Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ঢাকা কি রাজধানীর বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে?

Icon

সালাহউদ্দিন নাগরী

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা কি রাজধানীর বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে?

মানুষ সুন্দরকে ভালোবাসে; তাই সে যেমন নিজেকে পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন রাখতে ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চায়, তেমনি তার বাসাবাড়ি, চারপাশের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং এর সৌন্দর্য বাড়াতে চেষ্টা করে। পরিপাটি পরিবেশ মনকে প্রশান্ত রাখে এবং অবসাদ দূর করে। কিন্তু আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরে ঘর থেকে বের হলেই চোখে পড়ে রাস্তার পাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, হয়তো দু-একটা কুকুর-বিড়াল সে আবর্জনা নাড়াঘাঁটা করে আশপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর তা দুর্গন্ধে ছড়াচ্ছে। শহরের অধিকাংশ ফুটপাতে হাঁটার কোনো উপায় নেই, স্থায়ী/অস্থায়ী বিভিন্ন স্থাপনায় ফুটপাত দখল হয়ে গেছে। আর ওই দখলকারীদের যথেচ্ছ ব্যবহারে ফুটপাত এবং তৎসংলগ্ন এলাকা নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে। রাস্তাঘাটে কফ, থুতু, পানের পিক, সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ ফেলা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমাদের মাথার উপরে শহরময় বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ডিশ ও ইন্টারনেটের তারের কুণ্ডলী রাজধানী শহরের পরিপাটি ভাবকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

রাস্তা পারাপারে দুর্ঘটনা এড়াতে ঢাকা শহরজুড়ে বেশ কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ব্রিজগুলো অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। অপরিষ্কার ও ভবঘুরেদের উপদ্রবের কারণে অনেকেই এগুলো এড়িয়ে চলেন। এ ব্রিজগুলো সারা বছর ধরে নানা ধরনের ব্যানার ও পোস্টারে সাঁটা থাকে। এ পোস্টার ও ব্যানারগুলো ফুটওভার ব্রিজের সৌন্দর্যহানি ঘটিয়ে থাকে। অথচ ফুটওভার ব্রিজগুলো ঠিকভাবে সাজাতে পারলে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারত। যানজট নিরসন ও মানুষের চলাচলকে সহজ করার জন্য ফ্লাইওভার ব্রিজ নির্মিত হয়। কিন্তু পুরোনো যে রাস্তা ফ্লাইওভারের নিচে বিদ্যমান আছে, সেই রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় আশপাশে তাকালে মনে প্রশান্তির কোনো ছাপ পড়ে না। আমরা কি দেশের সব ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা ও তৎসংলগ্ন এলাকাকে ক্যান্টনমেন্ট স্টাফ রোডসংলগ্ন ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তার মতো করে সাজাতে পারি না? অবশ্যই পারি। শুধু ভালো কিছু করার মনোভাবকে জাগিয়ে তুলতে হবে।

রাস্তার ধারে কোনো স্থাপনা নির্মাণের সময় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সৌন্দর্যবধর্নে কোনো ধরনের শর্ত আছে কি? মনে হয় নেই। তাই রাস্তার পাশের অফিস, দোকানপাট, স্থাপনাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শহরের শোভাবর্ধনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। রাস্তার ধারের দোকান বা স্থাপনাগুলোর বাহ্যিক সজ্জা মানসম্পন্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। এলোমেলো সিকোয়েন্সবিহীনভাবে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।

আগারগাঁও, সেগুনবাগিচাসহ অফিস পল্লি হিসাবে বিবেচিত এলাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি সড়কদ্বীপ ও রাস্তার মোড়ের আশপাশের জায়গাগুলো বিভিন্ন অফিস/প্রতিষ্ঠানের ছোট-বড় সাইবোর্ড টাঙিয়ে/ঝুলিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। এটি সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিপাটি ভাবকে ক্ষুণ্ন করছে। যদি কোনো অফিস/প্রতিষ্ঠানের লোকেশন সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য নির্দেশক ফলক লাগাতেই হয়, তবে লোহার শিট, স্টিল, প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন আকার-আকৃতি ও রঙের সাইনবোর্ড বিচ্ছিন্নভাবে না লাগিয়ে রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে বা মোড়ে পদ্ধতিগতভাবে স্থাপন করলে সেগুলো শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের উপকরণে পরিণত হতে পারে।

সমন্বয়হীনভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, তৈরি, মেরামত এবং কোনো স্থাপনা নির্মাণের অজুহাতে ইট, বালু, সিমেন্ট, রড ও অন্যান্য দ্রব্য রাস্তার উপর ও পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এতে যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে যেমন অসুবিধা হয়, একইভাবে ওই সরঞ্জামগুলো ড্রেনের পানিপ্রবাহকে রুদ্ধ করে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। ড্রেনের ময়লা তুলে পাশেই রাখা শহরের সৌন্দর্যহানি ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিভিন্ন দিবস পালন ও বিদেশি ভিভিআইপি মেহমান আগমন উপলক্ষ্যে রাস্তার ডিভাইডার ও সড়কদ্বীপগুলো ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো এবং বিভিন্ন রঙিন বাতির লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজে সহায়তা করে থাকে। সাময়িক প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিউটিফিকেশনের কাজগুলো খুব একটা ভালোভাবে সম্পন্ন হয় না। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে স্থায়ী ব্যবস্থারও কোনো উদ্যোগ নেই। পথচারীরা যেন যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলে, সেজন্য শহরজুড়ে লোহার স্ট্যান্ডের মাঝখানে মিনি ডাস্টবিন বসানো হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। এ ধরনের নিুমানের অতিভঙ্গুর ডাস্টবিন উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো দেশের রাজধানীতে শোভা পায় বলে আমার জানা নেই। আমরা মানসম্মত টেকসই আধুনিক ট্রাশক্যান স্থাপন করে সেগুলোকে শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত করতে পারতাম। কবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও তৃতীয় নয়ন সক্রিয় হবে? আমাদের রাস্তার ধারে যেসব স্থাপনা আছে বা তৈরি করা হচ্ছে-সবই কিন্তু মানসম্মত নয় এবং আধুনিক কোনো শহরের ইমেজ বা সাজসজ্জার সঙ্গে মানানসইও নয়। রাস্তার ধারে যাদের জমি বা স্থাপনা আছে, তাদের অনেকের মানসম্পন্ন স্থাপনা নির্মাণ এবং যুগের চাহিদামাফিক ডিজাইন, ডেকোরেশন ও সাজসজ্জার প্রয়োজনীয় অর্থ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি থাকতে পারে। তাই ওই ধরনের ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে সহজ শর্তে ঋণ এবং প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দিয়ে শহরের সৌন্দর্যবৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যায়।

ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জনকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজধানীর রাস্তাঘাট, ফুটপাত নির্মাণের পদ্ধতি আমাদের দেশেও অনুসরণ করা যেতে পারে। আমাদের প্রতিটি রাস্তার সঙ্গে চওড়া ফুটপাত নির্মাণ করতে হবে, যা দেখতেও ভালো লাগে, আবার জনগণের হাঁটার অভ্যাস তৈরি হয় এবং এতে শরীরও সুস্থ থাকে। রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিয়ে সাজাতে হবে। শহরে যত ধরনের পাবলিক টয়লেট আছে, সেগুলোকে দুর্গন্ধমুক্ত, পরিপাটি, সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত করতে হবে। ঘষা খাওয়া, ভাঙাচোরা, দুমড়ানো-মোচড়ানো, রংচটা বাস, মিনিবাস, টেম্পো রাস্তায় চলাচলের যোগ্যতা রাখে না। যততত্র যানবাহন থামানো, যাত্রী ওঠানামা করানো শুধু ট্রাফিক আইন অমান্যের শামিলই নয়, শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের অন্তরায়। শহরকে দুর্ঘটনামুক্ত, পরিপাটি করতে হলে ওইসব যানবাহনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রচলিত আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মহড়া জনজীবনকে বিশৃঙ্খল এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করে। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাসস্ট্যান্ড ছাড়া অন্য কোথাও যাত্রী ওঠানামা না করানোর বিষয়টি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে যেভাবে বাসস্ট্যান্ড নির্মিত হয়, তা অনুসরণ করেই নির্মাণ করতে হবে, যেন শহরের সৌন্দর্যবৃদ্ধি ঘটে।

গেণ্ডারিয়া, কমলাপুর, তেজগাঁও, বনানী সেনানিবাস, বিমানবন্দর রেলস্টেশন অতিক্রম করে যাত্রীদের দূর গন্তব্যে যেতে হয়। রেললাইনের দুপাশে নোংরা, অরুচিকর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আমাদের দৈন্য ফুটিয়ে তোলে। একই চিত্র দেখা যায় ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদীর দুধারে, যা আমাদের সৌন্দর্যবোধ ও স্বাস্থ্যভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কোনো বিদেশি রেলযাত্রী যদি ওই পথে ভ্রমণ করেন, তাহলে আমাদের সৌন্দর্য ও রুচিবোধ সম্পর্কে কেমন ধারণা নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাবেন, তা সহজেই অনুমেয়।

‘DHAKA-400 Years History in Photographs’ নামে ফেসবুকের একটি গ্রুপে ঢাকা শহরের পুরোনো বিভিন্ন স্থাপনা, রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি ও অনেক ঘটনার স্থিরচিত্র পোস্ট করা হয়। ওই ছবিগুলোর সঙ্গে এখনকার ঢাকাকে মেলানো যায় না। আগের ছবিগুলোতেই ঢাকার ভারিক্কি, সৌন্দর্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অনেক বেশি ফুটে উঠেছে। সে পরিবেশ তো ধরে রাখাই যায়নি, বরং প্রতিনিয়ত এ শহর ঘিঞ্জি হয়ে যাচ্ছে। ইট, বালু, সিমেন্ট ও লোহা-লক্কড়ের আবর্জনায় ভরে উঠছে। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকেও স্বপ্নের দেশ আমেরিকার শহরগুলোও খুব একটা মানসম্পন্ন ছিল না। শহর এলাকার জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় এলাকাগুলো যখন অসুন্দর, ঘিঞ্জি, অপরিচ্ছন্ন ও অনিরাপদ হতে থাকে, তখন আমেরিকার লেখক ও সাংবাদিক চালর্স ম্যালফোর্ড রবিনসন নগরগুলোকে সুন্দর, বাসযোগ্য ও পরিপাটি করার জন্য সিটি বিউটিফুল মুভমেন্ট গড়ে তোলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন স্থপতি, প্রকৌশলী ও সংস্কারকরা। ১৮৯০ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত চলা এ আন্দোলন প্রথমদিকে শিকাগো, ক্লেভল্যান্ড, ডেট্রয়েট ও ওয়াশিংটন ডিসিতে শুরু হয়ে পরে সমগ্র আমেরিকাতেই চলতে থাকে। তখন এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের সুন্দর শহরগুলোর আদলে আমেরিকার শহরগুলোকে গড়ে তোলা। ঢাকা ও অন্যান্য শহরের সৌন্দর্যবর্ধনে আমাদেরও ‘সিটি বিউটিফুল মুভমেন্ট’ গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের রাজধানীতে আবাসিক, বাণিজ্যিক, দাপ্তরিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। একটির গা ঘেঁষে আরেকটি স্থাপনা গড়ে উঠছে। ফলে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী বহু আগেই তার আবাসিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। হাসপাতালের পাশে কোচিং সেন্টার, তার পাশে রং তৈরির কারখানা, তার পাশে বাসাবাড়ি গড়ে উঠছে। এর ফলে আমাদের নগরগুলো সৌন্দর্য হারাচ্ছে। আমরা যদি আজ থেকে ১২০০ বছর আগে ইসলামের স্বর্ণযুগে ফিরে যাই, তাহলে দেখব পৃথিবীর প্রথম মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত নগরী বাগদাদ কত সুন্দর পরিকল্পনামাফিক গড়ে তোলা হয়েছিল। একইভাবে ১১০০ বছর আগে আন্দালুসিয়ার (বর্তমান স্পেন) কর্ডোবা, গ্রানাডা, সেভিল নগরী অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন রেখে গেছে। ওইসব নগরীর পাথর বাঁধানো রাস্তা, মানসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, স্ট্রিট লাইট, পরিকল্পনামাফিক স্থাপনা এখনো মানুষকে বিস্ময়ে আপ্লুত করে। বাগদাদ নগরী তৈরির সময় হাসপাতালের জন্য উপযুক্ত জায়গা নির্ধারণে প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী আল রাজীকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি শহরের বিভিন্ন স্থানে পশুর কাঁচা মাংস ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর যে এলাকার মাংসে দেরিতে পচন ধরেছিল, সেটাকে তিনি তুলনামূলকভাবে কম দূষণমুক্ত এলাকা হিসাবে গণ্য করে সে স্থানকে হাসপাতাল তৈরির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। ওই সময়ের পর সভ্যতার হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, আমরা কি কোথাও কোনো স্থাপনা নির্মাণে ওরকম সাবধানী হতে পেরেছি?

সালাহউদ্দিন নাগরী : কলাম লেখক

snagari2012@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম