Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও জনআকাঙ্ক্ষা

Icon

মোহাম্মদ আবদুল মাননান

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও জনআকাঙ্ক্ষা

একটি ভালো নির্বাচন কি দেশে ভালো গণতন্ত্র দিতে পারে, নাকি ভালো গণতন্ত্র একটি ভালো নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে, এ বিতর্ক আছেই। তবে এ কথা বিতর্কের ঊর্ধ্বে যে, এ প্রজাতন্ত্রের কোনো সরকারই ভালো নির্বাচনের জন্য ভূমিকা রাখেনি। সবকটি রাজনৈতিক সরকারের লক্ষ্য ছিল নিজেদের ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করা। ফলে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সেভাবেই রাখতে সচেষ্ট ছিলেন তারা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে হাজার মাইল বেগের ঝড়ও আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করতে পারত না। তারপরও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কী হয়েছে, সবারই জানা। এরপর ১৯৭৯ সালের নির্বাচনও বিতর্কহীন নয়। আসুন ১৯৮৬-তে, বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। ১৯৮৮ সালেরটি আরও গোলমেলে। ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি নিয়ে আজও আলোচনা চলে; তবে ওটি ছিল নিয়মরক্ষার নির্বাচন এবং এ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলা খামোখাই। মোটা দাগে ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন), ২০০১-এর নির্বাচন জনমান্যতা পেয়েছে। হেরে যাওয়া বড় দলের কিছু ওজর-আপত্তি থাকলেও সে আপত্তির জনভিত্তি ছিল না। ২০০৮ সালের নির্বাচন জরুরি শাসনান্তে উত্তরণের নির্বাচন ছিল। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ কম ভোট পেলেও বিএনপি তা নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি। অতীতের তিনটি (’৯১, ’৯৬, ২০০১) নির্বাচনের তুলনায় বিএনপির ভোটপ্রাপ্তির হারের পার্থক্য ছিল রেকর্ড পরিমাণ (আওয়ামী লীগ ৪৮.০৪ এবং বিএনপি ৩২.৫০)।

তাকিয়ে দেখি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন। ২০১৪-তে বড় দল বিএনপি নির্বাচনে যায়নি বলে একতরফা নির্বাচন হয়েছে; বহু আসনে বাক্সই পাততে হয়নি। বিএনপির পরিকল্পনা ছিল নির্বাচন ঠেকিয়ে দেওয়ার আন্দোলন করবে। কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় ভোটের বাজারে যেতে হয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। ফলে মার খেয়েছে বিএনপির কৌশল (একই মার ২০১৮ সালেও বিএনপির পিঠে পড়েছে, জানতেই পারেনি, কর্ম আগের রাতেই শেষ হয়ে গেছে)। তখন আন্দোলন বেগবান করা সম্ভব হলেও ক্ষমতাসীনদের সরকার গঠনে কোনো সমস্যা হতো না এবং এ অবস্থায় আন্দোলন হিমঘরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ২০২৪ তো একদমই চোখের সামনে; আলোচনার দরকারই হয় না। দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী, ডামি আর মুরগিধরা প্রার্থীর নির্বাচন হিসাবে দেওয়ালে লেখা হয়ে আছে।

এতসব কথা বলার অর্থ এই যে, নির্বাচনবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে নির্বাচন সংস্কার করতে হলে এ নির্বাচনগুলোর চরিত্র অধ্যয়ন করতেই হবে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কেবল জাতীয় নির্বাচনই নয়, স্থানীয় নির্বাচনেও মানুষ কেন কেন্দ্রমুখী হয়নি; সংস্কারের জন্য সেই পাঠ নিতে হবে। কোটি কোটি টাকার আয়োজনে যদি মানুষই না আসে, তাহলে আয়োজন কার জন্য আর মানুষ কেন আসেনি-সংস্কার কমিশনকে সে কারণ খুঁজতেই হবে। পোস্টমর্টেমের দরকার হবে, কেন শপথ নিয়েও শেষ বয়সে নির্বাচন কমিশনের প্রধান-অপ্রধানদের ২০১৮-কে মান্যতা দিতে হয়? আসুন ২০১৮-তে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই একটিই কলঙ্কজনক নজির; আগের রাতে ভোট হয়ে গেছে। প্রশ্ন, আদতে কী ঘটেছিল এবং কারা ঘটিয়েছে, সেজন্য আলাদা কমিশন নয় কেন? কেনইবা একজন সরকারি কর্মচারীও এর প্রতিবাদ করেনি, কেনইবা তাদের সেই নির্বাচনকে দ্বিধাহীনভাবে মেনে নিতে হয়েছিল? এসব প্রশ্নের সুরাহা ব্যতিরেকে নির্বাচন সংস্কারবিষয়ক কমিশন কী প্রতিবেদন দেবে!

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে একটি আইন হয়েছে আর সেটা অনেকটা তড়িঘড়ি করেই নয়, হয়েছে আওয়ামী বুদ্ধিতে। ফলে এ আইন নিয়েও এখন পর্যালোচনা দরকার। যদিও আগামী কমিশন এ আইন বলে গঠিত সার্চ কমিটিই করবে। এখানে বোঝার কথা, রাজনৈতিক সরকারের সময়ে এ সার্চ কমিটি কি ঠিক ঠিক সার্চ করতে পারে, না সরকারের ইচ্ছাকেই সিলমোহর দিয়ে দেয়? ঠিক ঠিক বাছাই হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনারদের মেরুদণ্ড বেঁকে যায় কেন? নাকি কমিশনের পর্যাপ্ত ক্ষমতার সংকট আছে! এখানেই আসবে নির্বাচনে গোলযোগ হলে একটি মাত্র কেন্দ্র নয়, পুরো নির্বাচনই বাতিলের ক্ষমতা কমিশনকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। লক্ষণীয়, রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রেশন প্রদানে আউয়াল কমিশন বিচারিক বুদ্ধি-বিবেচনার চেয়ে সরকারের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল-এখানেও সংস্কার কমিশনকে হাত দিতে হবে।

নিরেট বদ মতলবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিদায়ি-পলাতক সরকার; ভাবটা ছিল, সবাই সরকারি দলে চলে আসবে, শূন্য হবে বিরোধী দল। এতে ভেঙে পড়েছে গ্রামবাংলার আবহমান সংস্কৃতি। মুখ দেখাদেখি বন্ধ থেকে মারামারি-হানাহানি গ্রামের নিত্য দৃশ্য হয়ে উঠেছিল। এ বাজে কালচার থেকে গ্রামবাংলাকে মুক্ত করতে হবে। সিটি করপোরেশন থেকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হবে সম্পূর্ণ নির্দলীয়।

ভালো নির্বাচনের জন্য একটি নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকার বিকল্প নেই। অতীতের নির্বাচনে ভোটার তালিকা নিয়ে বিতর্ক ছিলই। এবার একটি বিশুদ্ধ ভোটার তালিকা করার সময় এসেছে। সুযোগ এসেছে প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে বিদেশ থেকেই ভোট প্রদানের ব্যবস্থা করার। যারা নিয়মিত ডলার পাঠাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে দিনে দিনে অনেক খারাপ আচরণ জমা হয়ে গেছে; একটু শোধ দেওয়ার সময় কি এখনো হয়নি? ভোটার তালিকা এমনভাবে চাই, যাতে আমার ভোট আমিই দিতে পারি, যাকে খুশি তাকেই দিতে পারি। দিতে পারি ভয়-ভীতিহীনভাবে। ভোটের প্রয়োগ করতে চাই মোবাইল ফোনে। চাই কেন্দ্র কিংবা অনলাইন যেখান থেকেই হোক, আমার আঙুলের ছাপ ছাড়া আমার ভোট কাস্ট হবে না। এর ফলে জাল ভোট উঠে যাবে। বুথে বুথে প্রার্থীর নির্বাচনি এজেন্টের দরকার হবে না। কেননা, যার ভোট তার আঙুলের ছাপ ছাড়া দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। এ পদ্ধতির ব্যবস্থা তেমন কঠিন নয়। প্রতিটি নির্বাচনেই প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট হটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ থাকে। কেন্দ্রের মুখেই শুনতে হয়, তোমার ভোট হয়ে গেছে অথবা পূর্বরাতে ভয় দেখানো হয় কেন্দ্রে না যেতে। মোবাইলে ভোট দেওয়া গেলে এ ভয়ভীতির অবসান ঘটবে। ভোট প্রদানের হারও বৃদ্ধি পাবে। প্রশ্ন উঠবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে জোর করে বা ভয় দেখিয়ে মোবাইলে ভোট দিতে বাধ্য করা হবে। অন্তত একবার নিজের ভোট বদল করা যাবে, থাকবে এ অপশনও। আর এ রকম ভয় থাকলে কেউ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়েও ভোট দিতে পারবে। ভোটারের আঙুলের ছাপ থাকলেই ভোট নিশ্চিত হবে, কেন্দ্র দখল কিংবা ব্যালট ছিনতাই করেও কোনো লাভ হবে না।

২০১৮ কেন হলো? এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ পাঠ ছাড়া নির্বাচনবিষয়ক সংস্কার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এখানেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের দরকার হবে-নির্বাচনি কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে কী কী প্রতিবন্ধকতার শিকার হন। নাকি নিজেরাই স্বেচ্ছায় অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ সালে কিন্তু ভোটে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি আধিকারিকদের বিরুদ্ধে তেমন কথা ওঠেনি। তাহলে কি নির্বাচনকালীন সরকারই সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় নিয়ামক? এ প্রশ্নের জবাব তো ২০০৬ সালের নির্ধারিত নির্বাচন (যা হয়নি) এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনই বলেই দিচ্ছে। বহুল উচ্চারিত একটি কথা হলো, ক্ষমতায় আসীন থেকে এদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই হারতে চায় না। যেহেতু হারতে চায় না, তাই এ কাজে সরকারের সমুদয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে হলেও নির্বাচনি বৈতরণী পেরোয়; জনগণ জানে, ভোট দেওয়া আর না-দেওয়ার বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই-ফলাফল হয়েই আছে, তাই মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা। এ মুখগুলোকে ভোটকেন্দ্রে নিতে হবে-ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করাই হবে সংস্কার কমিশনের বড় কাজ। ভোটাররা বাধা-বিপত্তিহীন, ভয়-ডরহীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে মুখিয়ে আছে; চাইছে পছন্দের প্রার্থী বা মার্কাকে ভোট দিতে। তাদের প্রত্যাশা, প্রদত্ত ভোটের প্রতিফলন ঘটুক ভোট গণনায়; আর সেটা কেবল আগামী তথা একটি মাত্র জাতীয় বা স্থানীয় ভোটে নয়, আগামী সব ভোটেই এমন হোক। কমিশনকে মাথায় রাখতে হবে, ২০০৯ সালের পর যারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তারা একটি নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেনি; তাদের অনেকের বয়স ৩৫ পেরিয়েছে। তাদের ভোটের জমিতে ফিরিয়ে আনতে সংস্কার কমিশনের দায় আছে। কমিশনকে সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতে নিরঙ্কুশ এখতিয়ার দিতে হবে। কেবল কাগজে-কলমেই নয়, নির্বাচনকালে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের চাকরি কমিশনে ন্যস্ত করতে হবে। সুনির্দিষ্ট করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই সময়ের দায়িত্ব।

এরপর জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, সম্পদ বিবরণী দাখিল ও পরীক্ষা এবং প্রচারে প্রার্থীদের অর্থ ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা কমিশনের সুপারিশে থাকতে হবে। হতে পারে, প্রচার কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের কৌশল নির্ধারণ। প্রশ্ন উঠেছে, আনুপাতিক প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন দফারফা। এ নিয়ে সুধীজনদের নানা মত আছে। অতি সংক্ষেপে, এ পদ্ধতি নানা জটিলতা ডেকে আনতে পারে। ফলে এসব সম্পূর্ণ নতুন বিষয়ে সংস্কার কমিশনের মাথা ঘামানো ঠিক হবে না। একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গঠিত নির্বাচনবিষয়ক সংস্কার কমিশনই পারবে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকে আধুনিক, গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু ভোটের জন্য উপযোগী সুপারিশ দিতে। জুতসই সুপারিশ জনমান্যতা পাবেই এবং মান্যতা পেলে রাজনৈতিক সরকার এসেও পরিবর্তনের কথা ভাববে না-এমনই আমাদের আশা।

ইভিএম প্রশ্নেরও সুরাহা করতে হবে এ সংস্কার কমিশনকে। দাবি কিংবা আবেগ নয়, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েই ইভিএমের দোষ-গুণ বের করা চাই আর সেমতেই হোক সুপারিশ। প্রশ্ন এসেছে, গোটা দেশে একদিনে ভোটের আয়োজন না করে একাধিক দিনে আয়োজনের ব্যবস্থাকরণ। পাশের দেশে ভোট সম্পন্ন হওয়ার কদিন পর ভোট গণনা হয়। এ কদিনে ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা নিয়ে আজও প্রশ্ন ওঠেনি; এখানে সেই আস্থা তৈরি হবে কি? তবে একাধিক দিনে ভোট হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রিটার্নিং অফিসার এবং কমিশনের জন্য ভালো হতে পারে। এক-বুক প্রত্যাশা নিয়ে আমরা সংস্কারের দিকে তাকিয়ে আছি। দেখা যাক।

মোহাম্মদ আবদুল মাননান : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম