Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থান এবং একটি বিপ্লব

Icon

একেএম ওয়াহিদুজ্জামান

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থান এবং একটি বিপ্লব

ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু বিগত ১৭ বছরে সেই ইতিহাসকে এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে, সত্যিকার ইতিহাসকেই মানুষ এখন ভুলে যেতে বসেছে। ঐতিহাসিক সত্য হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-পরবর্তীকালে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে যে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছিল, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ফলে সেটি আরও জটিল রূপলাভ করে। ফলে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব একরকম অবধারিত হয়ে ওঠে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান তারই শীর্ষ রাজনৈতিক সহযোগীদের সক্রিয় পরিকল্পনার অংশ হিসাবে সেনাবাহিনীর মধ্যমসারির কতিপয় অফিসার কর্তৃক সংঘটিত এক অভ্যুত্থানে নিহত হন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হন শেখ মুজিবেরই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী, আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ। খন্দকার মোশতাক এবং অভ্যুত্থান সংঘটনকারী সামরিক কর্মকর্তারা বঙ্গভবনে সার্বক্ষণিক অবস্থান করে রাষ্ট্রপরিচালনা করতে থাকেন।

সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড বা নির্দেশ সূত্র ফিরিয়ে আনার কথা বলে ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ পালটা অভ্যুত্থান ঘটান এবং নিজেই আবার চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘন করে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন। সমঝোতার অংশ হিসাবে তিনি ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপদে দেশত্যাগ করার সুযোগও করে দেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে না রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং ৬ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করে নিজে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

মহান স্বাধীনতার ঘোষক, জেড ফোর্সের অধিনায়ক এবং রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ফলে ৩ নভেম্বর তাকে পদচ্যুত করার ঘোষণা দিয়ে গৃহবন্দি করা হলে তার প্রতি বিরাজমান সহানুভূতি তীব্র ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়। এমন মোক্ষম সময়েই জেনারেল জিয়ার প্রতি সেনা সদস্যদের মধ্যে বিরাজমান ভালোবাসা থেকে উদ্ভূত তীব্র ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এবং তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে লে. কর্নেল (অব.) তাহের আরেকটি পালটা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনার অংশ হিসাবে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা সামরিক বাহিনীর মধ্যে লিফলেট ছড়িয়ে সাধারণ সিপাহিদের উত্তেজিত করে তোলে। এ ধরনের প্রচারণার মধ্যে সবচেয়ে অপরিণামদর্শী যে ক্ষতিকর দিকটি ছিল, তা হলো, সামরিক বাহিনীকে কর্মকর্তাশূন্য করার মতো দিকভ্রষ্ট প্রচারণা। সেসময়ে জাসদের চালানো প্রচারণার উল্লেখযোগ্য স্লোগানগুলো ছিল-‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের ওপরে অফিসার নাই’।

জেনারেল জিয়ার প্রতি অনুগত দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানরা লে. কর্নেল (অব.) তাহেরের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আগে থেকে আঁচ করতে পেরে পৃথকভাবে একটি আগাম পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ফেলেন অতি গোপনে। সেই অনুযায়ী, ৬ নভেম্বর রাতে অর্থাৎ ৭ নভেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে অর্থাৎ জাসদের অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার ১ ঘণ্টা আগেই দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির জওয়ানরা মেজর মহিউদ্দিন এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হকের নেতৃত্বে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তাকে মুক্ত করেন এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনে তাকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসেন।

বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা যখন জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে কর্নেল তাহেরের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেনানিবাসে আসে, তখন তারা খুবই হতাশ হন। লে. কর্নেল (অব.) তাহের নিজেও হতাশ হয়ে পড়েন। তারপরও শেষ কৌশল হিসাবে তিনি জেনারেল জিয়াকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টার থেকে বের করে আনার জন্য নিজেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে পালটে গেছে। সাধারণ সিপাহিদের সঙ্গে জনতাও স্বতঃফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবে। বিনা রক্তপাতে স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবের মাধ্যমে পালাবদলের পরও, এমনকি বঙ্গভবন থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল পালিয়ে গেছেন, এটি জানার পরও হাসানুল হক ইনু এবং লে. কর্নেল (অব.) তাহেরের নির্দেশে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা মরিয়া হয়ে ওঠে এবং সেনানিবাসের ভেতরে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে কর্নেল তাহের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে জেনারেল জিয়াকে বের করে আনার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য রেডিও স্টেশনে নেওয়ার প্রস্তাব করেন। সেখানে উপস্থিত অন্যরা দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতেই রেডিও কর্মকর্তাদের ডেকে এনে জেনারেল জিয়ার ভাষণ রেকর্ড করানোর পালটা প্রস্তাব দেন। এতে লে. কর্নেল (অব.) তাহের একাধারে আরও ক্ষিপ্ত ও হতাশ হন।

এ অবস্থায় লে. কর্নেল (অব.) তাহের তার অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের যে কোনো মূল্যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলকে হত্যার নির্দেশ দেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল এ নির্দেশের কথা তার ব্রিগেড মেজর হাফিজের কাছ থেকে জেনে তা বঙ্গভবনে অবস্থানরত খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন। সেনানিবাসে ফোন করে খালেদ মোশাররফ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলকে বঙ্গভবনে অবস্থান করতে বলে কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদাকে নিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। তারা প্রথমে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামানের বাসায় গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করেন। সেখান থেকে তারা খালেদ মোশাররফের এক আত্মীয়ের বাসায় যান এবং কয়েক জায়গায় ফোন করার পর শেরে বাংলা নগরে অবস্থানরত ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্নেল নওয়াজেশের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার আশ্বাস পান এবং সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পথিমধ্যে একটি দুর্ঘটনায় তাদের গাড়িটি নষ্ট হয়ে গেলে প্রথমে তারা মোহাম্মদপুরের ফাতেমা নার্সিং হোমে যান। সেখান থেকে হেঁটে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পে পৌঁছান।

কর্নেল নওয়াজেশ আহমেদ টেলিফোনে জেনারেল জিয়াকে তার ক্যাম্পে খালেদ মোশাররফের উপস্থিতির বিষয়টি জানান। জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নিরাপত্তার সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্নেল নওয়াজেশকে নির্দেশ দেন। তিনি কর্নেল নওয়াজেশের ক্যাম্পে অবস্থানরত রেজিমেন্টের আরেকজন সেনা কর্মকর্তা মেজর জলিলের সঙ্গেও কথা বলে তাকে নির্দেশ দেন, তিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছাড়াও বাকি আরও দুজন সেনা কর্মকর্তাকে যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্নেল নওয়াজেশকে সাহায্য করেন।

কর্নেল হুদার স্ত্রী নিলুফার হুদার বইয়ের তথ্য অনুযায়ী-এ সময় ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে অবস্থানরতদের কাছ থেকে জানা যায়, যখন জেনারেল জিয়া কর্নেল নওয়াজেশ এবং মেজর জলিলের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন লে. কর্নেল (অব.) তাহের মিনিট ১৫-এর জন্য বাইরে চলে যান। সেখান থেকে ফিরে তিনি জেনারেল জিয়ার কাছে খালেদ মোশাররফের সঠিক অবস্থান জানতে চান এবং আবারও কিছুক্ষণের জন্য বাইরে চলে যান।

সেনাপ্রধানের আদেশ ও নিশ্চয়তা পেয়ে কর্নেল নওয়াজেশ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তার দুই সঙ্গীর জন্য নাস্তার আয়োজন করেন। তাদের নাস্তা পরিবেশনের কিছুক্ষণের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর খাকি পোশাক পরিহিত লে. কর্নেল (অব.) তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বেশকিছু সদস্য গান পয়েন্টে সেই কক্ষে প্রবেশ করে এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফসহ তিন সেনা কর্মকর্তাকে অস্ত্রের মুখে কক্ষের বাইরে এনে হত্যা করে। সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে জানা যায়, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু সদস্য কর্নেল আসাদুজ্জামানের কাছে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও তার দুই সঙ্গীকে হত্যার জন্য লে. কর্নেল (অব.) তাহেরের নির্দেশ পৌঁছে দেন এবং কর্নেল আসাদুজ্জামান নিজে ওই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আসলে একটি রক্তাক্ত ব্যর্থ অভ্যুত্থান হয়েছিল জাসদের মাধ্যমে, আর তারই সমান্তরালে আরেকটি রক্তপাতহীন সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল সিপাহি-জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে, যার নেতৃত্ব এসেছিল সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে। ১৯৭৫-এর মধ্য আগস্ট থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ও পালটা অভ্যুত্থানের মধ্যে সবার অলক্ষ্যে জন্ম নিয়েছিল ইতিহাসের মোড় ফেরানো এক অনন্যসাধারণ বিপ্লব, যা আমূল পালটে দিয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি।

একেএম ওয়াহিদুজ্জামান : বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম