Diploma disease. তার মানে অনুন্নত দেশে শুধু সামাজিক মর্যাদা অর্জন করার জন্য অনেকে ডিগ্রি পাশ করা অত্যন্ত জরুরি মনে করেন। কিন্তু ডিগ্রি পেয়ে এরা ডিগ্রির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো কাজ পায় না। তাদের বেকার জীবনযাপন করতে হয়। অথচ যে ডিপ্লোমা তারা অর্জন করেছে, তার জন্য বেশ ক’বছর অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। সামাজিক মর্যাদা অর্জন করতে গিয়ে এসব ডিপ্লোমাধারীর পরিবার দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। নিছক ডিগ্রি অর্জনের মধ্য দিয়ে তেমন কোনো সুবিধা অর্জিত হয় না। হ্যাঁ, বলা যেতে পারে সমাজে একজন ডিপ্লোমাধারী তৈরি হলে সমাজ সুস্থতার পথে অগ্রসর হতে সহায়তা পায়। এটুকুই একজন উচ্চশিক্ষিত বেকারের কাজ থেকে সমাজের পাওয়া বেনিফিট।
কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্লথগতি হয়ে যায়। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, অথবা মালিকরা বেশকিছু লোককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে। কোভিডের সময় বিপুলসংখ্যক কর্মজীবী বেকার হয়ে পড়েছিলেন। পরে অবশ্য তাদের বড় অংশ আবার কাজে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু অর্থনীতি নতুন করে সংকটে পড়লে নতুন চাকরিপ্রার্থীরা বিপাকে পড়ে যান। কারণ চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। আমাদের দেশে অনেকে মনে করেন, শিক্ষার নামে দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা আছে, তাতে করে কর্মসংস্থানের উপযোগী শিক্ষা লাভ হয় না। আরও মনে করা হয়, বৃত্তিমূলক অথবা প্রকৌশলধর্মী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে শিক্ষিত বেকারের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি এ রকম নয়। বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ সন্তোষজনক মাত্রায় হচ্ছে না। বেসরকারি বিনিয়োগ গত ১ দশক ধরে জিডিপির ২২-২৩ শতাংশে আটকে আছে। বেসরকারি বিনিয়োগের এই দুর্ভাগ্যজনিত অবস্থার মধ্যে কী করে বেকারদের কর্মসংস্থান হবে! দেশে যদি জিডিপির ৩৫ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ হতো, তাহলে চাকরির বাজারে রমরমা অবস্থার সৃষ্টি হতো। এর পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়ার একটি বড় কারণ হলো, বিনিয়োগকারীদের ছাড়পত্র পেতে ডজন ডজন সরকারি অফিসে ঘোরাফেরা করতে হয়। এছাড়া বাংলাদেশে ব্যবসায়ের খরচ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। দেশের বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ সন্তোষজনক না হওয়ার পেছনে একটি প্রধান অন্তরায় হলো, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নড়বড়ে অবস্থা এবং Property rights সুনির্দিষ্টভাবে বহাল করতে না পারা। সামাজিকভাবে বিনিয়োগকারীরা বহু রকম সমস্যার সম্মুখীন হন। এসবের মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি ও এনবিআরের ব্যবসাবিরোধী হস্তক্ষেপ। দুর্নীতি তো রয়েছেই।
দেখা গেছে, দেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সুষ্ঠুভাবে চলছে না। অনেক সময় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত আসনগুলো অনেকটাই শূন্য থাকে। এ থেকে বুঝতে পারা যায়, শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করলেই বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হবে না। বেকারত্ব সমস্যার সমাধানের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগটাই হচ্ছে না। নতুন নতুন কলকারখানা ও সেবামূলক ব্যবসা ব্যাপকভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা গেলে কাজের বাজারে ভিন্নধর্মী সংকেত যেত। নতুন নতুন কলকারখানা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সেগুলোর চাহিদা অনুযায়ী শ্রমবাজারে সংকেত পাঠাত। আর এ সংকেতের ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন বিনিয়োগের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হতো। এসবের কিছুই হচ্ছে না। তার কারণ বিনিয়োগ দুর্ভিক্ষ। বিনিয়োগের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো সরিয়ে ফেলতে পারলে বিনিয়োগ চাঙা হতো। শেখ হাসিনার শাসনামলে বেশকিছু দৃশ্যমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে বেশ কিছু অসমাপ্ত প্রকল্পও রয়েছে। এসব প্রকল্প মহাদুর্নীতির কবলে পড়ায় এগুলো থেকে সম্ভাব্য বেনিফিট অর্জন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কথা উঠেছে কর্ণফুলী টানেলের মতো অবকাঠামো থেকে দৈনিক যে আয় হয়, তা এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। ফলত এই প্রকল্পটি শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে। রেলেও অনেক দুর্নীতি এবং সামঞ্জস্যহীন কেনাকাটা হয়েছে। একটি সুষ্ঠু রেলব্যবস্থা দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখতে পারত, সেরকমভাবে রেলকে গড়ে তোলা হচ্ছে না এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারও করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশের বর্তমান জনমিতিক গঠন জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের জন্য চমৎকার অবস্থায় আছে। যদি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো, তাহলে বাংলাদেশে Demographic Dividend বা জনমিতিক লভ্যাংশের কারণে তুলনামূলকভাবে অধিকতর প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হতো। কিন্তু মনে হচ্ছে সে আশা দুরাশা মাত্রা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ