স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সংস্কারে কমিশন নয় কেন?
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কমিশনগুলোকে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে; অর্থাৎ এ কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলো সময় পাবে তিন মাসেরও কম।
তবে ধারণা করা যায়, বিষয়ের গভীরে গিয়ে আনুষঙ্গিক তথ্য, উপাত্ত ও অংশীজনদের মতামতগুলো অনুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনাপূর্বক জনগণের প্রয়োজন ও প্রত্যাশাকে ধারণ করে এসব প্রতিবেদন তৈরির জন্য এসময় খুবই সীমিত। আর সে কারণে কোনো কোনো কমিশনকে হয়তো শেষ পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির আবেদনও জানাতে হতে পারে। দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত কমিশন ইতোমধ্যে আগামী ৬ জানুয়ারির মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানিয়েছে। তবে তিন মাসের মধ্যে না হলেও অন্তত চার মাসের মধ্যে সব প্রতিবেদনই তৈরি হয়ে যাবে বলে ধারণা করা চলে।
আশা করা যায়, এ প্রতিবেদনগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। তবে যে বিবেচনায় এ কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে, সেই একই বিবেচনায় এ মুহূর্তে আরও একটি কমিশন গঠন করা জরুরি বলে মনে করি এবং সেটি হচ্ছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কার সংক্রান্ত কমিশন। বিষয়টি কেন জরুরি, সেটিই এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যবস্থার নানা ত্রুটিবিচ্যুতি, অসংগতি ও দুর্বলতা নিয়ে যখনই কোনো কথা হয়েছে, তখন অধিকাংশ সময়েই একটি বিষয় সামনে এসেছে, এ দেশের সরকারব্যবস্থা অতিমাত্রায় কেন্দ্রায়িত এবং এ অতিকেন্দ্রীভূত হওয়ার অভিযোগ জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও অনুরূপ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেমনি সত্য, তেমনি সমান সত্য বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি এবং ব্যাংক-বাণিজ্য ও অর্থনীতির অপরাপর কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও। এমনকি যেসব কমিশন গঠন করা হলো, দেখা যাবে, অনিবার্যভাবে সেগুলোর সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণেও এ বিকেন্দ্রীকরণের কথাই উঠে এসেছে। তন্মধ্যে জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের দাবি তো আজ বহুযুগ থেকেই বারবার উত্থাপিত হয়ে আসছে এবং এখনো এ দু’বিভাগের বিষয়ে সাধারণের মূল দাবি ও একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞ অভিমত এই যে, এগুলোর সেবার মান উন্নীত ও ত্বরান্বিতকরণের পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব এসবের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে। আর এ বিকেন্দ্রীকরণের আরেকটি অর্থই হচ্ছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। অর্থাৎ বৃত্তের কেন্দ্র থেকে পরিধিতে যা যা স্থানান্তরিত হবে, তার প্রায় সবকিছুর গ্রহীতাই হবে এ স্থানীয় সরকার।
এবার অতি সংক্ষেপে স্থানীয় সরকারের বর্তমান অবস্থাটিকে খানিকটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সর্বনিম্ন পর্যায়ে বর্তমানে যে ইউনিয়ন পরিষদ আছে, তা এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি দুর্বল ও অকার্যকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। অদ্ভুত শোনালেও এটিই বাস্তবতা যে, গ্রাম পর্যায়ের প্রায় সব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বাস্তবায়ন ও তদারকিই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) বিভিন্ন বিভাগের আর যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন, তারা সবাই বস্তুত কেন্দ্রীয় সরকার তথা কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রেরই প্রতিনিধি এবং তারাই বস্তুত গ্রামের বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাটবাজার, খেয়াঘাট, জলমহাল, ডাটা সেন্টার ইত্যাদি সবকিছুর পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক। আর এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের দায়িত্ব পালনকারী জাতীয় সংসদ-সদস্যদের হাস্যকরভাবে স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের শুধু স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধানের সঙ্গেই যুক্ত করা হয়নি, তাদের স্বতন্ত্র বাড়তি বরাদ্দ দিয়ে সরাসরি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গেও যুক্ত করা হয়েছে। সংসদ-সদস্যদের সরাসরি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালনের এ বিষয়টি তাদের জন্য শুধু অমর্যাদাকরই ছিল না-একইসঙ্গে তা ছিল সংবিধানেরও গুরুতর লঙ্ঘন।
আর কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের পক্ষে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা যে, এখন গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডগুলোকে চারদিক থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং গত দেড় দশকে তা যে আরও বেশি মাত্রায় সম্প্রসারিত ও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে, গণমাধ্যমের হালকা ধাঁচের খবরাখবর ও আলোচনা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চরম মানহীন কথাবার্তার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা শিক্ষিত নাগরিক সমাজের অনেকে হয়তো তা জানেনও না। ২০০৯ সালের তুলনায় মাঠ পর্যায়ের এ দপ্তরগুলোতে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের প্রতিনিধির সংখ্যা এখন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ তথা স্থানীয় সরকারব্যবস্থা জোরদারকরণের কথা ভাবলে এ সংখ্যা বৃদ্ধি না করে বরং বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব জনবলের সংখ্যা। কারণ বাহ্যিক ও বাস্তব অবস্থার বিবেচনায় ইউনিয়ন পরিষদই হচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের একেবারে দোরগোড়ায় অবস্থানকারী সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান। ফলে তাদের মাধ্যমেই কেবল রাষ্ট্রীয় সেবা ও সুবিধা পাওয়ার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, গত ৫৩ বছরের ইতিহাসে এদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারই এ প্রতিষ্ঠানটিকে ক্রমশ আরও দুর্বল করে ফেলার ও শুধু নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। ২০১৬ সালে সরকার যে প্রথমবারের মতো সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলভিত্তিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চালু করল, এটি শুধু ওই পরিষদকেই দুর্বল করেনি, গ্রামীণ সমাজের শত শত বছরের ঐক্য ও সংহতির শক্তিকেও বিনষ্ট করে দিয়েছে। আর এর অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামগুলোতে হানাহানি, খুনোখুনি, সাম্প্রতিক দাঙ্গা, দলাদলি, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়া।
সে তুলনায় বরং সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই এ দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন (সামরিক শাসনকে সমর্থন করা হচ্ছে না)। এরশাদ আমলে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের যেসব ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটিই বাংলাদেশে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা উদ্যোগ। তার সময়ে নেওয়া বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগও এ ক্ষেত্রে এযাবৎকালের সেরা দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের বাধা ও অসহযোগিতার কারণে সেদিন সে দুটি উদ্যোগের কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বরং ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর আমলা ও অন্যরা মিলে রাজনীতিকদের মাথায় কাঁঠাল রেখে উপরোক্ত বিকেন্দ্রীকরণ উদ্যোগের সিংহভাগই নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হন। কিন্তু আজ রাষ্ট্রের নানা পর্যায়ে ব্যাপক সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে, সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন হচ্ছে সম্প্রতি গঠিত কমিশনগুলোর মতো এক্ষেত্রেও একটি কমিশন গঠন করা, যে কমিশন স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আনুষঙ্গিক করণীয়গুলো সুপারিশ করবে।
সংবিধান সংশোধনসহ নানা মাত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি জনরাষ্ট্র গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা এখন খুবই প্রবল। কিন্তু মনে রাখা দরকার, সে ধরনের একটি জনরাষ্ট্র গড়ে তোলা তথা রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করার জন্য স্বনির্ভর শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। এমনকি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্যও এ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। আর প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, উন্নততর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সমাজে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার বিকাশ সাধন ইত্যাদির জন্য শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যস্থার কোনো বিকল্প এখনো পৃথিবীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের চিন্তায় স্থান পায়নি। ফলে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে হলে একটি স্বনির্ভর শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আমাদের গড়ে তুলতেই হবে, যেখানে ওই সরকারগুলো রাজস্ব আহরণ, বাজেট প্রণয়ন, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, প্রাথমিক শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যসেবা প্রদান ইত্যাদি কাজগুলো নিজেরাই করবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো কেন্দ্রীয় সরকার তাদের আর্থিক, কারিগরি ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সেবা প্রদান করবে। তবে সেগুলোর বাস্তবায়নও হবে স্থানীয় সরকারের কাঠামোর আওতায় থেকেই।
উপরোক্ত এ প্রস্তাবগুলোর কথা শুনলে সর্বাগ্রে অসন্তুষ্ট হবেন এ দেশের আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত সদস্যরা। কারণ এমনটি ঘটলে তাদের যুগযুগান্তরের কায়েমি স্বার্থেই শুধু আঘাত লাগবে না, তারা যে দীর্ঘকাল ধরে একটি জবাবদিহিতাবিহীন ‘স্বাধীন সংস্কৃতি’র মধ্যে থেকে কাজ করার স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে আসছিলেন, সেটিও এক লহমায় অনেকখানি হারিয়ে যাবে। আর আইন প্রণয়নকারী জাতীয় সংসদের সদস্যরা হয়তো প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ হারানোর কারণে এতে অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু তাদেরই আসলে এ ব্যাপারে সর্বাধিক সন্তুষ্ট হওয়া উচিত এই ভেবে যে, নিজেদের মধ্যকার নানা অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে তারা যে এতদিন আমলাতন্ত্রের ওপর কাঙ্ক্ষিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হচ্ছিলেন না, প্রস্তাবিত এ স্থানীয় সরকারব্যবস্থা তাদের সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে অনেকখানি সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়। আর মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে যে কমিশনগুলো গঠন করেছেন, সেগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নকে সম্পূরকতাদানের জন্য হলেও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য অনুরূপ একটি কমিশন গঠন করা জরুরি বলে মনে করি।
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)