অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ
মাহমুদুর রহমান মান্না
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। পতন হয় সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের। সেদিন গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখলে নেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।
পদত্যাগের আগে জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় শিশু-কিশোর-শিক্ষার্থীসহ প্রায় দেড় হাজার মুক্তিকামী মানুষ। চোখ হারায়, পঙ্গুত্ববরণ করে কয়েক হাজার। নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর মানুষ সেসময় নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও দ্বিধা করেনি।
স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের লড়াইয়ের পরিক্রমায় ’২৪-এর সফল গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দল এবং জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের স্বপ্ন এবং জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করে নতুন বাংলাদেশের নতুন সরকার।
এ সরকার এমন একটা সময়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পায়, যখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের সব সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায়, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়েছে। জনগণের ব্যাপক সমর্থন এবং আকাশসম প্রত্যাশা নিয়ে নানা অশ্চিয়তা ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ ৮ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাস পূর্ণ করছে। তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন নিশ্চয়ই এ সরকারের সফলতা এবং ব্যর্থতার একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
এ সময়ের মধ্যে অনেক বিষয়ে সফলতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ক্ষমতা গ্রহণের পর গত দুই মাসে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদল করেছে সরকার। রাষ্ট্রের কাঠামোগত এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। স্বৈরাচার সরকারের আমলে জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা স্থানীয় সরকারের কথিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে সেই জায়গায় অস্থায়ী প্রশাসক বসানো হয়েছে। স্থায়ী প্রশাসক নিয়োগের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে আলাদা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবস্থা করতে সাহায্য করছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, ঋণদাতা সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের প্রতি নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং ইউনূস সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাস পূর্ণ করার পর সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতার দিকগুলো নিয়েও আলোচনা করা যায়। তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রশাসনে গতি ফেরেনি। শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা পদে ব্যাপক রদবদল হলেও একাধিক মন্ত্রণালয়ে সচিব নেই। আড়াই মাস পেরিয়েছে ঢাকা, রংপুর বিভাগে কমিশনার এবং আট জেলা ডিসি ছাড়াই। পুলিশে ব্যাপক রদবদল হলেও কাজে গতি ফেরেনি। বলা যায়, পুলিশ এখনো এক ধরনের নিষ্ক্রিয়। ট্রাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে রাজধানী ঢাকায় অসহনীয় যানজটের ভোগান্তি নিয়ে চলছে মানুষ। সরকার এখন পর্যন্ত বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বলা যেতে পারে, ভাঙার কার্যকর উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। চাঁদাবাজি, দখলদারত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। সরকারের সে ব্যাপারেও কার্যকর ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ চলছে সচিব ছাড়াই। একই অবস্থা মাঠ প্রশাসনেও। জেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।
সরকার প্রথম থেকেই তার আচরণে এবং উচ্চারণে বোধহয় এটাই বোঝাতে চাচ্ছিল, তারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেই। আমার মনে হয়েছিল, তারা রাজনীতি তেমন একটা পছন্দ করে না। ড. ইউনূস যখন প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে চিকিৎসা শেষে বিদেশ থেকে দেশের মাটিতে ফিরে আসেন, এয়ারপোর্টে বলেছিলেন, আমার কথা শুনতে হবে। না হলে আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব। কেউই তখন ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। হয়তো এখন সেটা অনেকে ভুলেই গেছেন। কিন্তু এ হালকা বিষয়টি আমাকে তখন থেকে বিরক্ত করেছে।
সরকারের তিন মাসের পর এখন অনেককে বলতে শুনছি, একেবারেই রাজনীতি বোঝে না এ সরকার। কিন্তু রাজাকে তো রাজনীতি জানতে হয়। রাজনীতিবিদদের একটা নিজস্ব টাইপ থাকে। আসলে প্রত্যেক পেশার মানুষেরই একভাবে নিজস্ব টাইপ গড়ে ওঠে। রাজনীতিবিদরা সাধারণত কথা বলার সময় সতর্ক থাকেন, যেন অসতর্কতাবশত এমন কিছু বলে না ফেলেন, যা তার নিজের বিরুদ্ধে যায়।
ড. ইউনূস অবশ্য এমনিতে বেশি কথা বলেন না। এটি তার স্বভাবজাত; কৌশলগত নয়। কৌশল করে কথা বলার প্রয়োজন তার জীবনে খুব একটা পড়েনি। কিন্তু বিদেশ থেকে ফিরে বিমানবন্দরে তিনি যেভাবে কথা বললেন, তার মধ্যে একটা অভিমানের ভাব দেখা গেল। অভিমানটা সত্যি সত্যি, নাকি কৃত্রিম, তা বুঝতে পারলাম না। সত্যি কি তিনি কখনো রাগ করে জনগণ ও দেশকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন?
একথা মানতে হবে, দেশের অহংকার, দেশের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, প্রবলভাবে আন্তর্জাতিক মহলে জনপ্রিয় ড. ইউনূস দেশে তেমনভাবে জনগণঘনিষ্ঠ নন। এটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আসে, তিন মাস শাসন আমলে তার সাফল্য; বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে।
পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, তিন মাসের শাসনে ড. ইউনূস এবং তার সরকার রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেননি। কেন? এ কথা নিশ্চয়ই এখন আর কেউ অস্বীকার করবেন না, ফ্যাসিবাদবিরোধী সমগ্র লড়াইটাই ছিল রাজনৈতিক। তাদের এ দায়িত্বভার গ্রহণ, যতদিনই লাগুক, ততদিন পর্যন্ত শাসন চালিয়ে যাওয়া, এসব কিছুরই তো আইনি বৈধতা লাগবে এবং সেজন্য পরবর্তীকালে গঠিতব্য সংসদে বৈধতা বিল পাশ করতে হবে। এ পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক। আগেকার সরকারগুলো যা করেছে (জিয়া ও এরশাদের সরকার), সেটা আমরা সবাই দেখেছি। এ সরকার নিশ্চয়ই সেরকম কিছু করবে না। তাহলে কী করবে তারা?
পাঠক নিশ্চয়ই এটিও খেয়াল করেছেন, এখনকার প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সরকারের সব সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ৫ আগস্ট হাসিনা স্বৈরাচারের পতনের অব্যবহিত পর থেকেই বিএনপি সরকারের কাছে নির্বাচন এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করছে। সদ্য বিজয় দেখা (যা প্রায় কল্পনার অতীত ছিল) জনগণ তখন বেশ বিরক্ত হলেও তিন মাসের সরকারের কার্যকলাপে তারা ভ্রু কুঁচকাতে শুরু করেছে। এ সময় ৬ নভেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখলাম বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, আগামী দুই তিন মাসের মধ্যেই তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচনের রোড ম্যাপ চাইবেন, সেটি না হলে মার্চ-এপ্রিলের দিক থেকে নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলন শুরু করবেন।
এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্টত বোঝা যায়, সম্পর্কে পতন শুরু হয়েছে। এর দুদিন আগে এক বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আবারও মাইনাস টু ফর্মুলার চর্চা শুরু হয়েছে। সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে কথা না বললেও তার বক্তব্যে এটি বোঝা গেছে, সরকারকে উদ্দেশ করেই তিনি বলেছেন, এসব খেলা বন্ধ করতে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনের কথা বললেই আপনারা বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে গেছি। আমরাও বলতে পারি, আপনারা ক্ষমতায় থাকার জন্য পাগল হয়ে গেছেন।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ তিন মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়ার জন্য যে গঠনমূলক আলোচনা বা সংলাপের প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। সরকারকেই এ উদ্যোগ নিতে হতো। কিন্তু যে কোনো কারণেই তারা সে পথে হাঁটেনি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে সরকারের।
শুরু থেকেই আমরা একটা কথা বলেছি, এ সরকারের ব্যর্থ হওয়া চলবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসসহ উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মে ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। রাষ্ট্রপরিচালনা এবং বিশেষ করে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার প্রশ্নে তাদের অনভিজ্ঞতার ছাপ গত তিন মাসে প্রতীয়মান হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকারের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে পারে, এমন বিষয়গুলোকে সরিয়ে রেখে, বিতর্কগুলোকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক দল, ছাত্র নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজকে আস্থায় নিয়ে ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত এবং একইসঙ্গে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সর্বোপরি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকার অগ্রসর হবে, এই প্রত্যাশাই এখন জনগণের।
মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য