গুম কমিশনের দায়িত্বের ক্যানভাসটা অনেক বড়
এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
৬ নভেম্বর গুম কমিশন এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। কমিশনের ভাষ্যমতে, ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত কমিশনের কাছে ১৬০০ গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে। সংখ্যাটি ভয়াবহ। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কমিশন এরই মধ্যে ৪০০’র মতো অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। আরও ১২০০ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে। কমিশনের হিসাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতেই মানুষ সবচেয়ে বেশি গুমের শিকার হয়েছে। কেউ গুম হলে যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের খুঁজে বের করবে, সেখানে সেই রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল গুমের অভিযোগ। ১৬ বছরে গুম যেন এক সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গত ১৬ বছরে কতজনকে শেখ হাসিনা সরকার গুম করেছে, তার পুরো হিসাব এখনো আমাদের জানা নেই। সরকার গুম কমিশন গঠন করে গুমের যাবতীয় ঘটনাবলি তদন্ত ও বিচার করবে, এটাই প্রত্যাশা।
২৭ আগস্ট সরকার গুম কমিশন গঠন করে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে এ কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে গুমের ঘটনার অভিযোগ নিয়ে এ কমিশন কাজ করবে।
গুম কমিশনের হিসাবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর হাতেই মানুষ সবচেয়ে বেশি গুমের শিকার হয়েছে। কমিশনের ভাষ্যমতে, র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা এসব গুমের ঘটনায় জড়িত। ৪০০টি ঘটনার মধ্যে ১৭২টি ঘটনায় র্যাবের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সিটিটিসির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ৩৭টিতে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সম্পৃক্ততা ছিল ৫৫টিতে। ডিজিএফআইয়ের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ২৬টিতে এবং পুলিশের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ২৫টিতে। এছাড়া সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় গুম করা হয়েছে ৬৮ জনকে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার, কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের মানে এই নয়, বাহিনীর সবাই এ অপরাধে অপরাধী বা ওই বাহিনীর কাজের অংশ হিসাবে সবাই এ কাজে যোগ দিয়েছে। সুতরাং, অভিযোগ বাহিনীর বিরুদ্ধে উঠলেও বাহিনীর যে সদস্যরা এসব অভিযোগে অভিযুক্ত, এটি তাদেরই ব্যক্তিগত দায়। কোনো সদস্যের ব্যক্তিগত ফৌজদারি অপরাধের দায় সমগ্র বাহিনী নিতে পারে না। যদিও বাহিনী আবার কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেয়, সে দায়ও এড়িয়ে যেতে পারে না। কাজেই, এ গুম তদন্তের ব্যাপারে অভিযুক্ত বাহিনীকেও এগিয়ে আসতে হবে। দায় না এড়িয়ে, অভিযোগের নির্মোহ তদন্তে বাহিনীকেই এগিয়ে আসতে হবে। অভিযোগ থেকে মুক্তির এটিই সর্বোত্তম উপায়। মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন অভিযোগে আমেরিকা ইতোমধ্যে র্যাবের ওপর স্যাংশন দিয়েছে। কাজেই এ জাতীয় অপরাধের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য র্যাব বা অন্যান্য বাহিনীকেই উদ্যোগী হতে হবে। কোনো সদস্য অভিযুক্ত হলে তাকে সে অভিযোগ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা না করে বরং বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থেই তদন্ত ও বিচারে সহায়তা করতে হবে।
কমিশনে যে ১৬০০ অভিযোগ এসেছে, তার প্রতিটি ঘটনাই সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি গুম হওয়া সদস্যই তাদের পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ইলিয়াস আলীর পরিবারের কাছে ইলিয়াস আলী যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি একজন অতি সাধারণ মানুষও যদি গুম হয়ে থাকেন, তিনিও তার পরিবারের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর রাষ্ট্রের কাছে প্রতিটি নাগরিকই গুরুত্বপূর্ণ। আইনের কাছে প্রতিটি নাগরিকেরই সমান আশ্রয় লাভের অধিকার আছে।
গুমের প্রতিটি ঘটনাকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে। এজন্য যদি কমিশনে আরও লোকবল নিয়োগ করতে হয় তা করতে হবে। কে কবে কীভাবে গুম হলো, কে গুম করল, গুমের পর কী হলো, গুম হওয়া ব্যক্তি বেঁচে আছে না মারা গেছে, তা প্রকাশ করতে হবে। এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাও তদন্ত প্রতিবেদনে আসতে হবে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের পর বিচারের প্রশ্ন আসবে। ইতোমধ্যে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে। গুম কমিশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটরের মধ্যে তদন্ত কাজে সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। কমিশন ও আদালতের মাঝে পারস্পরিক সহায়তা ও সমন্বয় জরুরি। এমন যেন না হয়, আদালতের তদন্ত প্রতিবেদন এক রকম আর গুম কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন আরেক রকম। এটি হলে গুমকারী ও তাদের দোসররা পুরো বিষয়টিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইবে। কাজেই, গুম কমিশনের সক্ষমতা ও তাদের লোকবল বাড়ানো জরুরি। সরকার চাইলে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সাহায্যও চাইতে পারে। আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে সে সহায়তা চাইতেও পারে।
বিশ্বব্যাপী গুম প্রতিরোধে ও গুমের বিচারের লক্ষ্যে একটি কনভেনশন আছে, যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসেপিয়ারেন্স’ নামে পরিচিত। জাতিসংঘ ২০১০ সালে এ কনভেনশনটি গ্রহণ করে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার গত ১০ বছরে এ সনদটি অনুমোদন বা এতে স্বাক্ষর করেনি। কেন করেনি এখন তা পরিষ্কার। যে সরকার তার রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করার জন্য গুমের আশ্রয় নেয়, সে সরকার কেন এমন একটি সনদে সই করতে যাবে?
কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর আয়নাঘর আবার সামনে চলে আসে। ১৬ বছরের গুম হওয়া ইতিহাস সবার সামনে চলে আসে। ড. ইউনূস সরকার শপথ নেওয়ার পর থেকেই এ সনদটি স্বাক্ষর করার উদ্যোগ নেয়। ৩০ আগস্ট ছিল বিশ্ব গুম প্রতিরোধ দিবস। তার আগেই (২৯ আগস্ট) সরকার এ আন্তর্জাতিক সনদটিতে স্বাক্ষর করে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যে কোনো সভ্য দেশেরই গুম সনদে সই করার কথা। এটিতে সই না করা মানে সে রাষ্ট্র এখনো গুম সমর্থন করে ও গুমের আশ্রয় নেয়। শেখ হাসিনা সেটিই প্রমাণ করেছেন।
বিশ্বব্যাপী বলপূর্বক গুম প্রতিরোধ ও গুমের বিরুদ্ধে সবরকম আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করতেই এ কনভেনশন। এর লক্ষ্য হলো জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম প্রতিরোধ করা। সনদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র এসব গুম প্রতিরোধে এগিয়ে আসবে। কোনো রাষ্ট্র যাতে এ ধরনের গুমের সঙ্গে কোনোভাবেই না জড়ায়, এটিই এ কনভেনশনের মূল কথা। যদি কেউ গুম হয়েও থাকে, তবে রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়াবে। তাকে আইনগত সহায়তা দেবে ও তার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। অথচ শেখ হাসিনা সরকার নিজেই ছিল গুমের কারিগর। তাই এ কমিশন তথা সরকারের কাছে দাবি, গুমের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় বা আইনগত দায়মুক্তি যেন দেওয়া না হয়।
সরকার গুমের বিরুদ্ধে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসাবে আন্তর্জাতিক সনদে সই করেছে। এর সঙ্গে সংগতি রেখে ১৯৫৬ সালের Commission of Inquiry Act-অনুযায়ী গুম কমিশন গঠন করে ১৫ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা এবং অনুরূপ যে কোনো বাহিনী বা সংস্থা কোনো সদস্য বা সরকারের মদদে, সহায়তায় বা সম্মতিতে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সমষ্টি কর্তৃক ‘আয়নাঘর’ বা যে কোনো জ্ঞাত বা অজ্ঞাত স্থানে বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, বলপূর্বক গুমের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণ ও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ প্রদান এবং বলপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারের সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যাদি সম্পাদনের নিমিত্ত এ কমিশন গঠন করা হয়। কাজেই, গুম প্রতিরোধ, তদন্ত, বিচার, সহায়তাসংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করার ক্ষমতাই এ কমিশনের রয়েছে। কিন্তু এত কাজ করার জন্য কমিশনের সক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না। সে লোকবলও নেই।
১৬০০ অভিযোগের তদন্তের পাশাপাশি গুম প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইনের সংস্কারের প্রস্তাবও তাদের করতে হবে। এজন্য অবশ্য দুজন বিচারক এ কমিশনে আছেন। প্রজ্ঞাপনের ২ ধারায় যে ৭টি কাজের কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তিন মাসের ভেতরে (১৫ ডিসেম্বরে মধ্যে) ১৬০০ গুমের তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করা সম্ভব হবে কিনা, সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। শুধু কয়েকটি ঘটনা বা ৪০০ ঘটনার প্রাথমিক কিছু তদন্ত করেই একটি প্রতিবেদন পেশ করা অর্থহীন। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তাবিত আইনের একটি খসড়াও তাদের জমা দিতে হবে। সেটির কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, আমাদের জানা নেই। তবে, খসড়া আইনের অধিকাংশ ধারাই আন্তর্জাতিক সনদ থেকেই নেওয়া সম্ভব। কারণ, এ সনদটি একটি পূর্ণাঙ্গ সনদ। বলা যেতে পেরে এটি গুম প্রতিরোধে একটি পূর্ণাঙ্গ দণ্ডবিধি। এখানে মোট ৪৫টি অনুচ্ছেদ আছে। প্রতিটি অনুচ্ছেদের আবার বিস্তারিত অনুচ্ছেদও আছে।
আমাদের বিদ্যমান দণ্ডবিধি অনুযায়ী, অপহরণের বিচার করা যায়। এ বিধি অনুযায়ী, দুই ধরনের অপহরণের কথা বলা হয়েছে। দেশে ও দেশের ভেতরে। বিগত ১৬ বছরে দেশের ভেতরে তো অপহরণ হয়েছেই, অপহরণ করে দেশের বাইরেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কাউকে কাউকে। বিএনপির সালাহউদ্দিনের কথা তো আমরা জানিই। তবে, দণ্ডবিধিতে শুধু ব্যক্তির অপরাধকেই অপহরণ হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কোনো বাহিনী কর্তৃক অপহরণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ১৮৬০ সালে হয়তো এটি চিন্তাও করা যেত না।
এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও এর শাস্তির কথা বলা আছে। ৭ ধারা অনুযায়ী, এর শাস্তি ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তির কথাও বলা আছে। তবে, দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপরাধটি অপহরণ (Abduction) হিসাবে চিহ্নিত। কোনো আইনেই গুম বা Enforced Disappearance শব্দটি ব্যবহার হয়নি। যদিও অপরাধের ধরন একই, তারপরও গুমবিষয়ক আইনের আলোকে ‘গুম’ শব্দ ও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক গুম আর ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে অপহরণ এক হতে পারে না। ফলে গুমের বিরুদ্ধে পৃথক আইন না হলেও বিদ্যমান আইনেই গুমকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। গুমের গুরুত্বকে তুলে ধরতে হবে।
আমরা স্বাধীন ও মুক্ত একটি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই, যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী হবে নাগরিকদের সেবক ও বন্ধু। এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি হবে। মানুষ ন্যায়বিচার পাবে।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক