ফিরে দেখা বিচার বিভাগ পৃথককরণ
ড. মোহাম্মদ আবদুস ছালাম
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ বিচার ও নির্বাহী উভয় বিভাগের জন্য ঐতিহাসিক দিন। ২০০৭ সালের এইদিনে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণ চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে দীর্ঘ ১৭ বছর পার হয়েছে। জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার কতটুকু বাস্তবে রূপলাভ করেছে, তা খতিয়ে দেখার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।
১৯৯৫ সালে মাসদার হোসেনসহ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারের সদস্যদের বেতন স্কেল উন্নীতকরণসংক্রান্ত মামলাটি বিচার বিভাগ পৃথক্করণের মামলা নামে পরিচিতি লাভ করে। এ মামলার প্রেক্ষাপট ও ক্রমবিবর্তন লক্ষ করলে দেখা যায়, ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) সচিব ছিলেন প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। তার নেতৃত্বে বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারের বেতন বৃদ্ধির জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটি বিসিএস (বিচার) ক্যাডারসহ বিসিএস (সড়ক ও জনপথ), বিসিএস (গণপূর্ত) এরূপ পাঁচটি ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডার এবং বিসিএস (বন) ও বিসিএস (পশুসম্পদ) ক্যাডারের বেতন স্কেল বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ০৮-০১-১৯৯৪ তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ওই ক্যাডারগুলোর বেতন স্কেল উন্নীত করা হয়। অন্যান্য সাধারণ ক্যাডার যেমন-বিসিএস (প্রশাসন), বিসিএস (পুলিশ), বিসিএস (আনসার), বিসিএস (পররাষ্ট্র) ইত্যাদি কোনো ক্যাডারেরই বেতন স্কেল বৃদ্ধি করা হয়নি। উক্তরূপ বৈষম্যমূলক আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ হলে তৎকালীন মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠিত হয়। মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ০২-১১-১৯৯৫ তারিখের সংশোধিত আদেশে ০৮-০১-৯৪ তারিখের আদেশের সব বিষয়ই অক্ষুণ্ন রাখা হয়। শুধু বিচার ক্যাডারের সাব-জজ ও অতিরিক্ত জেলা জজদের যে স্কেল উন্নীত করা হয়েছিল, তা নিুতম পদের ৫০ শতাংশ করা হয়, যা অন্যান্য ক্যাডারের ভিত্তি পদের ৫০ শতাংশ সিলেকশন গ্রেড প্রদানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল।
অতঃপর অতি দ্রুততার সঙ্গে মাত্র ১৭ দিন পর সরকারের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে মাসদার হোসেনসহ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারের ৪৪০ জন কর্মকর্তা ১৯-১১-১৯৯৫ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগে ২৪২৪/৯৫ নং রিট পিটিশন করে। মামলাটি মিডিয়ার বদৌলতে এবং বিসিএস (বিচার) ক্যাডারের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় বিচার বিভাগ পৃথক্করণ মামলা নামে পরিচিতি অর্জন করে। মামলার মূল বিষয়বস্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২-১১-১৯৯৫ তারিখের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হলেও আরও কয়েকটি বিষয় আর্জিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো বিচার বিভাগ পৃথক্করণের নির্দেশ প্রদান, পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন, পৃথক বেতন কমিশন ও বর্ধিত আর্থিক সুবিধা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, নির্বাহী বিভাগের দ্বারা হয়রানি বন্ধ। মামলার আর্জির কোথাও ম্যাজিস্ট্রেসি সম্পর্কে সামান্যতম কোনো কথা বলা হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে ম্যাজিস্ট্রেসিকে অন্তর্ভুক্ত করে রায় দেওয়া হয়। মামলাটিতে হাইকোর্ট বিভাগে সরকার পক্ষ কোনোরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। সরকারের বিপক্ষে কোনো মামলা হলে তা আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার কথা; কিন্তু যেহেতু আইন মন্ত্রণালয়ে সচিব থেকে সহকারী সচিব পর্যন্ত সবাই বিসিএস (বিচার) ক্যাডারের কর্মকর্তা, তাই এ মামলায় সরকারকে বিবাদী করা হলেও মূলত বিচার ক্যাডার ডামি বিবাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোনোরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া একপক্ষীয়ভাবে মামলার রায় হয়। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক এবং বিচারপতি মো. হাসান আমিন সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ০৪-০৫-১৯৯৭ তারিখে ৫৯টি অনুচ্ছেদে ৯ দফা নির্দেশনাসংবলিত রায় প্রদান করেন। এ রায়ে বাদীপক্ষের সব দাবিই পূরণ করা হয়েছে। অধিকন্তু, ম্যাজিস্ট্রেসিকে বিচার ক্যাডারের সদস্যদের জন্য নিরঙ্কুশ করা হয়েছে, যা আর্জির কোথাও ছিল না। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, কোনো মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে গেলে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আপিল করার কথা; কিন্তু তারা পুরোপুরি নিশ্চুপ থাকেন। মামলার অন্যতম পক্ষ অর্থ মন্ত্রণালয় মামলাটির বিরুদ্ধে আপিল করে। ৭৯/৯৯ নং সিভিল আপিল মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল মুখ্য রায়দানকারী ছিলেন। চার সদস্যবিশিষ্ট আপিল বিভাগের বেঞ্চে অন্য তিন বিচারক ছিলেন বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিবি রায় চৌধুরী এবং এম আমিন চৌধুরী। ৮৯ অনুচ্ছেদ ও ১২ দফা নির্দেশনা বিশিষ্ট আপিল বিভাগের রায়টি ০২-১২-১৯৯৯ তারিখে ঘোষিত হয়।
আপিল বিভাগের ওই ১২ দফা মূলত ঘোষণামূলক নির্দেশনামূলক নয়। আর ঘোষণামূলক কোনো বিষয় বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তাছাড়া এ রায় বা ১২ দফা নির্দেশনার কোথাও ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের কথা বলা নেই। সর্বোপরি রায়টি বাস্তবায়ন করতে গেলে চারটি বিধিমালা এবং ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করতে হবে, এ বক্তব্য বিসিএস (বিচার) ক্যাডারের সদস্যরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য উদ্ভাবন করেন, রায়ের কোথাও তা নেই। এ চারটি বিধিমালা ও ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ সংশোধনীর খসড়া বিসিএস (বিচার) ক্যাডারের সদস্যদের দ্বারা প্রণীত, এ কথা আপিল বিভাগের ২৬-০১-২০০৩ তারিখের আদেশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। উক্ত চারটি বিধিমালা ও আইন তৎকালীন অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার জারি করেছে আর এটাই হলো তথাকথিত বিচার বিভাগ পৃথক্করণ। অথচ পূর্ববর্তী নির্বাচিত সরকার ৪টি বিধিমালা জারি করেছিল এবং ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছিল, যা সেখানে পেন্ডিং ছিল। পূর্ববর্তী সরকার কর্তৃক জারিকৃত চারটি বিধিমালা বাতিল, সংসদে পেন্ডিং থাকা বিলকে অবজ্ঞা করে এখতিয়ারবহির্ভূত এরূপ গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয়ে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে; যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এখতিয়ারবহির্ভূতই শুধু নয়, বরং সংসদ ও জনগণের নির্বাচিত সরকারের জন্যও অবমাননাকর। মাসদার হোসেন মামলার আইনগত ভিত্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মাসদার হোসেন মামলার বিষয়বস্তু মূলত দুই ভাগে বিভক্ত-বেতন স্কেল ও চাকরিগত সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত ও বিচার বিভাগ পৃথক্করণসংক্রান্ত। প্রথম বিষয়টি সংবিধানের ১১৭ অনুচ্ছেদের আলোকে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভুক্ত, হাইকোর্টে বিবেচনার বিষয় নয়। বিচার বিভাগ পৃথক্করণসংক্রান্ত বিষয়টি সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম্পূর্ণভাবেই আদালতের আওতাবহির্ভূত বিষয়। কারণ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের যে বিষয় উল্লেখ রয়েছে, তা সংবিধানের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতির অধ্যায়ের (৮-২৫ অনুচ্ছেদ) অন্তর্ভুক্ত; যা বাস্তবায়নের নির্দেশনা প্রদানে আদালতকে সম্পূর্ণরূপে বারিত করা হয়েছে।
সুতরাং, মাসদার হোসেন মামলাটি কোনো যুক্তিতেই আদালতে গ্রহণযোগ্য ছিল না। সেখানে মামলাটি শুধু আদালতে গ্রহণই করা হয়নি বরং সংবিধান লঙ্ঘন করে তা বাস্তবায়ন করানো হয়েছে। মাসদার হোসেন মামলায় সংবিধান ও প্রচলিত আইনকানুনের ব্যত্যয় ঘটেছে মর্মে দেখা যায়। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের জন্য হাইকোর্ট বিভাগ রায়টি সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (২) দফার (ক) উপদফার (অ) উপ-উপ দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রদত্ত হয়েছে বলে ওই বিভাগের রায়ের ৪৯নং প্যারায় উল্লেখ রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের এ ক্ষমতা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অর্থাৎ ২৬ থেকে ৪৭ক অনুচ্ছেদসমূহে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োগযোগ্য, তা (১) দফায় উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদটি দ্বিতীয় ভাগের (৮ থেকে ২৫ অনুচ্ছেদ) অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের কোনো কিছুই আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়, তা ৮ অনুচ্ছেদের (২) দফায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জুডিশিয়াল সার্ভিসে নিয়োগদানের জন্য আপিল বিভাগের ৪ নম্বর নির্দেশনায় জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনের কোনো বিধান নেই। বরং ওই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধিমালার আলোকে নিয়োগদানের জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া এ কমিশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন জুডিশিয়ারির হতে হবে, তা-ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটিও সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক মর্যাদা ও তার বিধি প্রণয়নের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের পদায়ন, বদলি ও শৃঙ্খলামূলক বিষয়াদি সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সম্পাদন করবেন। সুপ্রিমকোর্টের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে, তা ওই অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের কোথাও নেই, বরং ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মতামতকে প্রাধান্য দেবেন, এটাই বিধান অথচ আপিল বিভাগের রায় ও বিধিমালাতে সুপ্রিমকোর্টের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে, যা স্পষ্টভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন।
আপিল বিভাগ ১৯-৩-২০০২ তারিখের আদেশে উল্লেখ করেছে, ৭৯/১৯৯৯ সিভিল মামলার রায়ে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের জন্য বলা হয়নি। আবার ২৬-১-২০০৩ তারিখের আদেশে আপিল বিভাগ চারটি বিধিমালা ও একটি বিল সংশোধন করে দিয়ে বলেছে, এগুলো বিচার বিভাগ পৃথক্করণের জন্য করা হলো। রায়-পরবর্তী এভাবে বারবার বিভ্রান্তিমূলক আদেশ সর্বোচ্চ বিচারালয়ের মর্যাদার জন্য সহায়ক নয়।
ভারতের একটি মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, যদি কোনো আইন থাকে, তবে বিচারক অবশ্যই সেটার প্রয়োগ ঘটাতে পারেন; কিন্তু বিচারক কোনো আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বলতে পারেন না। নির্বাহী ও আইনসভার অধিক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হয়, উক্ত দুটো বিভাগ তাদের কার্যাবলি সঠিকভাবে পালন করছে না। যদি বিষয়টি সত্য হিসাবেও ধরে নেওয়া হয়, তাহলে একই অভিযোগ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও আসে, কারণ অর্ধশত বছরব্যাপী আদালতে মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে, তা এ আদালতের রাজেন্দ্র সিং বনাম প্রেম মাই এবং অন্যান্য মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার সাংবিধানিক তাৎপর্য হলো, বিচারক অবশ্যই নিজেকে অন্যান্য বিভাগের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় অনুপ্রবেশ থেকে বিরত রাখবে। সুতরাং, বিচার বিভাগীয় বিরতি দুটি বিষয়ের পরিপূরক-বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উৎকর্ষ এরং ক্ষমতার পৃথক্করণ। রায়ে বিচারকদ্বয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ‘নিউডিল’বিষয়ক আইন প্রণয়নে বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ এবং তদপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সুপ্রিমকোর্টের ওপর রুষ্ট হয়ে পালটা পদক্ষেপ গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে ৩৮নং অনুচ্ছেদে মন্তব্য করেন যে, বিচার বিভাগ যদি বিরত থাকার চর্চা না করে এবং সীমা লঙ্ঘন করে, তাহলে রাজনীতিবিদ এবং অন্যদের পক্ষ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে বাধ্য। রাজনীতিবিদরা তখন পদক্ষেপ নেবে এবং ক্ষমতা খর্ব, এমনকি বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে।
ভারতের সুপ্রিমকোর্টের ওই কালজয়ী রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মাসদার হোসেন মামলায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও তাদের কর্মকাণ্ডকে যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে দেখা যায়, বিচার বিভাগের যেসব কার্যাবলি থেকে বিরত থাকা উচিত তা পুরোপুরি লঙ্ঘন করে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের আদালত জুডিশিয়াল সার্ভিস এবং সহায়ক জনবলের জন্য পদ সৃষ্টির আদেশ দিয়েছেন; বিচারকদের জন্য গাড়ি প্রদানের আদেশ দিয়েছেন; কমিশন সৃষ্টির আদেশ দিয়েছেন; আইন প্রণয়নের জন্য শুধু আদেশ নয়, বরং আইন নিজে তৈরি করে (যদিও বাদীর কাছ থেকে প্রাপ্ত) দিয়েছেন; বিধি প্রণয়ন করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তার দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন সংশোধন করে দিয়েছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। নিজেদের তৈরিকৃত আইন ও বিধি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সচিবদের আদালত অবমাননার অভিযোগে কাঠগড়ায় বছরের পর বছর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ৫০ বছর নয়, ৯০ বছরের মামলা দেশের আদালতে পেন্ডিং, অথচ স্বাধীনতার ২৫ বছর পার হওয়ার অজুহাতে নির্বাহী ও আইনসভার ওপর খড়্গ হস্ত হয়েছে তথাকথিত পৃথক্করণের অজুহাতে এবং সর্বোচ্চ আদালত তার গণ্ডি শুধু ছাড়িয়ে যায়নি বরং নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। সংবিধান অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মাধ্যমে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা সুষ্ঠুভাবে বজায় রেখে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার হস্তান্তরের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন। সংবিধানের ৫৮ঘ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এখতিয়ারবহির্ভূত ছিল। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তৎকালীন অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ জনগণের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন, এটি সর্বজনস্বীকৃত। পৃথক্করণের মাধ্যমে যাতে নির্বিঘ্নে মামলা দায়ের ও সুষ্ঠু তদন্ত, দ্রুত বিচার, স্বল্প খরচে বিচার ও ন্যায়বিচার পেতে পারেন, এটিই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। দীর্ঘ ১৭টি বছর পার হলো। কিন্তু জনগণ কী পেয়েছে, তা এক বিরাট প্রশ্ন। বরং বাস্তবে লক্ষ করা যায়, কোনো ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়নি।
সম্প্রতি যুগান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, সারা দেশের আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ৪২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০৪টি মামলার পাহাড় জমে আছে। অথচ ১ নভেম্বর ২০০৭-এর প্রাক্কালে এর সংখ্যা ছিল ১০ লাখে মতো। দেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গেলে পুরো বিচার বিভাগের সংস্কার অত্যাবশ্যক। বিদ্যমান যেসব অব্যবস্থার কারণে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হচ্ছে, তা দূরীকরণ সমাজে ন্যায়বিচারকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পূর্বশর্ত।
থানায় বা আদালতে মামলা দায়েরে অনিয়ম-দুর্নীতি, তদন্তে অবহেলা ও ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন, মামলা বিচারের ক্ষেত্রে আইনজীবীদের অহেতুক কালক্ষেপণ, আইনজীবীদের জন্য মাত্রাতিরিক্ত খরচ, আদালতের সহায়ক কর্মচারীদের দুর্নীতি, বিচারকদের নেতিবাচক মনোবৃত্তি ও মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, রাষ্ট্রপক্ষে যথাযথভাবে মামলা পরিচালনার অভাব এবং সাক্ষ্য-প্রমাণাদি উপযুক্ত সময়ে হাজির না করানো, বিচারকের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অনুপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়সহ অন্যান্য অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অব্যবস্থা দেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের নামে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তার সবই বিচারকের সুযোগ-সুবিধা এবং তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
অর্থবহ পৃথক্করণের জন্য সুপ্রিমকোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় স্থাপন করা দরকার। আইন মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়/বিভাগে বিচারকদের প্রেষণে নিয়োজিতকরণের বিধান বাতিল করা আবশ্যক। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে দক্ষ, সৎ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত বিচারক নিয়োগের জন্য পৃথক আইন প্রণয়ন করা জরুরি। এছাড়া সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা যাতে নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারেন, সেজন্য অবসর-পরবর্তীকালে প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগের ব্যবস্থা রহিত করা একান্ত অত্যাবশ্যক।
ড. মোহাম্মদ আবদুস ছালাম : লেখক ও গবেষক