সাক্ষাৎকার
ট্রাম্প জিতলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না: এম হুমায়ুন কবির
খালিদ বিন আনিস
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যুক্তরাষ্ট্রে বহুল আলোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ। এবারের নির্বাচনে দেশটির বড় দুই দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, আগাম জরিপে এমনটাই উঠে এসেছে। তবে মূল খেলায় কে বিজয়ের হাসি হাসবেন, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও তাকিয়ে মার্কিন নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। এর কারণও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক কূটনীতিক, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খালিদ বিন আনিস
যুগান্তর : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প নাকি কমলা, বিজয়ের দিকে কার পাল্লা ভারী?
এম হুমায়ুন কবির : এক সপ্তাহ আগে হলেও আমি বলতাম, ট্রাম্পের পাল্লাটা ভারী, এমন একটা প্রবণতা লক্ষ করছিলাম; কিন্তু গত ৩-৪ দিনে আমার কাছে মনে হচ্ছে, কমলা হ্যারিসের পাল্লাটা একটু ভারী হচ্ছে। কেন মনে করছি, তার একটা দৃষ্টান্ত দেই। একটি হচ্ছে, গত ক’দিন ধরে যেটাকে বলা হয়, আর্লি ভোটিং অর্থাৎ আগাম ভোট-যেটা সব স্টেটেই দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে সাতটি সুইং স্টেট যাদের বলা হয়, সে জায়গাগুলোতে যে প্রবণতা, তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি ভোট দিচ্ছেন। একশজন পুরুষ যদি ভোট দিয়ে থাকেন, সেখানে একশ দশজন নারী ভোট দিচ্ছেন। নারীদের বেশি সংখ্যায় ভোট দেওয়ায় মনে করা হচ্ছে, তারা বেশি ভোট দিলে কমলা হ্যারিস জিতে জেতে পারেন। এরকম একটা বিশ্লেষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, রোববার একটি জরিপ বেরিয়েছে-যেখানে আইওয়া রাজ্যকে লাল অর্থাৎ ট্রাম্প যে দলের প্রার্থী, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান দলের সমর্থকদের স্টেট বলা হয়ে থাকে, এখন সেই স্টেটকে মনে করা হচ্ছে কমলা হ্যারিসের দিকে সুইং করতে পারে। লাল থেকে নীল অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের দিকে চলে যেতে পারে সমর্থন। সেখানে বিশ্লেষণ হচ্ছে যে, শেষ মুহূর্তে যারা সিদ্ধান্ত নেননি, তারা এখন কমলা হ্যারিসের দিকে ঝুঁকছেন। এর কারণ হতে পারে, গত সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে সম্ভাব্য সহিংসতার আশঙ্কায় এখন অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্পকে ভোট না দিয়ে কমলা হ্যারিসকে দিলে অন্তত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে। সেদিক থেকে যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোটাররা ছিলেন, তারা এখন কমলা হ্যারিসের দিকে ঝুঁকছেন। সেটিই যদি ভোটের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, বেশি সংখ্যায় নারীরা যদি ভোট দেন এবং যারা আফ্রো-আমেরিকান, তারা যদি কমলা হ্যারিসকেই ভোট দেন, তাহলে বলতে হবে, কমলার জেতার সম্ভাবনাটা বাড়ছে এখন। যদিও নির্দিষ্ট করে বলা এখনই যাবে না, তবে গত দু-তিন দিনের যেসব তথ্য-উপাত্ত আসছে, তাতে কমলার পক্ষেই নির্বাচনি বাতাস বইছে, এটুকু বলা যেতে পারে।
যুগান্তর : ভোটারদের কাছে নারী ও অশ্বেতাঙ্গ হিসাবে কমলা হ্যারিসের কোনো নেতিবাচক দিক আছে কি? নির্বাচনি প্রচারণায় দুই প্রার্থীর আলাদাভাবে কোন কোন দিকগুলোকে আপনি পজিটিভ মনে করেন?
এম হুমায়ুন কবির : কমলা হ্যারিসের নেতিবাচক দিক দু-তিনটা। যেমন, তিনি বাইডেনের প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ছিলেন, এটাকে নেতিবাচক দিক হিসাবে কেউ কেউ মনে করেন। কারণ, জনপ্রিয়তার দিক থেকে বাইডেনের অবস্থান বেশ নিচে। তার সেই অজনপ্রিয়তার কিছুটা প্রতিফলন কমলা হ্যারিসের ওপরও পড়ছে, যা তার জন্য নেতিবাচক। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, তিনি অনেক পরিকল্পনার কথা বলছেন; কিন্তু কঠিন সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে তিনি এখনো সরাসরি কোনো বক্তব্য দিচ্ছেন না। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা রাজনীতিতে যে ধরনের মানুষকে প্রত্যাশা করেন অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ, খ্রিষ্টান এবং আসল মার্কিনি হবে-এই তিনের কোনোটাই তিনি নন। কাজেই এই তিনটি বিষয়ে অনেকে মনে করছেন যে, তিনি যথেষ্ট মার্কিনি নন। সেটাকে তার নেতিবাচক দিক বলা যেতে পারে। আর দুই প্রার্থীর ইতিবাচক দিক বলতে গেলে ট্রাম্প যেমন উসকানি দিয়ে, অন্যকে হেয় করে কথা বলেন, সেদিক থেকে কমলা অনেক পরিশীলিত। আবার অল্প সময়ে নির্বাচনি মাঠে নামায় কমলা হ্যারিসকে বোঝাতে হচ্ছে তিনি কে, তার নিজস্ব প্রেসিডেন্সিটা কেমন হবে। যদিও সে চ্যালেঞ্জকে তিনি ভালোভাবেই ম্যানেজ করেছেন। তিনি ঐক্যের বিষয়টি সবাইকে অন্তত বোঝাতে পেরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সবাইকে তার প্রয়োজন। যিনি সহমত হবেন তাকেও চাই; যিনি সহমত নন, দেশের উন্নতির স্বার্থে তাকেও তার প্রয়োজন। ক্লোজিং যে বিতর্ক অর্থাৎ নির্বাচনি প্রচারণার শেষ কথাটায় আমার ধারণা অনেকেই কমলার বার্তাকে ইতিবাচকভাবে নিচ্ছেন। সেখানে ট্রাম্প কিন্তু বিভাজনের কথা বলছেন, সহিংসতার কথা বলছেন।
যুগান্তর : ট্রাম্প জিতলে ফিলিস্তিন ও ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন? বিশ্বশান্তির জন্য কোন দল বেশি নিরাপদ, ডেমোক্র্যাটিক নাকি রিপাবলিকান?
এম হুমায়ুন কবির : ট্রাম্প এলে আমার ধারণা, মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে তিনি নেতানিয়াহুকে ফ্রি হ্যান্ড দিয়ে দিতে পারেন। এর অর্থ দাঁড়াবে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে, লেবাননের মানুষদের বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা চলছে, তা অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত ইসরাইল সন্তুষ্ট হয়ে তা বন্ধ না করবে। এমনকি তিনি ইরানের ক্ষেত্রেও ইসরাইলকে ফ্রি হ্যান্ড দিতে পারেন, যেটা খুবই বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে আমি এ আশঙ্কাটা করছি। পাশাপাশি তিনি আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক ভালো করার জন্য উদ্যোগী হতে পারেন, যেটা আগেরবার হয়েছিলেন। এর অর্থ দাঁড়াবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ট্রাম্প ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেন। আর ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে তিনি বলছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলে তা শেষ করে ফেলবেন। কিন্তু এটা ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতারই একটা প্রতিফলন এবং সেখানে আমি জানি না কীভাবে তিনি সেটা করবেন। তবে টেকসই সমাধান হবে কিনা, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। আর বিশ্বশান্তিকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব, সেটার ওপর নির্ভর করে। ধরেন বাংলাদেশের দিক থেকে একরকম আবার আমেরিকা বা রাশিয়ার মতো ক্ষমতাধরদের দিক থেকে আরেক রকম। আমাদের দিক থেকে বলতে গেলে কারও কাছ থেকেই বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেই। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বললে, ট্রাম্প পুরোনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরত আনতে চাইছেন। কমলা হ্যারিস নতুন পৃথিবীর চ্যালেঞ্জের মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নতুনভাবে তৈরি করতে চাইছেন। এখন এ কাজটা তারা কীভাবে করবেন, তাতে বিশ্বশান্তি কতটা থাকবে, সে সম্পর্কে খুব স্পষ্ট জবাব দেওয়া যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের দিক থেকে মনে করি উভয়ই বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
যুগান্তর : ট্রাম্প জিতলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে কি? বাংলাদেশের সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক হবে?
এম হুমায়ুন কবির : ট্রাম্প জিতলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটা ক্ষমতাবিভাজিত। কংগ্রেস ওখানে ভূমিকা পালন করে, থিঙ্কট্যাংক করে, প্রশাসন করে; কাজেই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলেও শুধু বাংলাদেশ কেন, তার মনোযোগের অনেক বিষয় রয়েছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে খুব একটা নীতির পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। তবে আমরা যদি দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা শক্তিশালী করতে পারি, তাহলে ট্রাম্পের কাছ থেকেও ইতিবাচক মনোভাব দেখতে পারব বলে আমি আশা করি। আর কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় এলে বর্তমান কূটনীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
যুগান্তর : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, নির্বাচিত হলে এর কোনো প্রভাব পড়বে কি?
এম হুমায়ুন কবির : আমি তা মনে করছি না। কারণ ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির ঘনিষ্ঠতা অনেকদিনের। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্ক আরও গভীর হবে, এটা আমি মনে করতে পারি। সেটা তাদের দুই পক্ষের বিষয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মতো করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যদি উন্নত করতে চাই, সেটা করা সম্ভব। কিন্তু সেটা করতে হলে আমাকে ভালো কাজগুলো করে তবেই তা করতে হবে। আমি খারাপ কাজ করলে সেই সম্পর্ক তৈরি করতে পারব না। এর দৃষ্টান্ত গত ১৫ বছরে দেখেছি। আমরা সঠিক কাজগুলো করতে পারছিলাম না। কাজেই যদি আমরা সঠিক কাজটা করতে পারি, তাহলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে সাইডে রেখেও আলাদা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
যুগান্তর : ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির বিষয়ে আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন? কমলার ক্ষেত্রে?
এম হুমায়ুন কবির : ওখানে দু-তিনটি বিষয় আমি প্রত্যক্ষ করেছি। এবার বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা অংশ রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে বেশ সক্রিয়, এটা লক্ষ করার মতো। তবে ট্রাম্প যদি জেতেন, তাহলে বাংলাদেশি অবৈধ যারা আছেন বা যারা এখনো নিয়মিত হননি, তাদের জন্য জটিলতা বাড়বে বলে আমি মনে করছি। এছাড়া ইমিগ্রেশন ইস্যুটা এবার যেভাবে আলোচিত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় কমলা হ্যারিস এলেও যে তিনি খুব বেশি নমনীয় হবেন, তা আমার মনে হয় না। কারণ এ বিষয়টি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ধরনের কনসার্ন আমার মনে হয় জাতীয় পর্যায়ে তৈরি হয়েছে। কাজেই কমলা হ্যারিস এলেও এ ব্যাপারে খুব বেশি পরিবর্তনের আশা আমি করছি না। তবে তিনি বলেছেন, কংগ্রেসের সহায়তায় তিনি একটা অভিবাসন আইন করবেন। সে আইনটা হলে অভিবাসন যে আইনটা রয়েছে ওখানে, অবৈধদের বৈধ হওয়ার সুযোগ হয়তো তৈরি হতে পারে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
এম হুমায়ুন কবির : ধন্যবাদ।