সরকার নিজেও মূল্যায়ন করুক তার কাজের
হাসান মামুন
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
নতুন একটি সরকারের তিন মাস কিংবা ১০০ দিনের ‘পারফরম্যান্স’ নিয়ে আলাদা করে আলোচনার অবকাশ থাকে। সরকারের তরফ থেকেও ১০০ দিনের কার্যসূচি ঘোষণার রীতি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য তেমন ঘোষণা দেয়নি। কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্বও নেননি তারা। কোটা আন্দোলন ঘিরে মাত্র ক মাস আগে নতুন করে ক্ষমতায় বসা একটি সরকারের পতনই ঘটে যাবে, সেটাও কারও হিসাবের মধ্যে ছিল না। তবে পতনের পূর্বশর্তগুলো পরিপূর্ণভাবে বিরাজ করছিল। এ অবস্থায় রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পরিপূরণে একটি সরকার গঠিত হয়, যা এক নতুন অভিজ্ঞতা। এর আগে দেশে এমন ধারার আন্দোলন হয়নি আর এ ধরনের সরকারও গঠিত হয়নি। সরকারটি অবশ্য শপথ নিয়েছে হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রপতির কাছেই। এর আগে এ বিষয়ে আপিল বিভাগের মত নেওয়া হয়।
গণ-অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন উপায়েও সরকার গঠিত হতে পারত বলে কেউ কেউ মনে করেন। তাতে সরকারটি অধিকতর কর্তৃত্ব নিয়ে কাজ করতে পারত বলে তাদের ধারণা। কিন্তু যেটা হয়নি, তা নিয়ে কথা বলে এখন বোধহয় ফায়দা নেই। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটে গেলে একটা অপ্রস্তুত অবস্থায় যা ভালো মনে হয়েছে, করা হয়েছে সেটাই। তাতে বিদ্যমান সংবিধান অনুসরণের প্রয়াস আছে বলেই মনে হচ্ছে। সংবিধানের অনেক বিধিবিধান নিয়ে বিতর্ক অবশ্য আগে থেকেই ছিল। মূল সংবিধানও অবিতর্কিত নয়। অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার কমিশন করেছে, এর মধ্যে আছে সংবিধান সংস্কার কমিশনও। মোট ১০টি কমিশন করেছে সরকার। নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সুপারিশ দেওয়ার কথা। সেগুলো নিয়ে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে সরকার। যেসব সুপারিশে সব পক্ষ একমত হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যথেষ্ট সময় না পেলে তা বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী সরকার। তেমন একটি অঙ্গীকারপত্রে সব রাজনৈতিক দলের সম্মতি নিয়ে রাখা হবে সেক্ষেত্রে। দলীয় রাজনৈতিক সরকারের অঙ্গীকার ভঙ্গের উদাহরণ তো কম নেই। অবিশ্বাস তীব্রভাবেই আছে যে, কোনো দলীয় সরকার সর্বদলীয় অঙ্গীকার রাখবে না। এরশাদ পতনের আন্দোলনে গৃহীত তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন করেনি বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ সরকার। অতঃপর ওয়ান-ইলেভেন সরকার সংস্কারে সবিশেষ জোর দিলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসা হাসিনা সরকার চলেছে এর বিপরীতে। বর্তমান সংকটের জন্য রাজনৈতিক সরকারের অঙ্গীকার ভঙ্গের প্রবণতাই মূলত দায়ী বলে মনে করা হয়। সেজন্যই বলা হচ্ছে, ইউনূস সরকারকে জরুরি সংস্কারগুলো সেরে যেতে হবে। জাতীয় নির্বাচন লক্ষ্য অবশ্যই; কিন্তু সংস্কারের পথেই সেদিকে যেতে হবে।
সংস্কার কার্যক্রম আর নির্বাচনের প্রস্তুতি একযোগে চলবে বলে সরকারও সবাইকে আশ্বস্ত করছে। দেরিতে হলেও পদত্যাগ করেছেন বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনাররা। তারা একটি নতুন ধরনের তামাশার নির্বাচন হতে দিয়েছিলেন। এসব নির্বাচনকে অতীতের ঘটনায় পরিণত করতে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাত্র একটি সংস্কার যদি সরকারকে করতে হয়, তবে এটি হলো সেই সংস্কার। কেননা হাসিনা সরকার ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হতে নির্বাচনব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। টানা ক্ষমতায় থেকে তারা অন্যান্য ক্ষেত্রেও করেছে যথেচ্ছ অনাচার। অর্থনীতিতে লুটপাটকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অকল্পনীয় জায়গায়। এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি অনিয়ম-দুর্নীতির যেসব খবর দিচ্ছে, তাতে অবাক হতে হয়। দুর্বৃত্ত রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ী মিলে গড়ে ওঠা চক্র দেশকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলার প্রক্রিয়ায় ছিল বললে ভুল হবে না। সামনে ছিল উন্নয়নের বয়ান এবং এর ‘প্রমাণ’ হিসাবে দৃশ্যমান কিছু মেগা প্রজেক্ট। অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনা সরকার আমলে গৃহীত প্রকল্পগুলো স্বভাবতই বাছবিচার করে দেখছে। নতুন একটি অর্থবছরের শুরুতেই বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন আসায় বাজেট বাস্তবায়নও আগের ধারায় সম্ভব হচ্ছে না। এডিপি বাস্তবায়নে সরকার নিজেই অর্থব্যয়ের গতি ধীর করে দিয়েছে। কর্মসংস্থান ও ব্যবসায় এর নেতিবাচক প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিনিয়োগ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইউনূস সরকার আমলে বিদেশি ঋণসহায়তা বাড়ার প্রবণতা দেখা গেলেও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে হয় না। বিদ্যমান বিনিয়োগও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংকটে পড়েছে।
আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টসের একাংশ এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক অসন্তোষে। এতে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির উসকানি দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। এর পেছনে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপও অস্বীকার করা যাবে না। হাসিনা শাসনামলের শেষ দুবছরে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিম্ন-আয়ের মানুষের কোমর ভেঙে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার আমলেও সে ধারা অব্যাহত। নতুন করে কিছু নিত্যপণ্যের দাম একযোগে বাড়ার ঘটনায় তারা নিজেরাও বিব্রত মনে হয়। দায়িত্ব গ্রহণের মাস দুয়েক পরই এক ডিমের দাম বৃদ্ধি মানুষকে অস্থির করে তুললে সরকার এটা নতুন করে আমদানির উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে দেশের দুই-তিন অঞ্চলে হয় ভয়াবহ বন্যা। তাতে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে চালের সংকট হতে পারে বলে সরকারকে এটা আমদানির উদ্যোগও নিতে হয়েছে। একের পর এক পণ্যে দিতে হচ্ছে করছাড়। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণ সহায়তার ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে। রাজস্ব ব্যয় বাড়িয়ে উন্নয়ন খাতে এটি কমানোর কোনো বিকল্প নেই। অর্থনীতি, বিশেষত পণ্যবাজারে অস্থিরতা কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। ৮ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পূর্ণ হবে। এ সময়ে হাসিনা সরকার আমলে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা সবচেয়ে ভালোভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাফল্য রয়েছে ডলার বাজার ব্যবস্থাপনায়। ইতিবাচক ঘটনা হলো বৈধ পথে রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়া। ধারাটি আরও শক্তিশালী হলে সামনে রিজার্ভ পরিস্থিতি স্বস্তিকর হয়ে আসবে। আমদানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডলারে যেসব পেমেন্ট করতে হয়, সেগুলোর সম্মানজনক নিষ্পত্তি করা গেলে সরকারের পথচলা সহজ হবে। দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কাও দূর হবে বলে আশা।
এমন শঙ্কা নিয়ে তো রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলে নজিরবিহীন সংস্কারের পথে সরকার এগোতে পারবে না। এজন্য শুধু মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নয়; প্রয়োজন ব্যাপক মানুষের সমর্থন। তারা নিত্যদিন বাজারে গিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকলে সরকার স্বস্তিবোধ করবে না। রাজধানীতে যানজট পরিস্থিতিও খারাপ হয়েছে। তিন মাস চলে যাওয়ার পরও এক্ষেত্রে স্বস্তি না এলে শুধু ট্রাফিক পুলিশকে দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। এতে নতুন করে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানোর ধারণা কিন্তু সবাই পছন্দ করছে না। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তীকালে এসব ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা রাখার পর তাদের এখন পড়াশোনায় মন দেওয়ার কথা। রাজপথে অকাতরে রক্তও দিয়েছে তারা এবং সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মানুষকে টেনে এনেছে আন্দোলনে। এখন মূলত সরকারের দায়িত্ব প্রশাসনকে সক্রিয় করে সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এটা অবশ্য ঠিক, সুদীর্ঘ দলীয়করণের কারণে পুলিশসহ প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে নতুন সরকারের প্রতি অসহযোগিতার মনোভাব রয়েছে। তিন মাসেও পুলিশকে সক্রিয় করতে না পেরে সরকার সেনাদের বিশেষ আইনি ক্ষমতা দিয়ে নামিয়েছে মাঠে। তবে আইনশৃঙ্খলায় অবনতির ধারা রোধ হয়েছে বলা যাবে না। সাধারণ অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হওয়ার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে না। অক্টোবরে অন্তত ৬৮টি রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটেছে বলে জানিয়েছে একটি বেসরকারি সংস্থা। ডাকাতি-ছিনতাই নতুন করে বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে বিশেষত রাজধানীতে। মোহাম্মদপুরে একের পর এক খুনের ঘটনার পর সেনা অভিযান জোরদার করতে হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী পরিস্থিতিতে কিছু ‘মব জাস্টিস’ ঘটে গেলেও তা শক্ত হাতে দমন করা হবে বলে যারা আশা করেছিলেন, তারা এখন হতাশ। এসব ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তিও বিনষ্ট হচ্ছে। প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশের কিছু মিডিয়ায় এর অতিরঞ্জিত প্রচারও বন্ধ হচ্ছে না।
এর মধ্যে অবশ্য ভালো ঘটনা হলো দুর্গাপূজা প্রায় নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হওয়া। সরকার রাজনৈতিকভাবে দৃঢ়চিত্ত হলে যে ভালোভাবে কাজ করা সম্ভব, এটা তার প্রমাণ। এ উপলক্ষ্যে ছুটি বাড়ানোর ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো কোনো ছুটি বাতিলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব বিতর্কে না গেলেও পারত বলে মনে করা হচ্ছে। এও ঠিক, এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। তার কাজ কেবল নির্দিষ্ট সময়ে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা নয়। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সম্মিলিত ইচ্ছা বাস্তবায়নেও তাকে কাজ করতে হবে। তবে সব ‘ইচ্ছা’ বাস্তবায়নের সময় তো মিলবে না। সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ও এর পরবর্তীকালে সুশাসনের পথটা কেবল তাকে তৈরি করে দিতে হবে। সেজন্য কত সময় লাগতে পারে, তা নিয়ে অবশ্য শুরু থেকেই কথাবার্তা হচ্ছে। মাঝে এটি নিয়ে বিতর্কও হয়ে গেল। সরকার এটা ছেড়ে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ওপর। এর গভীরে সেনাবাহিনীর ইচ্ছার বিষয়ও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি অপসারণে অনেকের অশেষ আগ্রহে তারা সম্মত হয়নি বলে বাজারে আলোচনা রয়েছে। সেটা সত্য হয়ে থাকলে বলতে হয়, সংবিধানের সঙ্গে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ তাদের কাম্য নয়।
আসলে রাজনৈতিক সংকটের অবসান এবং গণতন্ত্র ও জবাবদিহির পথে ফিরে যাওয়াটাই তো লক্ষ্য। রাজনৈতিক সরকার, বিশেষত হাসিনা সরকার এ জায়গাটা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যাওয়ায় কাজটি খুব কঠিন মনে হচ্ছে। তবে সবদিক সামলে সেটি করবে বলেই তো দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ অবস্থায় তিন মাস শেষ হওয়ার লগ্নে তারা নিজেরাও নিজ কাজের মূল্যায়ন করবেন বলে সবার প্রত্যাশা। রাজনৈতিক সরকারের মতো গতানুগতিক মূল্যায়ন তো তাদের কাছে কেউ আশা করে না।
হাসান মামুন : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক