Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

এই বেহাল বাজারের কোনো অর্থনীতি নেই

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এই বেহাল বাজারের কোনো অর্থনীতি নেই

বয়স একটু হয়েছে বলতেই হয়। শরীরের পরিবর্তন লক্ষ করলেই বোঝা যায়। বোঝা যায় আমাকে ছেড়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চলে যাচ্ছে, কিছু কিছু নষ্ট হচ্ছে। এই যেমন-মাথার চুল অর্ধেক নেই। কালো চুল সাদা হচ্ছে। এসব যাচ্ছে, ছাড়ছে, আমাকে কিন্তু ছাড়ছে না মূল্যস্ফীতি। সেই কবে থেকে মূল্যস্ফীতির কথা লিখছি, লিখছি কাঁচামরিচের দামের কথা, আজও তা লিখে যাচ্ছি। মরিচের মূল্য, দ্রব্যমূল্য আমাকে ছাড়ছে না। বস্তুত কাউকে ছাড়ছে না। সেই ১৯৭২-৭৪ সালের কথা। সদ্য স্বাধীন দেশ। চারদিকে অভাব। ৯ মাস খেতে কোনো ফসল হয়নি। আমদানি-রপ্তানি বিঘ্নিত। ডলার নেই। তেলের দামে ঊর্র্ধ্বগতি। দেখা গেল কাঁচামরিচের দাম উঠেছে সের প্রতি ১৬ টাকায়। ভাবা যায়, তখনকার ১৬ টাকার কথা! একটা ইলিশ পাওয়া যায় ১০-১৫ টাকায়। সবার মাথায় হাত। শেষ পর্যন্ত কাঁচামরিচ খাব ১৬ টাকা কেজিতে (তখনকার সেরে)। খেতেই হলো। আমি একটি নামকরা কাগজে অর্থনীতির পাতার সম্পাদক। শিরোনাম করলাম। ‘কাঁচামরিচের বাজারে আগুন’। এটা পড়ে স্বর্গীয় জহুর হুসেন চৌধুরী বললেন, এই মিঞা ১৬ টাকার এই শিরোনাম ৩০ টাকা হলে কী করবে? তখন কি বলবে কাঁচামরিচের বাজারে ‘পেট্রোল’। আমি শুনে অবাক, আজ আর অবাক নই। এবার কাঁচামরিচ কিনলাম ৩০০-৪০০-৫০০-৬০০ টাকা কেজিতে। ভাগ্যের কী পরিহাস! শুধু কাঁচামরিচ নয়, প্রতিটি জিনিসের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী। পেঁয়াজের দাম আবার বাড়তি, চালের দাম বাড়ছে। সবজির বাজারে সামান্য একটু স্বস্তি। শীতের ফসল আসছে। এভাবে দেখা যাচ্ছে-হার্ট যাচ্ছে, লাং যাচ্ছে, চোখের পাওয়ার কমছে, গায়ের চামড়ায় ভাঁজ পড়ছে-সবই ছাড়ছে আমাকে; কিন্তু স্বাধীনতার ৫০-৫২ বছরেও মূল্যস্ফীতি আমাকে ছাড়ছে না। বস্তুত কাউকে না। মূল্যস্ফীতি ঘটছে তো ঘটছেই। পুরোনো সরকার গেছে। নতুন সরকারের আমলেও। মানুষ রীতিমতো ক্ষুব্ধ। কেন এখন এমন হবে? এখন তো সিন্ডিকেট নেই, চাঁদাবাজি নেই, তার ওপর রয়েছে বিশিষ্টজনের উপদেষ্টা পরিষদ।

একেই বলে ভাগ্য, কপাল। দুর্দশা আমাদের ছাড়ছে না। স্বস্তির খবর খুঁজি, পাই না। একটার পর একটা দুঃসংবাদ। ইতিবাচক খবর পাই না। কোনো কিছুতেই না। তবে আমৃত্যু এই দুঃখ নিয়ে বিদায় হব? জানি না। তবে একথা জানি এবং দেখছি সরকার মূল্যস্ফীতি রোধে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। পুরোনো পদক্ষেপগুলোও অব্যাহত আছে। তবু বাজারে তার কোনো ছাপ নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় অনেক ভোগ্যপণ্যের আমদানির ওপর শুল্ক ছাড় দিয়ে যাচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানিতে সংকোচন নীতি লক্ষ করা গেলেও ভোগপণ্য আমদানিতে কোনো বাধা নেই। ডিমের আমদানির জন্যও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ‘টিসিবি’র মারফত ভোগ্যপণ্য বণ্টন যথারীতি চালু রয়েছে। কার্ডের মাধ্যমে গরিবদের মাঝে চাল-গম দেওয়া হচ্ছে। সরকার চাঁদাবাজদের ওপর খক্ষহস্ত। কোনো ব্যবসায়ী/শিল্পপতি আর এখন ক্যাবিনেটে নেই। সবাই সজ্জন ব্যক্তি। কারও কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। অধিকন্তু চলছে ভোক্তা অধিকার সংস্থার নিয়মিত টইল। সমানে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তাদের প্রচার। ‘আদরের প্রচার’। প্রশাসনিক ব্যবস্থা জারি আছে। সীমান্ত অঞ্চলেও ‘দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী’রা চঞ্চল, তারা দেশের ‘সেবা’ করে যাচ্ছেন। ভারত থেকে মাল আমদানি বন্ধ হয়নি, যদিও ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জারি আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়মের বাইরে গিয়ে যারা এ আহ্বান দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের নরম-গরমের মধ্যে আমদানি অব্যাহত আছে, যেমন-প্রায় যুদ্ধরত ভারত-চীনের বাণিজ্য অব্যাহত। এদিকে বাজারে টাকার সাপ্লাই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, ব্যাংক ঋণের খরচ বাড়ানো হয়েছে। কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে ‘ব্যাংক রেট’-যে রেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়। আজকাল বলা হয় ‘রেপো রেট’। নোট ছেপে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) টাকা খরচ নেই বললেই চলে। প্রয়োজনীয় খরচ বাদে বাকি খরচে ‘তালা’ মারা আছে। এক কথায় বলা চলে, যা যা সরকার করতে পারে, তার সবই করা হচ্ছে। কিন্তু বাজার কোনো স্বস্তি দিচ্ছে না। বাজার অন্ধের মতো ব্যবহার করছে। ‘ড্যাম কেয়ার’। এ কারণে যথারীতি মানুষ সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছে এ অনাচারের জন্য।

এ সিন্ডিকেটের জায়গাটাতেই আমার এখন ‘গণ্ডগোল’ লাগে। আগের সরকারের সময় দুই পদের খবর পেতাম। ব্যবসায়ী, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্পপতি ও শেয়ার ব্যবসায়ী, অর্থমন্ত্রী, খাদ্য ব্যবসায়ী, খাদ্যমন্ত্রী-তারা বলতেন সিন্ডিকেট বলতে কিছু নেই। এটা বাজার অর্থনীতি (মার্কেট ইকোনমি)। বাজার বাজারের নিয়মে চলে। চাহিদা-সরবরাহের নিয়মে চলে। অবশ্য একথাই আমরা পুস্তকে পড়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবে বাজার দেখি অন্য ব্যবস্থা। বাজার চলে গেছে বড় বড় করপোরেটদের দখলে। তেল, মরিচ, চিনি, মুড়ি, চিড়া থেকে শুরু করে সবই এখন তাদের হাতে। ছোটদের কোনো জায়গা নেই। বড়রাই হর্তা-কর্তা বিধাতা। বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ তাদের হাতে। প্রত্যেকটি পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট আছে। বিশাল বিশাল হাউজ। ঘরে ঘরে মাল পৌঁছে দেয়। মূল্যবৃদ্ধি হলে তারা অভাবের দোষ দেয়। বলে মালের ঘাটতি। বন্যা হলে বন্যাকে দোষ দেয়। পরব-অনুষ্ঠান হলে তারা পরবের দোষ দেয়। বাজেট হলে তারা বাজেটের দোষ দেয়। সব সময়ই তারা নির্দোষ। আর যত সরকারি সমস্যা। নিজেদের কোনো সমস্যা তারা কোনোদিন বলে না। বাজারকে পুরোপুরি ব্যবহার করে তারা অর্থবিত্ত বানাচ্ছেন। এর মধ্যে কেউ যদি হিসাব করে বলতে পারতেন, এ সময় বড় বড় হাউজ গত ৫০-৫২ বছরে সরকারকে কত টাকা আয়কর দিয়েছে, তাহলে বড়ই উপকার হতো। এবং অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে যাদের অনেকেই টাকা পাচার করেন, হুন্ডির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরই বলেছেন ১০-১২ বিলিয়ন ডলার নাকি এসব অসৎ ব্যবসায়ীরা দেশ থেকে বিদেশে পাচার করেছেন। এখানেই প্রশ্ন। তারা পয়সা বানালেন দেশের লোকের পকেট কেটে, অথচ টাকা রাখেন বিদেশে! এ রোগের ওষুধ কী? তাহলে কি মনোপলি, কার্টেন এবং সিন্ডিকেটের যাতনা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে না? এতদিন মনে করেছিলাম ‘ফাস্ট’ ডলার ইজ ডার্টি ডলার’। তারা টাকা বানাক। পুঁজি করুন। শেষে দেশের কাজে আসবে। এখন দেখা যাচ্ছে এটি আর ঠিক নয়। তারা দেশে টাকা রাখছেন না। তারা কর দিতে প্রস্তুত নন। পৃথিবীর যেসব দ্বীপরাষ্ট্রে কর নেই, তেমন দেশ টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব দেয়, তারা সেখানে চলে যাচ্ছেন। বিদেশে বাড়ি-ঘর থাকা, ছেলেমেয়ের অবস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্মানের চোখে দেখা হয়। বিশাল পরিবর্তন। এক সময় বলা হতো, বাঙালিরা ব্যবসা-জানে না, আজ আর এ কথা কেউ বলতে পারবে না।

তবে কথা একটাই। এটা তো বাজার অর্থনীতি। পরম সাগ্রহে এই ব্যবস্থাকে আমরা গ্রহণ করেছি। বাজার শাসন আমাদের ভালো লাগেনি। ধর্মীয় অনুশাসন আমাদের পছন্দ হয়নি। সামরিক শাসন আমাদের পছন্দ হয়নি। রাষ্ট্রপতির পদ্ধতি সরকার আমরা দেখেছি। সর্বশেষ মনে করলাম সমাজতন্ত্র ছেড়ে বাজার অর্থনীতি এলে একটু শান্তি পাব। কই সেই শান্তি? বাজার তো দেখা যাচ্ছে ক্রেতার চেয়ে বড়, শক্তিশালী। বাজারের কাছে ক্রেতা-ভোক্তা নস্যি। ক্রেতারা ট্যাক্স দেবে, আয়কর দেবে, উচ্চমূল্যে জিনিস কিনবে। পয়সা বানাবে, সুখে থাকবে ‘ক্রোনি ক্যাপিটেলিস্টরা’। বাপরে বাপ, প্রধানমন্ত্রীর পিওন গোছের লোক ৪০০ কোটি টাকা সম্পদের মালিক। ভাবা যায়! ঘরে ঘরে কত টাকা। পাকিস্তান আমলে এক লাখ টাকা থাকলে ওই বাড়িতে ঘি-এর বাতি জ্বলত। লোকের মুখে মুখে ছিল তাদের নাম। এখন ‘লাখপতি’ কোনো ‘পতি’ নয়। শতকোটি হলে আলোচনা হয়। এখন শতকোটির মালিক প্রতি উপজেলায়। যারই একটু জমি আছে, সেই কোটিপতি। হিসাব নেই। ঘরে ঘরে কোটিপতি। অথচ ‘ইনকাম ট্যাক্স’ দেওয়ার কোনো লোক পাওয়া যায় না। উন্নয়নের টাকা পাওয়া যায় না। যা আয় তাই খরচ। গত ৫০-৫২ বছর ধরে। দেশের আয় যত, খরচ আরও বেশি। উন্নয়নের টাকা আসে ঋণের মাধ্যমে। এটা এখন বড় বোঝা। ঋণের আসল ও সুদ কোনোটাই দিতে পারছি না। অনেক ক্ষেত্রে ‘ডিফলটার’। অসম্ভব এক অবস্থা। চারদিকে রমরমা অবস্থা। কিন্তু আমাদের চাল, চিনি, গম, পেঁয়াজ, রসুন, তেল, কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে সব জিনিসই আমদানি করে খেতে হয়। একমাত্র ‘সলিড আয়’ হচ্ছে ‘রেমিট্যান্স’। গপ্প অবশ্য বেশি পোশাক শিল্পের। কিন্তু পোশাক শিল্পের ভ্যালু অ্যাডিশন কত, তার হিসাব আমরা কেউ জানি না। প্রকৃতপক্ষে পরিসংখ্যান একটা বড় সমস্যা। আমাদের প্রকৃত জনসংখ্যা কত আমরা জানি না। কোন পণ্যের উৎপাদন কত, কোন পণ্যের আমদানি কতটুকু, কেউ জানি না। এই আলুতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, উদ্বৃত্ত। এই আলুতে ঘাটতি। এই চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ, এই চালে ঘাটতি। এই মাছে উদ্বৃত্ত। এই মাছ আসে ভারতের হায়দরাবাদ থেকে। লোকসংখ্যার সঙ্গে চাহিদা-সরবরাহের কোনো মিল নেই। রপ্তানির হিসাব ঠিক নেই। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাব ঠিক নেই। ‘জিডিপি’র কোনো হিসাব ঠিক নেই। মূল্যস্ফীতির কোনো সঠিক তথ্য নেই।

যে মাসে মূল্য বাড়ে সেই মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমে। অদ্ভুত ‘হীরক রাজার দেশ’ এটা। অতীতের কুৎসা করা যায়। বর্তমানের করতে হয় প্রশংসা। এতে বেড়েছে ‘ক্রোনি ক্যাপিটেলিজম’। বিশাল ‘পার্টনারশিপ ব্যবসা’। বিগ বিজনেস, ব্যুরোক্রেসি, সামরিক আমলা মিলে গড়ে উঠেছে বিশাল এক ক্রোনি ক্যাপিটেলিজমের দেশ। সবাই যার যার ভাগ পেয়ে শান্ত। ‘করাপ্ট’ লোকেরই প্রাধান্য। মানুষ এখন আর করাপ্ট লোকের নিন্দা করে না-ঈর্ষা করে। এই ‘পার্টনারশিপ’ ব্যবসার লোক কোথায়? আমাদের এক জুনিয়র বন্ধু বলেন-দরকার মানুষ, সাচ্চা মানুষ। মানুষের চরিত্র ঠিক না হলে কোনো কিছুরই কিছু হবে না। অথচ আমরা জানি সমাজে ভালো মানুষ তৈরির ব্যবস্থা আছে। আমরা পরিবারে ভালো কথা শিখি। সমাজে শিখি। স্কুল-কলেজে শিখি। বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিখি। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে শিখি। অধিকন্তু রয়েছে দেশের আইন। সর্বত্র ভালো ভালো শিক্ষা লাভ করার জন্য ব্যক্তিগত জীবনে যা যা করার তাই করি। শিক্ষা থাকে একদিকে, কাজ একদিকে। এই দুইয়ের মিলটা কি সম্ভব? এর উত্তর জানা নেই। ভোগবাদিতা আমাদের যেভাবে পেয়ে বসেছে, তার থেকে মনে হয় মুক্তি নেই। চরম ভোগবাদিতাই মনে হয় সিন্ডিকেট, বাজার অর্থনীতি, ক্রোনি ক্যাপিটেলিজমের মূলে। আগের দিনে অবসরের পরে লোকে একটা ঘর করার কথা ভাবত। আর এখন চাকরির প্রথম সুযোগেই বাড়ি চাই, ফ্ল্যাট চাই, গাড়ি চাই। সময় নেই আমাদের। অতএব, সবাই টাকার সন্ধানে। এখানে তথাকথিত মেধাবীরা হচ্ছে অগ্রণী। শত হোক তারাই তো দেশ চালায়।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম